সম্প্রতি, দেশের গণমাধ্যমগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। উক্ত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের রংপুরের শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসান নামে এক স্কুল শিক্ষার্থী সেরা বিতার্কিক হয়েছেন বলেও দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনগুলোতে।
গণমাধ্যমে যা দাবি করা হয়েছে
জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো‘ দাবি করেছে, “হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ‘ফাইন্ডিং ওয়ার্ল্ড ফিউচার লিডার্স’ শিরোনামে আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে প্রতিযোগিতাটি শেষ হয় ১৪ মার্চ। বিতর্ক হয় অনলাইনে। অংশ নেয় বিভিন্ন দেশের ৫৩৪ জন বিতার্কিক। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।”
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ‘ভবিষ্যতের নেতা খুঁজতে’ প্রতিবছর দুটি ক্যাটাগরিতে সংসদীয় বিতর্ক আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। একটি ব্রিটিশ সংসদীয় বিতর্ক, অন্যটি এশিয়ান সংসদীয় বিতর্ক। এবারের আয়োজনে চ্যাম্পিয়ন দেশ রাশিয়া। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্র।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার হল্যান্ড লোপ মিশিগান এবারের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সেরা বক্তা হয়েছে। আর বাংলাদেশি স্কুলছাত্র রাকিব ৫৩৪ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে সেরা বিতার্কিক হয়েছে। রাকিব টানা ১৪৪টি বিতর্কে অংশ নিয়ে সব কটি জিতেছে। এর মধ্য দিয়ে হোয়াইট হাউসের রেকর্ডবুকে নাম উঠেছে রাকিবের। রাকিবের আগে লুইস অ্যান্ডারসন নামের একজন টানা ১৩৯টি বিতর্কে জিতে রেকর্ড গড়েছিলেন। ”
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশি স্কুলছাত্র শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। রাকিব সেখানে দাবি করেন, গত ২৮ মার্চ স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮ টায় ওয়াশিংটন হোয়াইট হাউস সাউথ কোর্ট অডিটোরিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন জেফ জায়েন্টস। ভিসা পাইনি বলে সরাসরি পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারিনি।
আবেদন এবং নিবন্ধনে তার কোনো খরচ লাগেনি বলেও প্রতিবেদনে দাবি করেন রাকিব।
উক্ত দাবিগুলোতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, কালের কণ্ঠ, ভোরের কাগজ, আরটিভি, সমকাল, জনকণ্ঠ, সময় নিউজ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, জাগো নিউজ, বাহান্ন নিউজ, এবি নিউজ২৪, The Financial Express (opinion), বাংলাদেশ টুডে, দৈনিক শিক্ষা, বি বার্তা২৪, ক্যাম্পাস টাইমস, দৈনিক করতোয়া, রাইজিং বিডি, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, কালবেলা, ভোরের ডাক, কালবেলা (২) যুগান্তর, যুগান্তর (২), চ্যানেল২৪, ডেইলি ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাস লাইভ২৪।
তাছাড়া একাধিক পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণে উক্ত দাবিতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দেখুন যুগান্তর (২৬ মার্চ), কালবেলা (৩০ মার্চ), ভোরের কাগজ (২৬ মার্চ), কালের কণ্ঠ (৩০ মার্চ), ডেইলি স্টার (২৯ মার্চ), জনকণ্ঠ (২৭ মার্চ)।
একই দাবিতে ছড়িয়ে পড়া ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, হোয়াইট হাউসের নাম ব্যবহার করে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি রাকিবের সাফল্যের যে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা সঠিক নয় বরং হোয়াইট হাউস সম্প্রতি এমন কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি। হোয়াইট হাউসের ডোমেইনের সাথে মিল রেখে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে ভুয়া একটি প্রতিযোগিতায় রাকিব সেরা বিতার্কিক হয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
প্রতিযোগিতাটির অস্তিত্বই নেই
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে রিউমর স্ক্যানার টিম গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর তথ্য যাচাই করে দেখার চেষ্টা করেছে।
গণমাধ্যমের তথ্যের সূত্র ধরে প্রতিযোগিতাটির শিরোনামটি (Finding World Future Leaders) কিওয়ার্ড সার্চ করে এই ধরনের কোনো প্রতিযোগিতার অস্তিত্ব ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রতিযোগিতাটি হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে দাবির প্রেক্ষিতে রিউমর স্ক্যানার টিম হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে কিওয়ার্ড এবং ম্যানুয়াল সার্চ করে এমন কোনো প্রতিযোগিতার বিষয়ে তথ্য পায়নি।
বাইডেন ২৮ মার্চ কথিত প্রতিযোগিতাটিতে উপস্থিত ছিলেন?
