শুক্রবার, অক্টোবর 4, 2024
spot_img

প্রিবাঙ্কিং; গুজব প্রতিরোধের পূর্ব প্রস্তুতি

সারা পৃথিবীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে ভুলতথ্য, মিথ্যাতথ্য, অপতথ্যসহ নানাবিধ নেতিবাচক তথ্যের প্রবাহ। বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভুলতথ্যের সতত্যা যাচাই করছে ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো। কিছুক্ষেত্রে যাচাই করার পূর্বেই তা প্রভাব ফেলছে সামাজিক জীবনযাত্রায়। যত দ্রুত এসকল তথ্য যাচাই করা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার চেয়েও দ্রুততম সময়ে তথ্যটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারে। এ কারণেই কোনো ঘটনা কিংবা দিবস কিংবা ইভেন্টকে ঘিরে সম্ভাব্য ধারণা অনুযায়ী গুজব ছড়ানোর পূর্বেই তা নিয়ে সতর্ক করার প্রক্রিয়া এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

Image Source- pixabay

গুজব ছড়ানোর পূর্বেই সে সম্পর্কে সতর্ক হওয়া

গুজব রোধের সবচেয়ে সাধারণ কৌশল হল সত্য-নিরীক্ষা করা এবং মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্যকে যাচাই করা। কিন্তু গুগল এর জিগস’ ল্যাবরেটরির সাথে অংশীদারিত্বমূলক এক প্রকল্পে ডক্টর জন রুজেনবিক এবং তার সহকর্মীদের এক সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী তারা পরামর্শ দেন যে ‘প্রিবাঙ্কিং’ আরও কার্যকর হতে পারে। বিশেষত, এই গবেষণা দলটি ভুল তথ্য ছড়ানোর আগেই তা রোধ করার জন্য ব্যবহারকারীদের “সতর্ক করার” করার প্রক্রিয়া উল্লেখ করেন।

Image Source- firstdraftnews

প্রিবাঙ্কিং কী

প্রিবাঙ্কিং শব্দটি “প্রি” এবং “ডিবাঙ্কিং” শব্দদ্বয় থেকে এসেছে। ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার একটি সর্বোত্তম পন্থা হল মানুষেরা ভুল তথ্যটি দেখার আগেই তাদেরকে এটি সম্পর্কে সতর্ক করা। একে “প্রিবাঙ্কিং” বা “ইনোকুলেশন”- ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে টিকা” বলা হয়। মোদ্দাকথা; কোনো ঘটনা, উপলক্ষ কিংবা সিচুয়েশনকে কেন্দ্র করে আইডিয়া ভিত্তিক ভুল তথ্যের কন্টেক্সট ও প্যাটার্ন সম্পর্কে জানিয়ে আগাম সতর্কবার্তা দেয়াকে প্রিবাঙ্কিং বলে।

Image Source- nbcnews

সাইকোলজিক্যাল ভ্যাকসিন

প্রিবাঙ্কিং প্রক্রিয়াকে সাইকোলজিক্যাল ইনোকুলেশন বা সাইকোলজিক্যাল ভ্যাকসিনও বলা হয়। কোনো রোগ ছড়ানোর পূর্বেই যেমন ভ্যাকসিন দেয়া হয়, যেন রোগটি ছড়াতে না পারে। তেমনি প্রিবাঙ্কিং প্রক্রিয়াও গুজব ছড়ানোর পুর্বেই সেই ধরণের গুজব প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। 

মনস্তাত্ত্বিক ইনোকুলেশনের ধারণাটি উইলিয়াম ম্যাকগুয়ার ৬০ বছর আগে প্রস্তাব করেছিলেন। এই ধারণাটিকে “ব্রেনওয়াশের ভ্যাকসিন”-ও বলা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে এই ধারণাটি মেডিকেল ইনোকুলেশনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে মানুষের কাছে ভুল তথ্যের স্বরূপ উন্মোচিত করা হয় এবং ব্যক্তির দ্বারা প্রমাণ মূল্যায়ন ও পাল্টা যুক্তি দেয়ার সক্ষমতা তৈরি করা হয়৷ ফলে সে ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।

Image Source- poynter

যেভাবে গুজব ছড়ানোর পূর্বেই সতর্ক করা যায়

দুর্ভাগ্যবশত, প্রিবাঙ্কিং প্রক্রিয়াটি খুব একটা সহজ নয়। “সাবধান, আপনি আজ কিছু ভুল তথ্য দেখতে যাচ্ছেন” এরকম করে বলা কঠিন। প্রিবাঙ্কিং এর ক্ষেত্রে আপনাকে উদাহরণ দিতে হবে। কেন লোকজন ঘটনা/ উপলক্ষ কিংবা সিচুয়েশন-টি সম্পর্কে মিথ্যা বলবে; তাও বুঝিয়ে বলতে হবে। কোনো ঘটনা বা সিচুয়েশনে প্রিবাঙ্কিং যেভাবে করা যেতে পারেঃ

