কিশোর রাকিবের প্রতারণার ফাঁদে গণমাধ্যম: বাদ যায়নি জেলা প্রশাসনও

গত মার্চের শেষদিকে রিউমর স্ক্যানারের ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপে একটি সংবাদ যাচাইয়ের একাধিক অনুরোধ আসে।

সংবাদটি ছিল এরকম, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের রংপুরের শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসান নামে এক স্কুল শিক্ষার্থী সেরা বিতার্কিক হয়েছেন। 

কিওয়ার্ড সার্চ করে আমরা দেখতে পাই, এই সংবাদটি দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে ২৪ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ অবধি প্রকাশিত হয়েছে। 

এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, কালের কণ্ঠ, ভোরের কাগজ, আরটিভি, সমকাল, জনকণ্ঠ, সময় নিউজ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, জাগো নিউজ, বাহান্ন নিউজ, এবি নিউজ২৪, The Financial Express (opinion), বাংলাদেশ টুডে, দৈনিক শিক্ষা, বি বার্তা২৪, ক্যাম্পাস টাইমস, দৈনিক করতোয়া, রাইজিং বিডি, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, কালবেলা, কালবেলা (২) যুগান্তর, যুগান্তর (২), চ্যানেল২৪, ডেইলি ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাস লাইভ২৪।

Screenshot source: Prothom Alo

তাছাড়া একাধিক পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণে উক্ত দাবিতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দেখুন যুগান্তর, কালবেলা, ভোরের কাগজ, কালের কণ্ঠ, ডেইলি স্টার, জনকণ্ঠ

Screenshot collage: Rumor Scanner 

গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এবং একাধিক ফ্যাক্টচেক অনুরোধ পাওয়ার প্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধান শুরু করে। 

কী পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার?

লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এই বিষয়টিতে প্রায় সকল গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ভাষা এবং তথ্যে মিল পেয়েছি আমরা। 

গণমাধ্যমগুলোর দাবি ছিল, হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ‘ফাইন্ডিং ওয়ার্ল্ড ফিউচার লিডার্স’ শিরোনামে আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে প্রতিযোগিতাটি শেষ হয় ১৪ মার্চ। বিতর্ক হয় অনলাইনে। অংশ নেয় বিভিন্ন দেশের ৫৩৪ জন বিতার্কিক। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার হল্যান্ড লোপ মিশিগান এবারের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সেরা বক্তা হয়েছে। আর বাংলাদেশি স্কুলছাত্র রাকিব ৫৩৪ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে সেরা বিতার্কিক হয়েছে। রাকিব টানা ১৪৪টি বিতর্কে অংশ নিয়ে সব কটি জিতেছে। এর মধ্য দিয়ে হোয়াইট হাউসের রেকর্ডবুকে নাম উঠেছে রাকিবের। রাকিবের আগে লুইস অ্যান্ডারসন নামের একজন টানা ১৩৯টি বিতর্কে জিতে রেকর্ড গড়েছিলেন।” 

এই তথ্যগুলোর সূত্র ধরে রিউমর স্ক্যানার টিম দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে গত ০১ এপ্রিল বিষয়টিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা জানিয়ে ফ্যাক্টচেক (ইংরেজি সংস্করণ) প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

Screenshot source: Rumor Scanner

রিউমর স্ক্যানার জানায়, হোয়াইট হাউস সম্প্রতি এমন কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি এবং এ বিষয়ে হোয়াইট হাউস বা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি। হোয়াইট হাউসের ডোমেইনের সাথে মিল রেখে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে ভুয়া প্রতিযোগিতার বিষয়টি ছড়ানো হয়েছে। রাকিব তার ফেসবুক পোস্টে প্রতিযোগিতার লিগ্যাল ডকুমেন্টস দাবিতে যে ছবিগুলো দিয়েছেন তাতে দুইজন মার্কিন কর্মকর্তার জাল স্বাক্ষরের প্রমাণ মিলেছে। তাছাড়া, রাকিব দুইটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জড়িয়ে ভুয়া খবরের স্ক্রিনশট পোস্ট করেছেন। এমনকি এই কথিত আয়োজনের পুরস্কার বিতরণীর প্রস্তুতি সভার একটি ছবি রয়েছে ভুয়া সাইটটিতে, যেটি মূলত ২০১৮ সালের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক প্রতিযোগিতার ছবি।

