মেডিকেলে প্রথম হওয়া তানজিম সর্বার নামে ফেসবুকে একাধিক ভুয়া অ্যাকাউন্টে বিভ্রান্তি 

গত ০৯ ফেব্রুয়ারি এমবিবিএস ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর জানা যায়, তানজিম মুনতাকা সর্বা নামের একজন শিক্ষার্থী প্রথম হয়েছেন। তিনি রাজধানীর হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। সেদিনই গণমাধ্যমে বিষয়টি ফলাও করে প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। আমরা এ সংক্রান্ত সংবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকি৷ 

সেদিন বিকেল ৪ টা ২০ মিনিটে মূল ধারার সংবাদমাধ্যম ‘এনটিভি’র ওয়েবসাইটে সর্বার বিষয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, “তানজিম মুনতাকা ফেসবুকে এক পোস্টে লেখেন, ‘আমি কখনও ভাবিনি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাব। আল্লাহর সব ইচ্ছে!’ ওই পোস্টে তিনি আরও লেখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, অনেক কষ্ট করেছি, কেঁদেছি। আজকে সব কান্না শেষ! অনেক কষ্ট করেছেন আমার বাবা মা। আজকে আমার কান্না পাচ্ছে ঠিক তাদের জন্যই। আমি আজকে ধন্য, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ!’”

তানজিম সর্বার
Screenshot: NTV

সর্বা কর্তৃক ফেসবুকে করা মন্তব্য দাবিতে পরবর্তীতে দেশের একাধিক গণমাধ্যমে একই মন্তব্য প্রকাশ হতে থাকে। গণমাধ্যমগুলোর তালিকায় রয়েছে ভোরের কাগজ, নয়া দিগন্ত, দেশ রূপান্তর, কালবেলা, মানবকণ্ঠ, রাইজিং বিডি, বাংলাদেশ মোমেন্টস, জুম বাংলা। 

আমরা এই মন্তব্যটি সর্বা ফেসবুকে করেছেন কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে শুরুতে কিওয়ার্ড সার্চ করে সর্বার নামে চালু থাকা অন্তত ১১ টি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট (, , , , , , , , , ১০, ১১) এবং অন্তত ০৯ টি ফেসবুক পেজের (, , , , , , , , ) খোঁজ পেয়েছি। 

এসব পেজ এবং অ্যাকাউন্টের মধ্যে বাংলায় ‘তানজিম মুনতাকা সর্বা’ নামের একটি পেজে সেদিন (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ৩ টা ১৩ মিনিটে প্রকাশিত একটি পোস্টের (আর্কাইভ) সন্ধান পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷

সেদিন বিকেল ৪ টা ২০ মিনিটে প্রকাশিত এনটিভির ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনে উল্লিখিত সর্বার কথিত ফেসবুক পোস্টের সাথে এই পোস্টের সাথে হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে। 

Screenshot: Facebook 

আমরা পেজটি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, পেজটির About সেকশনে এটি সর্বার আসল পেজ বলে দাবি করা হচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে, পেজটি সেদিনই খোলা হয়েছে এবং সেদিন দুপুর ৩ টা ১১ মিনিটে পেজে প্রথম পোস্ট করা হয় একটি প্রোফাইল ছবি যাতে রেটিনা নামে একটি মেডিকেল কোচিংয়ের ব্যানারে সর্বার ছবি দেখা যাচ্ছে। একটি পোস্টে গত ১২ ফেব্রুয়ারি পেজটি থেকে দাবি করা হয়েছে, তাকে অনেকেই এসএমএস করছেন। এজন্য তিনি লাইভে আসবেন। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত এই পেজ থেকে কোনো লাইভ ভিডিও পাওয়া যায়নি।  

আমরা পেজটি সর্বার কিনা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে তার সাথে কথা বলেছি। সর্বা আমাদের জানিয়েছেন, ফেসবুকে তার কোনো পেজ নেই। তিনি তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে এমন কিছু পোস্টও করেননি।

কথিত মন্তব্যটির বিষয়ে সর্বা জানিয়েছেন, তিনি এমন মন্তব্য ফেসবুকে না করলেও সাক্ষাৎকারে বলেছেন। সর্বা জানালেন, “তবে এখানে যেভাবে কান্নার কথা বলা হয়েছে, ওটা আমি কোনো সাক্ষাৎকারে বলিনি।” 

অর্থাৎ, পোস্টটি যে পেজ থেকে প্রকাশিত হয়েছে সেটি সর্বার নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো পেজ নয়। 