  • কোন মিথ্যা তথ্যটি প্রিবাঙ্কিং করবেন তা যাচাই করা- একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক ধরণের মিথা কিংবা ভুল তথ্য ছড়াতে পারে। কিছু কিছু তথ্য খুবই দ্রুত পাঠক কর্তৃক গ্রহণযোগ্য হতে পারে এবং অন্য তথ্যের চেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে। তাই এমন তথ্য বাছাই করতে হবে যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি হতে পারে।
  • দর্শক এবং পাঠকের প্রবণতা ও সক্ষমতা বোঝা- আপনার দর্শক, বন্ধু, পারিপাশ্বিক লোকজন কিংবা পাঠকের প্রবণতা এবং সক্ষমতা বোঝা কিংবা জানা দরকার। আপনার সামাজিক নেটওয়ার্কের লোকেরা (অনলাইন এবং অফলাই উভয়ই) যদি গণমাধ্যম সক্ষমতা কিংবা ডিজিটাল সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা রাখে তাহলে প্রাথমিক ধরণের ভুল তথ্য তাদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব রাখবেনা। যতটা প্রভাব রাখবে একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে (ডিজিটাল সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা রাখেনা)।
  • ট্রুথ স্যান্ডউইচ” তৈরি করা-  প্রথমে ফ্যাক্টস বা মূল তথ্য উল্লেখ করুন, এরপর কি ভুল তথ্য ছড়াতে পারে সেটা জানান। তারপর কেন এই বিষয়টি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ছড়াবে তা যুক্তিসহ উল্লেখ করুন, সর্বশেষ আরও একটি ফ্যাক্টস (অতিরিক্ত তথ্যসূত্র) দিয়ে শেষ করুন।
Image Source- firstdraftnews

ট্রুথ স্যান্ডউইচ

স্যান্ডউইচের বিন-প্যাটি-বিন লেয়ারের মত প্রিবাঙ্কিং এর ক্ষেত্রেও কয়েকটি লেয়ারে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় তাই এ পদ্ধতিকে “ট্রুথ স্যান্ডউইচ” বলা হয়। এই ধারণাটি ভাষাবিদ জর্জ ল্যাকফ তৈরি করেছিলেন, এবং “ট্রুথ স্যান্ডউইচ” নামটি দিয়েছিলেন সিএনএন-এর ব্রায়ান স্টেলটার। ট্রুথ স্যান্ডউইচ চারটি ধাপ রয়েছে। যেমনঃ

  • ফ্যাক্ট বা সত্যতা।
  • মিসইনফরমেশন বা যে ভুল তথ্যটি ছড়াতে পারে।
  • লজিক বা কেন এই তথ্যটি ছড়াতে পারে; কারণ ব্যখ্যা করা।
  • সেকেন্ড ফ্যাক্ট বা অতিরিক্ত তথ্যসূত্র।
Image Source- istockphoto

কেন প্রিবাঙ্কিং ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সর্বোত্তম উপায়

প্রিবাঙ্কিং ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সর্বোত্তম উপায়, কেননা এর মাধ্যমে ভুল তথ্যের প্রভাবকে কমিয়ে আনা সম্ভব। ফ্যাক্ট-চেকিং এবং ডিবাঙ্কিং করার আগেও অনেক ভলতথ্যের প্রভাব বাস্তবায়িত হয়ে যেতে পারে। কারণ, ভুলতথ্য ইন্টারনেটে অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভুলতথ্য ছড়ানোর গতির সাথে সবসময়-ই যে সমান্তরাল সময়ে তথা প্রভাব বিস্তারের পূর্বেই ডিবাঙ্কিং করা যাবে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এমনকি, ফ্যাক্ট-চেকিং এবং ডিবাঙ্কিং প্রক্রিয়া ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথেষ্টও নয়। ফলে প্রিবাঙ্কিং ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সর্বোত্তম উপায় বলা যায়।

Image Source- bigthink

যে কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্ট-চেকিং এবং ডিবাঙ্কিং প্রক্রিয়া ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথেষ্ট নয়