পরবর্তীতে ০২ এপ্রিল প্রথম প্রহরে রিউমর স্ক্যানারের ফেসবুক পেজে এ বিষয়ে একটি পোস্ট প্রকাশিত হওয়ার পর খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। 

Screenshot source: Facebook

আমাদের প্রভাব

রিউমর স্ক্যানারের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন এবং ফেসবুক পোস্টের পর একাধিক গণমাধ্যম এ বিষয়ে তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদন সরিয়ে নেয়। এই তালিকায় আছে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, কালের কণ্ঠ, সময় টিভি, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (৩১ মার্চ সরিয়েছে), জাগো নিউজ, দৈনিক শিক্ষা, চ্যানেল২৪, ডেইলি ক্যাম্পাস। 

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো তাদের প্রকাশিত আলোচিত প্রতিবেদনটির লিংকটি সরায়নি, তবে খবরটি সরিয়ে শুধু হেডলাইনে লিখেছে, “তথ্যসূত্র নিয়ে প্রশ্ন থাকায় সংবাদটি অপ্রকাশিত রাখা হয়েছে।”

Screenshot source: Prothom Alo 

তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত কিছু গণমাধ্যমে এখনও উক্ত খবরটি প্রকাশিত অবস্থায় পেয়েছি আমরা। এই তালিকায় আছে ভোরের কাগজ, আরটিভি, জনকণ্ঠ, বাহান্ন নিউজ, এবিনিউজ২৪, The Financial Express (opinion), বাংলাদেশ টুডে, বি বার্তা২৪, দৈনিক করতোয়া, রাইজিং বিডি, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, কালবেলা (প্রিন্ট সংস্করণের ওয়েব লিংক), কালবেলা (২), যুগান্তর (প্রিন্ট সংস্করণের ওয়েব লিংক), যুগান্তর (২), ক্যাম্পাস লাইভ২৪। 

একই প্রতিবেদন এডিট করে ‘খবরটি সঠিক নয়’ বলে জানিয়েছে সমকাল, ক্যাম্পাস টাইমস। 

Screenshot source: Samakal 

রাকিবের লুকোচুরি 

রিউমর স্ক্যানারের ফেসবুক পোস্ট প্রকাশের আধঘন্টার মধ্যেই রাকিব তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেন। পরবর্তীতে সাড়ে চার ঘন্টা পর ০২ এপ্রিল ভোর রাতে অ্যাকাউন্ট পুনরায় চালু করে একটি পোস্ট করেন রাকিব। জানান, তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে সকলে চুপ হয়ে যাবেন।

Screenshot source: Facebook

মামলার হুমকি

রিউমর স্ক্যানারের ফেসবুক পোস্টের পর মোহাম্মদ মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তি রিউমর স্ক্যানারের ফেসবুক পেজে রিউমর স্ক্যানারের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করবেন বলে হুমকি দেন। 

Screenshot source: Facebook

কিন্তু বর্তমানে আইসিটি আইনটি বিলুপ্ত থাকায় আমরা তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পরামর্শ দেই।

বোকা বনেছে রংপুর জেলা প্রশাসন

এদিকে ০১ এপ্রিল রাতে রিউমর স্ক্যানার টিম জানতে পারে, হোয়াইট হাউসের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় রাকিবের সাফল্যের জন্য রাকিবের বর্তমান অবস্থানস্থল রংপুরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ০২ এপ্রিল তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে পেরে তৎক্ষণাতই উক্ত জেলার জেলা প্রশাসককে বিষয়টি অবহিত করে রিউমর স্ক্যানারের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের লিংক পাঠানো হয়। 

কিন্তু ০২ এপ্রিল সকালে রাকিবকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের ফেসবুক পেজেও পোস্ট প্রকাশ করা হয়৷ কিন্তু পোস্টের কমেন্টে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে পোস্টটি সরিয়ে নেয়া হয়।

Screenshot collage: Rumor Scanner 

একই দিন সংবর্ধনা গ্রহণের পর রাকিব তার সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টসহ (ব্যাখ্যা সম্পর্কিত) প্রতিযোগিতা সম্পর্কিত তার দেওয়া একাধিক পোস্ট সরিয়ে ফেলেন। সেদিন রাতের মধ্যে তার শেয়ার করা বিভিন্ন গণমাধ্যমের লিংকও সরিয়ে ফেলেন রাকিব। এখন তার অ্যাকাউন্টে উক্ত প্রতিযোগিতার বিষয়ে কোনো পোস্ট নেই। 

পোস্টগুলো সরিয়ে ফেলার আগে রাকিবের অ্যাকাউন্টের আর্কাইভ লিংক দেখুন এখানে। 
পোস্টগুলো সরিয়ে ফেলার পরে রাকিবের অ্যাকাউন্টের আর্কাইভ লিংক দেখুন এখানে।

কী বলছেন রংপুরের জেলা প্রশাসক?