সর্বা যেহেতু বলছেন যে তিনি সাক্ষাৎকারে সমজাতীয় মন্তব্য করেছেন, আমরা তাই সেদিন এনটিভির প্রতিবেদনটি প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন কোচিংয়ের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত সর্বার বক্তব্য সম্বলিত ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। তিনি সেদিন ডিএমসি স্কলার কোচিংয়ের লাইভে (দুপুর ০২ টা ৫৭ মিনিটে), রেটিনা কোচিংয়ের পেজের ভিডিওতে (দুপুর ৩ তা ২২ মিনিটে), উন্মেষ কোচিংয়ের লাইভে (দুপুর ৩টা ৩১ মিনিটে), রেটিনা কোচিংয়ের লাইভে (বিকেল ০৪ টা ১২ মিনিটে) সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এসব স্বাক্ষাৎকারের কোনো অংশেই সর্বার নামে প্রচারিত কথিত মন্তব্যটির হুবহু মিল পাওয়া যায়নি। 

অর্থাৎ, এটা নিশ্চিত যে, ফেসবুকে ভুয়া একটি পেজের মন্তব্যকে সর্বার বাস্তব মন্তব্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে। 

রিউমর স্ক্যানার টিম তানজিম মুনতাকা সর্বা পরিচালিত একমাত্র অ্যাকাউন্টটির সন্ধান পেয়েছে। এই অ্যাকাউন্টটি ফলাফল প্রকাশের দিন এবং তার পরদিনও লকড অবস্থায় থাকলেও এখন পাবলিক প্রাইভেসি দিয়েছেন তিনি। 

সর্বা যেহেতু বলছেন যে তার কোনো পেজ নেই ফেসবু্কে এবং তার আসল অ্যাকাউন্ট একটিই সেহেতু আমরা এর বাইরে তার নামে চালু থাকা যেসব অ্যাকাউন্ট এবং পেজের খোঁজ পেয়েছি তা ভুয়া বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আমরা উক্ত অ্যাকাউন্ট এবং পেজগুলোর এক্টিভিটি বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করেছি। 

ভুয়া যে অ্যাকাউন্টগুলোর খোঁজ আমরা পেয়েছি তার সবগুলোতেই সর্বার ছবি প্রোফাইলে রয়েছে। এর মধ্যে ০৬ টি অ্যাকাউন্ট (, , , , , ) লকড অবস্থায় থাকায় এদের এক্টিভিটি যাচাই করা যায়নি। 

তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, আমরা সর্বার নামে চালু থাকা এমন এক অ্যাকাউন্টের (Tanzim Sorba) খোঁজ পেয়েছি যা থেকে  খ্রিস্টান ভিত্তিক একটি গ্রুপে পোস্ট করা হচ্ছিল। “যীশু ডাকেন তোমায় (Jesus calls you)” নামের একটি গ্রুপে সর্বা নামধারী এই অ্যাকাউন্টটি যুক্ত হয়েছে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর। ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত গ্রুপটিতে এই অ্যাকাউন্ট থেকে ০৬ টি (, , , , , ) পোস্ট করা হয়েছে।

Screenshot collage: Rumor Scanner 

আমরা উক্ত গ্রুপে প্রকাশিত এই অ্যাকাউন্টটির পোস্টগুলোর কমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখেছি, সর্বা নামধারী ব্যক্তিকে Manik Murmu নামে মেনশন করছেন অনেকে। এই নামটির উপর ক্লিক করার পর এটি আলোচিত অ্যাকাউন্টে নিয়ে যাচ্ছে। এটি থেকে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে, এই অ্যাকাউন্টের নাম পূর্বে Manik Murmu ছিল। 

সর্বার নামে খোলা আরেকটি অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে যাতে ১১ ফেব্রুয়ারিই প্রথম পোস্ট পাওয়া যাচ্ছে৷ দীর্ঘ এই পোস্টে নিজেকে সর্বা দাবি করে তিনি লিখেছেন, “আমি তানজিম মুনতাকা শর্বা, মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ২০২৩-২৪ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় জাতীয় মেধায় ১ম স্থান অর্জন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। আমার এই সাফল্যের পেছনে সর্বপ্রথম আমার মা-বাবা, আমার শিক্ষকদের দোয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।” এরপর জুনিয়রদের উদ্দেশ্যে নানা পরামর্শ দিতে দেখা যায় এই পোস্টে। 

নিজেকে সর্বা দাবি করে পোস্ট করেছেন এমন আরো একটি অ্যাকাউন্টও পাওয়া যাচ্ছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি করা এই অ্যাকাউন্টের পোস্টে তিনি এও দাবি করেন যে, তার এই অ্যাকাউন্ট বাদে আর কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। 