  • নিবন্ধের সীমাবদ্ধতাঃ ফেসবুক, ইউটিউব (সীমিত), টিকটক, টুইটারের থার্ড পার্টি ফ্যাক্ট-চেক প্রক্রিয়ায় একটি ফ্যাক্ট-চেক নিবন্ধ তৈরির করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো শর্ত প্রয়োজন। যেমন, ভুল তথ্যটি সম্পর্কে যথেষ্ট কন্টেন্ট থাকা। কিন্তু প্রিবাঙ্কিং এর ক্ষেত্রে এ জাতীয় কোনো শর্ত বাঁধা হতে পারেনা। শুধুমাত্র একটি কন্টেন্ট এর ক্ষেত্রেও প্রিবাঙ্কিং কাজ করে। 
  • কন্টেন্টের ধরণগত সীমাবদ্ধতাঃ মিম, সার্কাজম কিংবা এ জাতীয় ফ্যাক্ট-চেক যোগ্য নয় এমন কন্টেন্টের ক্ষেত্রে ফ্যাক্ট-চেকিং করা হয়না (যদিও সম্প্রতি কিছু প্রতিষ্ঠান মিম টপিক ফ্যাক্ট-চেকিং করা শুরু করেছে)। কিন্তু ব্যবহারকারীদের মধ্যে যিনি ডিজিটাল লিটারেসি সমৃদ্ধ নন, মিম সম্পর্কে ধারণা রাখেন না কিংবা মিম বা সার্কাজম পোস্টের টপিকটি সম্পর্কে অবগত নন অথবা তিনি মিম কিংবা সার্কাজমকে সত্য হিসেবে ভেবে নিতে পারেন। এই সত্য ভাবার ফলে প্রভাব প্রতিফলিত হতে পারে। কিন্তু মিম, সার্কাজম সহ প্রায় সব ধরণের কন্টেন্টের ক্ষেত্রেই প্রিবাঙ্কিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করা সম্ভব।
  • এক্সেসজনিত সীমাবদ্ধতাঃ অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফ্রেন্ডস অনলি কন্টেন্টের (মিসইনফরমেশন) ক্ষেত্রে সে-সকল কন্টেন্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনা ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু পোস্টকারীর বন্ধুতালিকায় এই ধরণের মিসইনফরমেশনের প্রভাব প্রতিফলিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এই সকল ক্ষেত্রে প্রিবাঙ্কিং প্রক্রিয়া গুজব প্রতিরোধের একমাত্র সমাধান হতে পারে।
  • সময়ের সীমাবদ্ধতাঃ প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্ট-চেকিং এর ক্ষেত্রে প্রথমে তথ্যকে সন্দেহ করে তা প্রাথমিক রিসার্চ শেষে ভুল তথ্য হিসেবে শনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে অতিরিক্ত রিসার্চ সম্পন্ন করে সেই ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা অনুযায়ী নিবন্ধ প্রস্তুত করা হয়। এরপরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব ভুল তথ্যের প্রচার সীমিত করা হয়। কিন্তু এই সময়টার মধ্যেই অনেক ক্ষেত্রে ভুল তথ্যের প্রভাব প্রতিফলিত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রিবাঙ্কিং এর ক্ষেত্রে ভুল তথ্যটি ছড়ানোর আগেই তা সম্পর্কে মানুষ সতর্ক থাকে এবং তথ্যটিকে গুজব হিসেবে শনাক্ত করতে পারে। ফলে ভুলতথ্যটি আর বৃহৎ পরিসরে ছড়ানোর-ই সুযোগ থাকেনা।
  • মস্তিস্কের তথ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার কারণেঃ মস্তিষ্ক একই তথ্য নতুন করে পেলে আগের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে একধরনের গড়পড়তা তথ্য সংরক্ষণ করে। অর্থাৎ, প্রথম পাওয়া তথ্যটি একটি গুরুত্ব বহন করে। স্বাভাবিকভাবে মস্তিষ্ক বেশিরভাগ তথ্যকে সঠিক হিসাবে গ্রহণ করে। ফলে গুজব জেনে পরবর্তীতে আসল সত্যতা জানার চেয়ে আগে সত্য তথ্য সম্পর্কে জানানোর প্রভাব বেশি ফলপ্রসু হয়ে থাকে।
Image Source- istockphoto

সুতরাং, প্রিবাঙ্কিং শব্দটি “প্রি” এবং “ডিবাঙ্কিং” শব্দদ্বয় থেকে এসেছে। কোনো ঘটনা, উপলক্ষ কিংবা সিচুয়েশনকে কেন্দ্র করে আইডিয়া ভিত্তিক ভুল তথ্যের কন্টেক্সট ও প্যাটার্ন সম্পর্কে জানিয়ে  আগাম সতর্কবার্তা দেয়াকে প্রিবাঙ্কিং বলে। প্রিবাঙ্কিং প্রক্রিয়াকে সাইকোলজিক্যাল ইনোকুলেশন বা সাইকোলজিক্যাল ভ্যাকসিনও বলা হয়। প্রিবাঙ্কিং প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার পদ্ধতিকে “ট্রুথ স্যান্ডউইচ” বলা হয়। প্রথমে ফ্যাক্টস বা মূল সত্য তথ্য, এরপর কি ভুলতথ্য ছড়াতে পারে সেটা জানিয়ে কেন এই বিষয়টি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ছড়াবে তা যুক্তিসহ উল্লেখ করা এবং সর্বশেষ আরও একটি অতিরিক্ত তথ্যসূত্র দিয়ে প্রিবাঙ্কিং পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়।

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img