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের দাবি অনুযায়ী, গত ২৮ মার্চ স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮ টায় ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউস সাউথ কোর্ট অডিটোরিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিযোগিতাটির বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম জো বাইডেনের ২৮ মার্চের পুরো দিনের সিডিউল (১,২) বিশ্লেষণ করে দেখেছে। উক্ত সিডিউল অনুযায়ী তাঁর দিনের অফিসিয়াল কর্মসূচী শুরু হয়েছিল স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টায় ডেইলি ব্রিফিং গ্রহণ করার মাধ্যমে। পরবর্তীতে দিনব্যপী নানান কর্মসূচীতে যোগদান শেষে বিকেল পাঁচটায় বাইডেন হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন।
সিডিউলটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেদিন বাইডেনের হোয়াইট হাউস সাউথ কোর্ট অডিটোরিয়ামে কোনো কর্মসূচী ছিল না। তিনি সকাল সাড়ে আটটায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর দিনের কর্মসূচী শুরুই হয়েছিল সকাল সাড়ে নয়টায়।
বাইডেন অবশ্য পরদিন অর্থাৎ ২৯ মার্চ সাউথ কোর্ট অডিটোরিয়ামে একটি ডেমোক্রেসি সামিটে অংশ নিয়েছিলেন। এই কর্মসূচীর তথ্য তাঁর ২৯ মার্চের সিডিউলে উল্লেখ ছিল।
বাইডেন এবং হোয়াইট হাউস সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়মিতই আপডেট দেওয়া হয় হোয়াইট হাউসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের Briefing Room এবং Press Briefing নামক দুইটি সেকশনে।
প্রতিযোগিতাটির বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়েছে কিনা বা বাইডেন এমন কোনো প্রতিযোগিতায় সম্প্রতি উপস্থিত ছিলেন কিনা সে বিষয়ে জানতে উক্ত দুই সেকশনের গেল এক মাসের (১ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ) বিবৃতিগুলো বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে কোনো তথ্য মেলেনি।
অর্থাৎ, আলোচিত বিতর্ক প্রতিযোগিতাটির বিষয়ে হোয়াইট হাউস বা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি।
‘সেরা বিতার্কিক’ রাকিবের খোঁজে
রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে রংপুরের স্কুলছাত্র শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসানের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি খুঁজে পাওয়া যায়।
অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, রাকিব নিয়মিতই তার ‘সাম্প্রতিক সাফল্যের’ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো শেয়ার করছেন।
লিগ্যাল ডকুমেন্টসে ভুয়া স্বাক্ষর
রাকিব তার অ্যাকাউন্টে গত ২৯ মার্চ প্রকাশিত একটি পোস্টে (আর্কাইভ) আলোচিত প্রতিযোগিতার লিগ্যাল ডকুমেন্টস দাবিতে চারটি ছবি যুক্ত করেন।
রিউমর স্ক্যানার টিম ছবিগুলো বিশ্লেষণ এবং যাচাই করে দেখেছে। ১ম ছবিতে ‘Whitehouse International Debate Competition 2023’ শিরোনামের একটি সার্টিফিকেট দেখা যায়। যেখানে লেখা রয়েছে, শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসানকে White House International Debate 2023 প্রতিযোগিতায় Debator of the Tournament হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
খেয়াল করলে দেখবেন, সার্টিফিকেটের শিরোনামে দেওয়া প্রতিযোগিতার নাম আর মূল লেখায় উল্লিখিত প্রতিযোগিতার নামে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। শিরোনামে Whitehouse শীর্ষক দুইটি শব্দ একসাথে থাকলেও ভেতরের মূল লেখায় আলাদা রয়েছে। শিরোনামে Debate এর পর Competition শব্দটি থাকলেও মূল লেখায় তা নেই।
তাছাড়া, মূল লেখায় একটি নতুন বিশ্ব রেকর্ড করার বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও কী সেই রেকর্ড সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।