Screenshot: Facebook’s  

তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৭ হাজার ৮০০ ফলোয়ার সমৃদ্ধ একটি অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার যা কিনা এ বছরের ৩০ জানুয়ারি চালু করা হয়৷ নিজেকে সর্বা দাবি করে কতিপয় (, ) পোস্টে নিজের পড়াশোনা এবং এমবিবিএস ভর্তির ফলাফল নিয়ে কথা বলেছেন এই ব্যক্তি। তবে ভুয়া অ্যাকাউন্টের About সেকশনে কলেজের নাম ভুল বানানে (Holicrose) উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। 

রিউমর স্ক্যানার টিম তানজিম মুনতাকা সর্বার নাম ব্যবহার করে অন্তত যে নয়টি পেজ চালু থাকার প্রমাণ পেয়েছে তার মধ্যে একটি পেজকে খুবই চতুরতার সাথে নিজেকে সর্বা প্রমাণের চেষ্টা দেখেছি আমরা। পেজটি ২০২২ সালের ০৬ এপ্রিল যখন খোলা হয় তখন নাম ছিল Sumaiya Muslem Mim। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আরও ছয় বার ভিন্ন ভিন্ন নামে পেজটি পরিচালিত হয়েছে। সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি পেজটির নাম দেওয়া হয় Tanzim Muntaka Sorba। অন্যান্য অ্যাকাউন্ট এবং পেজের মতো এই পেজেও সর্বা সংক্রান্ত এক্টিভিটি লক্ষ্য করা যায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকেই। তবে আমরা পেজটি পর্যবেক্ষণ করে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি পোস্টে (আর্কাইভ) সর্বার ছবি পেয়েছি। সন্দেহ হওয়ায় পোস্টের এডিট হিস্টোরি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেসময় সর্বার ছবি ছিল না এই পোস্টে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ছবিটি যুক্ত করা হয়েছে।

Screenshot collage: Rumor Scanner 

নিজেকে সর্বা দাবি করে পোস্ট করেছেন এমন আরো একটি পেজও কিওয়ার্ড সার্চে এসেছে। এই পেজটি গত ১১ ফেব্রুয়ারি খুলে সেদিনই এক পোস্টে পেজ এডমিন দাবি করেন, তিনিই তানজিম সর্বা এবং তার আগে কোনো অ্যাকাউন্ট ছিল না। ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় তার মনে হয়েছে, এখন অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। তাই তিনি এটি চালু করেছেন। 

Screenshot: Facebook 

একই নামে আরো একটি পেজ থেকেও উক্ত পেজকে সর্বার আসল পেজ বলে দাবি করা হয়েছে। 

Screenshot: Facebook 

সর্বার নামে বাকি যে পেজগুলোর খোঁজ পাওয়া গেছে তার মধ্যে অন্তত চারটি পেজ (, , , ) ফলাফল প্রকাশের দিন (১১ ফেব্রুয়ারি) খোলা হয়েছে। অন্য একটি পেজ ২২ জানুয়ারি খোলার দিন নাম ছিল ‘আমি শিঙ্গেল’, পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি নাম দেওয়া হয়েছে Tanzim Muntaka Sorba।

শুধু ভুয়া অ্যাকাউন্ট বা পেজ খোলার মাধ্যমেই তানজিম মুনতাকা সর্বার নামে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে না, ইতোমধ্যে তার বিষয়ে একটি গুজবও প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। গত ১১ ফেব্রুয়ারি এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন সর্বা’র দৈনিক রুটিন দাবিতে একটি রুটিনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।

Screenshot: Facebook

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই রুটিনটি যশোর মেডিকেলের সাবেক শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে ডাক্তার ইমরান হোসেন শোভন এইচএসসি ২০২১ ব্যাচের জন্য সে বছরই ফেসবুকে আপলোড করেন যা তানজিম মুনতাকা সর্বার রুটিন দাবিতে প্রচার হচ্ছে। তবে সর্বা ২০২১ নয়, এইচএসসি ২০২৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী। সর্বা এইচএসসিতে চলতি বছর সাধারণ গ্রেডে বৃত্তিও পেয়েছেন। 

রিউমর স্ক্যানার টিমের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রায় প্রতিবছরই এমবিবিএসসহ বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থানে থাকা শিক্ষার্থীদের নাম এবং ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে একাধিক অ্যাকাউন্ট এবং পেজ খোলা হয়। এসব পেজ এবং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে যেসব কার্যক্রম চালানো হয় তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কার্যক্রম বলেই মনে করে নেটিজেনরা। এতে করে উক্ত ব্যক্তি বিপত্তিতে পড়েন, কখনো কখনো উক্ত অ্যাকাউন্ট বা পেজের মাধ্যমে প্রতারণার শিকারও হন অনেকে। এক্ষেত্রে তাই সচেতন থাকা জরুরি। 

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img