রাকিবকে সংবর্ধনা দেওয়া এবং সে সম্পর্কিত পোস্ট ফেসবুকে দেওয়ার পর তা মুছে দেওয়ার প্রেক্ষিতে সার্বিক বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের সাথে যোগাযোগ করেছিল। 

তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “পুরস্কার দেওয়ার আগ পর্যন্ত বিষয়টা সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না। বাচ্চাটা মেধাবী হতে পারে, তাকে অন্যান্য কারণে পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে কিন্তু এই ব্যাপারে তাকে পুরস্কৃত করার কোনো সুযোগ নেই৷ তারপরও যেহেতু ঘটনা ঘটেছে, আমি তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি।” 

ড. নাজনীন বলছেন, তদন্তকারীদের এ বিষয়ে অতি দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। একই সাথে তদন্ত কাজের জন্য তার চাওয়ার প্রেক্ষিতে তাকে  রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে। 

মার্কিন দূতাবাস কী বলেছে?

হোয়াইট হাউস সম্প্রতি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে কিনা এবং ওয়ার্ডপ্রেস সাইটটি হোয়াইট হাউসের অন্তর্গত কিনা জানতে চাইলে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ‘ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র’ ব্রায়ান শিলার রিউমর স্ক্যানারকে গতকাল (০২ এপ্রিল) জানান, “আমি এই ইভেন্ট সম্পর্কে কথিত ঘোষণার সাথে দুটি ওয়েবসাইট লিঙ্ক দেখেছি, তবে, এটি খাঁটি বলে মনে হয়নি। এটি দুটি কারণে সত্য। প্রথমত, হোয়াইট হাউসের কোনো লোগো ছিল না। দ্বিতীয়ত, তারা “.com” ঠিকানা থেকে এসেছে এবং হোয়াইট হাউস একটি “.gov” ঠিকানা ব্যবহার করে: www.whitehouse.gov।” 

অর্থাৎ, মার্কিন দূতাবাসও বিষয়টিকে ভুয়া বলে নিশ্চিত করেছে। 

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে রিউমর স্ক্যানার

আলোচিত ভুয়া বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিষয়ে গণমাধ্যম তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি এ বিষয়ে নতুন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে পাঁচটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। এই তালিকায় আছে ডেইলি স্টার, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ঢাকা ট্রিবিউন, ক্যাম্পাস টাইমস এবং বাংলা ট্রিবিউন। 

রিউমর স্ক্যানারের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনের পর এ বিষয়ে গত ০২ এপ্রিল প্রথম ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)। সংবাদমাধ্যমটি এ সংক্রান্ত বেশকিছু তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেছে যার অধিকাংশ রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। পাশাপাশি টিবিএস মার্কিন দূতাবাস এবং রাকিবের পরিবারের সাথেও এ ব্যাপারে কথা বলেছে। 

Screenshot source: TBS

একইদিন আরেক গণমাধ্যম ‘The Daily Star’ ও একই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নিজেদের পূর্বের প্রতিবেদনের ভুল স্বীকার এবং রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনের বিষয়টি উল্লেখ করে পত্রিকাটি রংপুর জেলা প্রশাসনের রাকিবকে দেওয়া সংবর্ধনার প্রসঙ্গটিও এনেছে প্রতিবেদনে। 

Screenshot source: The Daily Star 

আজ ০৩ এপ্রিল একই বিষয়ে ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ঢাকা ট্রিবিউন। 

সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, “সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের সত্যতা যাচাইকারী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক “রিউমার স্কানার” প্রতিবেদেনটির তথ্য যাচাই করে। সংস্থাটি তথ্যে গড়মিল ও এমন প্রতিযোগিতার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি।”