সার্টিফিকেটে মোট তিনটি স্বাক্ষর রয়েছে। প্রথম স্বাক্ষরটি হোয়াইট হাউসের Head Counsel বলে দাবি করা হয়েছে।
কিওয়ার্ড সার্চ করে রিউমর স্ক্যানার টিম দেখেছে, হোয়াইট হাউসের কাউন্সেল হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন স্টুয়ার্ট ডেলেরি (Stuart Delery)। তার স্বাক্ষরের সাথে আলোচিত সার্টিফিকেটের স্বাক্ষরের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় স্বাক্ষরটি (ডানে উপরে) মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। তার স্বাক্ষরের সাথে অবশ্য আলোচিত সার্টিফিকেটের স্বাক্ষরের মিল রয়েছে। অবশ্য তাঁর স্বাক্ষর কিওয়ার্ড সার্চ করে তার নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টসহ একাধিক ওপেন সোর্সেই (১,২) পাওয়া যায়।
এই দুইজনের স্বাক্ষর রয়েছে পরের অর্থাৎ দ্বিতীয় ছবিতেও। এই ছবিতে আরেকটি সার্টিফিকেট রয়েছে যেটি রাকিবকে উক্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
তৃতীয় ছবিতে রাকিবের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার (030829723105), রেজিস্ট্রেশন কোড (AB07) উল্লেখ করে দাবি করা হচ্ছে, তিনি ১৪৪ টি ডিবেট জয় লাভ করায় হোয়াইট হাউসের রেকর্ড বুকে নাম লিখিয়েছেন। ছবিতে আরও লেখা রয়েছে, এই ফলাফল ১৭ মার্চ তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলেও ব্রিটিশ রুল এবং রেগুলেশনের কারণে এখন সেটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এরপর এই ফলাফল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অফিসিয়াল কোন ওয়েবসাইটটে ফলাফল প্রকাশ হয়েছিল সে বিষয়ে উল্লেখ নেই ছবিতে। মার্কিন একটি প্রতিযোগিতা ব্রিটিশ নিয়ম মেনে কেন ওয়েবসাইট থেকে ফলাফল সরিয়ে ফেলতে হল সেটিও প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এই ছবির নিচে জেফরি জিয়ান্টস (Jeffrey Zients) নামে এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ রয়েছে যিনি উপরের বিবৃতির বিষয়টি স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার একটি স্বাক্ষরও রয়েছে যা অন্য তিন ছবিতেও ছিল।
অর্থাৎ, চারটি ছবিতে (১ম ও ২য় ছবির তৃতীয় স্বাক্ষর) যে স্বাক্ষর রয়েছে সেটি জেফরি জিয়ান্টস নামে এক ব্যক্তির। তার পদবি উল্লেখ নেই ছবিতে।
রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, জেফরি জিয়ান্টস হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার স্বাক্ষরের সাথে আলোচিত সার্টিফিকেটের স্বাক্ষরের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, সার্টিফিকেটসহ রাকিবের পোস্ট করা চারটি ছবিতে যে তিনজনের স্বাক্ষর রয়েছে তাদের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্যতিত বাকি দুইজনের স্বাক্ষর জাল বা ভুয়া। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের যে স্বাক্ষর ছবিতে দেখা যাচ্ছে সেটি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ এই স্বাক্ষরটি বাইডেনের টুইটার অ্যাকাউন্টসহ একাধিক ওপেন সোর্সের ডকুমেন্টে সহজেই পাওয়া যায়।
চতুর্থ ছবিতে রাকিবের উক্ত প্রতিযোগিতার স্ক্রিনশট দেখা যাচ্ছে, যেখানে তার নাম, ঠিকানা, জিমেইল, রেজিষ্ট্রেশন নম্বরসহ আনুষঙ্গিক তথ্যাদি রয়েছে। কার্ডে উল্লেখ রয়েছে, তিনি রেজিষ্ট্রেশন করেন গত ২৫ ফেব্রুয়ারি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জড়িয়ে ভুয়া খবরের স্ক্রিনশট
রাকিবের অ্যাকাউন্টে আরো স্ক্রল করে দেখা যায়, গত ২০ মার্চ ‘The Real Goat is Here’ ক্যাপশনে একটি পোস্টে (আর্কাইভ) দুইটি পত্রিকার ছাপা সংস্করণের খবরের স্ক্রিনশট শেয়ার করেন রাকিব।
বামদিকের ছবিতে থাকা পত্রিকার নাম পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। তবে The New শীর্ষক দুইটি শব্দ দেখা যাচ্ছে। অনুসন্ধানে আমরা দেখেছি, পত্রিকাটির নামের শুরুর দুই শব্দ এবং ফন্ট মার্কিন সংবাদমাধ্যম The New York Times এর সাথে মিল পাওয়া যায়।
দেখুন ছবিতে –
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবরটি ১৯ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। খবরটির স্ক্রিনশটে এই তারিখটি উল্লেখ দেখা যাচ্ছে।
এই তথ্যের সূত্র ধরে ১৯ মার্চের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সকল পাতা বিশ্লেষণ করে এ সংক্রান্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
রাকিবের পোস্টের ডানদিকের ছবিতে থাকা পত্রিকার নামও পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। তবে BBC New এই দুই শব্দ দেখা যাচ্ছে। অনুসন্ধানে আমরা দেখেছি, এই নামে পৃথিবীতে একটি সংবাদমাধ্যমই রয়েছে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম BBC। কিন্তু সংবাদমাধ্যমটির লোগোর ফন্টের সাথে রাকিবের ছবিতে থাকা bbc news এর ফন্টের মিল নেই।
দেখুন ছবিতে –
তাছাড়া, বিবিসি কোনো দেশেই পত্রিকা প্রকাশ করে না।
অর্থাৎ, রাকিব যে দুই সংবাদমাধ্যমের খবরের স্ক্রিনশট শেয়ার করেছেন সেগুলো আদতে ভুয়া।
দুইটি স্ক্রিনশট এডিট করে বানানো এমন সন্দেহ থেকে রিউমর স্ক্যানার টিম সার্চ ইন্জিন গুগলে প্রাসঙ্গিক একাধিক ভিন্ন কিওয়ার্ড সার্চ করার পর fodey নামে একটি ওয়েবসাইটের সন্ধান পায়।
ওয়েবসাইটটির হোমপেজে একটি পত্রিকার স্ক্রিনশট দেখা যাচ্ছে যার ফরমেট এবং লেখার ধরণের সাথে রাকিব যে দুই সংবাদমাধ্যমের খবরের স্ক্রিনশট শেয়ার করেছেন সেগুলোর মিল পাওয়া যায়।
এই সাইটটির মাধ্যমে মূলত বিনোদনের উদ্দেশ্যে পত্রিকার নাম, তারিখ, শিরোনাম এবং খবর বসিয়ে স্ক্রিনশট তৈরি করে নেওয়া যায়।
রিউমর স্ক্যানার টিম বিষয়টি পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে অনুরূপ একটি স্ক্রিনশট তৈরি করেছে।
দেখুন ছবিতে –
অর্থাৎ, একইভাবে রাকিবের পোস্টে উল্লিখিত দুইটি সংবাদমাধ্যমের স্ক্রিনশটও তৈরি করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিযোগিতার বিষয়ে ১৯ মার্চের আগে কোনো পোস্ট দেননি রাকিব
রাকিব আলোচিত এই প্রতিযোগিতার বিষয়ে প্রথম পোস্ট (আর্কাইভ) দেন ১৯ মার্চ। নিজের ছবি এবং সেরা বিতার্কিক শীর্ষক তথ্য সম্বলিত ছবির সাথে পোস্টের ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশের একজন বিতার্কিক হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক বড় প্ল্যাটফর্মে অংশগ্রহণ করা আমার জন্য দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। আমি অন্যদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। তারা কেবল দুর্দান্ত ছিল, বিশেষত ফ্রেডরিক উইলিয়ামস! সেসব স্মৃতি আমি কখনো ভুলব না। আমার জন্য প্রার্থনা করবেন। (অনূদিত)”
গণমাধ্যম ও তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিযোগিতার সময়কাল ছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মার্চ। ফলাফল প্রকাশ ১৭ মার্চ। এই পুরো সময়টায় রাকিব আলোচিত প্রতিযোগিতার বিষয়ে কোনো পোস্ট করেননি তার অ্যাকাউন্টে।
ওয়ার্ডপ্রেসে ভুয়া ওয়েবসাইটে তৈরি করে আয়োজনের আপডেট
রাকিবের পোস্টে একটি অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই আমরা হোয়াইট হাউসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে খুঁজে দেখেছি যেখানে এমন কোনো প্রতিযোগিতার উল্লেখ পাওয়া যায়নি। যেহেতু দাবি করা হয়েছে, ওয়েবসাইট থেকে ফলাফল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সেহেতু রিউমর স্ক্যানার টিম হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটের গেল এক মাসের আর্কাইভ পেজগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে। কিন্তু আর্কাইভেও এমন কোনো প্রতিযোগিতার তথ্য মেলেনি।