ঢাকা ট্রিবিউন বলছে, “রিউমার স্কানার দেখেছে, জো বাইডেনের ওই দিনের অফিশিয়াল কর্মসূচি শুরু হয়েছিল স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায়। দিনব্যপী নানান কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিকেল ৫টায় বাইডেন হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন। ওই প্রতিযোগিতা নিয়েও তিনি কোনো বিবৃতি দেননি। এছাড়া আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নামেও ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করে সংবাদটি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোরও সত্যতা পেয়েছে সত্যতা নিশ্চিত করা প্রতিষ্ঠানটি। হোয়াইট হাউসের নামে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।”

Screenshot source: Dhaka Tribune  

আরেক সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন একইদিন রংপুর জেলা প্রশাসনের রাকিবকে দেওয়া সংবর্ধনার বিষয়টিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, “গণমাধ্যমের খবরের ফ্যাক্ট চেক করা ‘রিউমার স্ক্যানার’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, হোয়াইট হাউজ সম্প্রতি এমন কোনও প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি এবং এ বিষয়ে হোয়াইট হাউজ বা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কোনও সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি। হোয়াইট হাউজের ডোমেইনের সঙ্গে মিল রেখে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে ভুয়া প্রতিযোগিতার বিষয়টি ছড়ানো হয়েছে। রাকিব তার ফেসবুক পোস্টে প্রতিযোগিতার লিগ্যাল ডকুমেন্টস হিসেবে যে ছবিগুলো দিয়েছেন তাতে দুজন মার্কিন কর্মকর্তার জাল স্বাক্ষরের প্রমাণ মিলেছে। তাছাড়া সেখানে দুটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জড়িয়ে ভুয়া খবরের স্ক্রিনশটও দেওয়া হয়েছিল। এমনকি এই কথিত আয়োজনের পুরস্কার বিতরণীর সভার একটি ছবি রয়েছে ভুয়া সাইটটিতে, যেটি মূলত ২০১৮ সালের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক প্রতিযোগিতার ছবি।”

এই বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সাফিউল আযমের সাক্ষাৎকার নিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি। তিনি বলেছেন, “দেশের নামকরা গণমাধ্যমগুলো এত বড় খবর পরিবেশন করার আগে যাচাইবাছাই করলো না? বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অনায়াসেই খবরটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব ছিল- তা না করে তারা চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তবে জনপ্রিয় কয়েকটি অনলাইন পত্রিকাসহ কয়েকটি গণমাধ্যম খবরটির সত্যতা নিশ্চিত না হওয়ায় পরিবেশন করেনি- এ জন্য তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।”

 Screenshot source: Bangla Tribune

অনলাইন সংবাদমাধ্যম ক্যাম্পাস টাইমস একই বিষয়ে তাদের প্রকাশিত পূর্বের প্রতিবেদনটি সংশোধন করে রিউমর স্ক্যানারকে তথ্যের সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছে, “গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদটি সঠিক নয় বরং হোয়াইট হাউস সম্প্রতি এমন কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি। হোয়াইট হাউসের ডোমেইনের সাথে মিল রেখে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে ভুয়া একটি প্রতিযোগিতায় রাকিব সেরা বিতার্কিক হয়েছেন বলে দাবি করেছেন।”

Screenshot source: Campus Times

জাতীয় দৈনিক ‘সমকাল’ও হেঁটেছে একই পথে, পূর্বের প্রতিবেদনটি সংশোধন করেছে। 

রিউমর স্ক্যানারের বরাতে সংশোধিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “হোয়াইট হাউসের নাম ব্যবহার করে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি রাকিবের সাফল্যের যে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা সঠিক নয়। হোয়াইট হাউস সম্প্রতি এমন কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি।”

Screenshot source: Samakal

একাত্তর জার্নালে রিউমর স্ক্যানার 

দেশজুড়ে আলোচিত এই বিষয়টিতে আলোচনার জন্য রিউমর স্ক্যানারের সদস্য ফ্যাক্ট চেকার তানভীর মাহতাব আবীরকে আমন্ত্রণ জানায় মূল ধারার গণমাধ্যম একাত্তর টেলিভিশন। সংবাদমাধ্যমটির নিয়মিত আয়োজন ‘একাত্তর জার্নাল‘ অনুষ্ঠানে গতকাল (০২ এপ্রিল) এ বিষয়ে আলোচনা হয়। 

Screenshot source: Ekattor

একই অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন রাকিবের দাদা মুস্তাফিজুর রহমান বকুল, বৈশাখী টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক এবং দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত। উল্লেখ্য, মুস্তাফিজুর রহমান বকুল ভোরের কাগজ পত্রিকারই দিনাজপুরের পার্বতীপুরের প্রতিনিধি। রাকিবের দাদা দাবি করেছেন, তার নাতি প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন। একইসাথে তিনি গণমাধ্যমকেও দায়ী করেন খবরটি যাচাই করে প্রকাশ না করায়। 

উপস্থাপক মিথিলা ফারজানার এক প্রশ্নের জবাবে শ্যামল দত্ত বলেন, “অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের কোনো ফ্যাক্টচেকিং ব্যবস্থাই নেই। আমরা যখন কোনো আন্তর্জাতিক মিডিয়া বা কোনো একটি সোর্স থেকে খবর আসে আমরা নির্বিবাদে সেটি প্রকাশ করে। এটা আমাদের দুর্বলতা বলুন আর যাই বলুন না কেন আমাদের একটা উইকনেস। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক খবরগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের ওরকম কোনো ব্যবস্থাপনাই নেই যে আমরা একটু চেক করে দেখবো খবরটি সঠিক কিনা বা আদৌ এর ভিত্তি আছে কিনা। সেটিরই একটি অত্যন্ত বাজে স্বীকার হয়ে গেছি আমরা। আমাদের আরও সচেতন হবে।” 

অনুষ্ঠানে আরিফ জেবতিক জানান, “১৭ বছরের কিশোর গোটা বাংলাদেশের মিডিয়ার দুর্বলতাকে সবার কাছে তুলে ধরলো।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাকে অ্যাওয়ার্ড দেবে আর দূতাবাস তাকে ভিসা দিচ্ছে না। এটাই দ্বিধার বিষয়।”

শ্যামল দত্ত এই ঘটনায় মিডিয়ার দায়ের প্রশ্নে বলেন, “যখন এই ধরনের খবরগুলো বাংলাদেশে আসে আমরা সেটা আনন্দের সংবাদ হিসেবে নেই। কিন্তু এটা যদি কেই প্রতারণার একটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে আসে তাহলে বিষয়টি দুঃখজনক।”

শ্যামল দত্ত বলছিলেন, “আজ ফ্যাক্টচেকিং দিবস। এই ধরনের বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমে নেই। যদি থাকতো তাহলে বাংলাদেশের শীর্ষ গণমাধ্যম বলে যাদেরকে আমরা চিনি… ফ্যাক্টচেকিং কিন্তু অনেক জায়গায় আছে। ইদানিং চালু হয়েছে। খবর পেলেই আপনি ছেপে দেবেন এটা ঠিক না।”

তবে শ্যামল দত্ত যে পত্রিকার সম্পাদক সেই ‘ভোরের কাগজ’ এর ওয়েবসাইটে এখনও তাদের পূর্বের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে। 

অনুষ্ঠানে ফ্যাক্টচেকের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। 

সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে এবং উক্ত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের রংপুরের শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসান নামে এক স্কুল শিক্ষার্থী সেরা বিতার্কিক হয়েছেন দাবির প্রেক্ষিতে বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে সনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। তারই প্রেক্ষিতে দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেওয়া এই বিষয়ের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে এই ফ্যাক্টস্টোরিতে যেখানে রাকিবের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের প্রতিযোগিতা বিষয়ক সকল পোস্ট সরিয়ে নেওয়া, রংপুরের জেলা প্রশাসন কর্তৃক রাকিবকে সংবর্ধনা দেওয়া, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো সরিয়ে নেওয়া এবং ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশ, রিউমর স্ক্যানারকে মামলার হুমকি দেয়া এবং একাত্তর টেলিভিশনের টকশোতে রিউমর স্ক্যানারের অংশগ্রহণসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।  

তথ্যসূত্র

  • Statement from DC, Rangpur 
  • Rumor Scanner’s own analysis 
  • Shah Muhammad Rakib Hasan: Facebook Account 
  • Statement from Bryan Schiller, ‘Acting U.S. Embassy Spokesperson, The US Embassy in Dhaka

আরও পড়ুন

spot_img