পরবর্তীতে বিভিন্ন কি ওয়ার্ড এবং প্রাসঙ্গিক ম্যানুয়াল সার্চের মাধ্যমে http://whitehouse.gov.unaux.com (আর্কাইভ) নামে একটি সাইটের খোঁজ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
একইসময়ে রাকিবের সাথে যোগাযোগ করলে তিনিও আমাদের একই ওয়েবসাইটের লিংক পাঠান।
সাইটটতে প্রবেশের শুরুতেই একটি সতর্কীকরণ বার্তা দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটি হয়ত একটি ভুয়া সাইট। আক্রমণকারীরা হুবহু একই রকম সাইট তৈরির জন্য url পরিবর্তন করে থাকতে পারে।
Ignore অপশনটি ক্লিক করে (০১ এপ্রিল) সাইটটিতে প্রবেশ করে দেখা যায়, এটি ওয়ার্ডপ্রেসের মাধ্যমে তৈরিকৃত একটি সাইট। সাইটে দুইটি পোস্ট এবং একটি Sample Page রয়েছে।
১৭ মার্চ করা প্রথম পোস্টের শিরোনাম White House International Debate Competition 2023 Results। অর্থাৎ, আলোচিত প্রতিযোগিতাটির ফলাফল এখনও এই সাইটে রয়েছে। যদিও রাকিবের পোস্টের ছবিতে দাবি করা হয়েছিল, ফলাফলটি সাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
পোস্টে গণমাধ্যমে উল্লিখিত তথ্যগুলোই পাওয়া যায়। পোস্টে রাকিব ছাড়াও আরও দুই ব্যক্তির (এর বাইরে আরও দুইজনের নাম ছিল। ২৮ মার্চের ফলাফল বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি জো বাইডেন, এবং বিশেষ অতিথি জেফ জিয়ান্টস হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বলে দাবি করা হয়েছে) নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। একজন রাশিয়ার হলান্ড লোপ মিশিগান (Holland Lop Michigan), যিনি ফাইনালের সেরা বক্তা নির্বাচিত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু কিওয়ার্ড সার্চ এমন কোনো ব্যক্তির নাম পাওয়া না গেলেও ফেসবুকে Holland Lop of Michigan নামে একটি প্রাইভেট গ্রুপের সন্ধান পাওয়া যায়।
অন্য ব্যক্তি লুই আন্ডারসন (Louie Anderson)। এই ব্যক্তির রেকর্ডই রাকিব ভেঙেছেন বলে দাবি করা হয়েছে। এই ব্যক্তির নাম কি ওয়ার্ড সার্চ করে আমরা একই নামে মার্কিন একজন কৌতুক অভিনেতা (যিনি ২০২২ সালে মারা যান) ভিন্ন আর কারো তথ্য খুঁজে পাইনি।
পরবর্তীতে, ২২ মার্চ ‘Preparing for Prize Ceremony’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত দ্বিতীয় পোস্টটির লিংকে প্রবেশ করার পর একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায় যেটি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণীর জন্য প্রস্তুতিমূলক বিশেষ বোর্ড মিটিংয়ের ছবি বলে দাবি করা হয়েছে
কিন্তু রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা যায়, ছবিটি ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বরের। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় University American College Skopje এর সপ্তম বার্ষিক বিতর্ক প্রতিযোগিতার ছবি এটি।
একই পোস্টে ২৮ মার্চ ৬ টি ক্যাটাগরিতে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
একইসাথে ঐ দিনের বোর্ড মিটিংয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। সিদ্ধান্তগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
১ম সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ইভেন্টের খবরগুলো অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (হোয়াইট হাউসের অফিসিয়াল সাইট www.whitehouse.gov উল্লেখ) ছাড়া অনলাইনে পাওয়া যাবে না। কিন্তু যেকোনো ওয়েবসাইটে থাকা মানেই সেটি অনলাইনেই থাকা বোঝায়। তাছাড়া এ বিষয়ে হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে কোনো তথ্যই নেই।
২য় সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, এই ওয়েবসাইটটি সাময়িক সময়ের প্রয়োজনে এই বছরের ইভেন্টের জন্য খোলা হয়েছে। কিন্তু হোয়াইট হাউস কর্তৃক এমন টেম্পোরারি ওয়েবসাইট খোলার নজির নেই যেটি কিনা ওয়ার্ডপ্রেসে তৈরি এবং সাইটে প্রবেশের সময়ই ভুয়ার সম্ভাবনা সংক্রান্ত সতর্কবার্তা দেওয়া হয়।
৩য় সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, সাইটটি ২৮ মার্চের পর মুছে দেওয়া হবে। যদিও আজ ০১ এপ্রিল এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত সাইট সক্রিয় রয়েছে।
৪র্থ সিদ্ধান্তে এসেছে, শুধু প্রতিযোগিতার বিতার্কিকরাই সাউথ কোর্ট অডিটরিয়ামের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে। কিন্তু অনুসন্ধানে আগেই পেয়েছি, এমন কোনো আয়োজন ২৮ মার্চ সাউথ কোর্ট অডিটরিয়ামেরল হয়নি যেখানে বাইডেন উপস্থিত ছিলেন।
৫ম এবং সর্বশেষ সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কেউ কোনো ছবি বা ভিডিও ধারণ করতে পারবেন না। ধারণ করলে বিতার্কিকরা সমস্যায় পড়বেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সচরাচর রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আয়োজিত কোনো প্রতিযোগিতায় ছবি বা ভিডিও ধারণের এমন কড়াকড়ি নজরে আসে না।
পোস্টের শেষে একটি ইমেইল দেওয়া হয়েছে যা হোয়াইট হাউস ওয়েবসাইটের ডোমেইন থেকে তৈরি নয় বরং এটি জিমেইল পরিষেবার মাধ্যমে তৈরি।
অর্থাৎ, একটি ওয়ার্ডপ্রেস সাইটে আলোচিত বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিষয়ে আপডেট দেওয়া হয়েছে। প্রতিযোগিতার বিস্তারিত বিবরণ বা নিয়মিত কোনো আপডেট ছাড়াই ১৭ মার্চ প্রতিযোগিতার ফলাফল এবং ২২ মার্চ পুরস্কার বিতরণীর প্রস্তুতি বিষয়ক দুইটি পোস্ট রয়েছে সাইটটিতে। পুরস্কার বিতরণীর প্রস্তুতি সভার যে ছবি রয়েছে একটি পোস্টে সেটি মূলত ২০১৮ সালের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক প্রতিযোগিতার ছবি। তাছাড়া, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ছবি/ভিডিও ধারণ করা যাবে না, অনলাইনে এ বিষয়ে নিউজ পাওয়া যাবে না শীর্ষক নানা সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে যা স্পষ্টই প্রমাণ করে এটি একটি ভুয়া প্রতিযোগিতা।
মূলত, সম্প্রতি দেশের একাধিক গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে আয়োজিত একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় রংপুরের শাহ মুহাম্মদ রাকিব হাসান নামে এক স্কুল শিক্ষার্থী সেরা বিতার্কিক হয়েছেন শীর্ষক দাবির প্রেক্ষিতে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, হোয়াইট হাউস সম্প্রতি এমন কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি এবং এ বিষয়ে হোয়াইট হাউস বা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি। হোয়াইট হাউসের ডোমেইনের সাথে মিল রেখে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে ভুয়া প্রতিযোগিতার বিষয়টি ছড়ানো হয়েছে। রাকিব তার ফেসবুক পোস্টে প্রতিযোগিতার লিগ্যাল ডকুমেন্টস দাবিতে যে ছবিগুলো দিয়েছেন তাতে দুইজন মার্কিন কর্মকর্তার জাল স্বাক্ষরের প্রমাণ মিলেছে। তাছাড়া, রাকিব দুইটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জড়িয়ে ভুয়া খবরের স্ক্রিনশট পোস্ট করেছেন। এমনকি এই কথিত আয়োজনের পুরস্কার বিতরণীর প্রস্তুতি সভার একটি ছবি রয়েছে ভুয়া সাইটটিতে, যেটি মূলত ২০১৮ সালের বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক প্রতিযোগিতার ছবি।
সুতরাং, হোয়াইট হাউসের নাম ব্যবহার করে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি রাকিবের সাফল্যের যে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে; তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Shah Muhammad Rakib Hasan: Facebook Account
- Factbase: Joe Biden 28 March Schedule
- Rumor Scanner’s own analysis
- White House: Briefing Room
- White House: Press Briefing
- Newspaper clipping generator: fodey