গত ১৪ এপ্রিল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে “জাফর ইকবাল স্যারের কুকৃতি” শীর্ষক ক্যাপশন ব্যবহার করে লাইভে (আর্কাইভ) আসেন নিজেকে নবম-দশম শ্রেণির রসায়ন পাঠ্যবইয়ের লেখক দাবি করা বিদ্যুৎ কুমার রায়।
বিদ্যুৎ কুমার রায় বলছেন, “আজকে আমি এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার কেমিস্ট্রি (রসায়ন) বইয়ের লেখক কে? সে বলে, জাফর ইকবাল। খুব কষ্ট লাগলো। বই লিখসি আমি, জাফর ইকবাল স্যার এক লাইনও লেখে নাই৷ অথচ জাফর ইকবাল স্যার আমার এই ভালো বইটা তার নাম দিয়ে একদম পপুলার হয়ে গেল। খুব কষ্ট লাগে।”
জনাব বিদ্যুৎ কুমার রায় জানান, জাফর ইকবাল স্যার কমিটিতে ছিল। স্যারকে বলছিলাম, স্যার, আপনি নাম, মোবাইল নাম্বার সবকিছু বইয়ে লিখে দেন। যাতে বই পড়ে কোনো ছাত্র যদি কোনো জায়গায় সমস্যা হয় তাহলে যেন সরাসরি একদম মোবাইল নাম্বার দিয়ে কথা বলতে পারে। অনেক ছাত্রদের অনেক সমস্যা, বইয়ে অনেক ত্রুটি থাকে, বিভিন্ন ঝামেলা থাকে। জাফর ইকবাল স্যার বলেন, না এগুলো লেখার দরকার নাই। একটা জ্ঞান দিবো আমি। আমার মোবাইল নাম্বার দিতে চাইলাম। জাফর ইকবাল স্যার দিতে দেয় নাই। আমি বললাম, আমি ভাষানটেক সরকারি কলেজে আছি। আপনি কলেজের নাম লিখে দেন। কিন্তু তিনি বললেন, না বোর্ড দেয় না। আমি বললাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন আপনাকে দিয়ে বলছে বই লেখার কথা, তখন কক্সবাজারে শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষা মন্ত্রী আপনাকে দায়িত্ব দিসিলো পুরো বইটাকে নতুন করে গরীব অসহায় মানুষের জন্য দেওয়া। কিন্তু স্যার, আপনি যদি না করেন তাহলে কী হবে? যাহোক জাফর ইকবাল স্যার করে নাই। আমার লেখা বই। আমার নাম হয় না। জাফর ইকবাল স্যারের নামে হয়। আমার খুব কষ্ট লাগে। এটা কখনোই ভালো কাজ হতে পারে না। এটা কুকীর্তির শামিল।”
লাইভ ভিডিওটি ডাউনলোড করে পরবর্তীতে তিনি আবার পোস্ট করেন এবং এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাসও দেন।
বিদ্যুৎ কুমার রায় কর্তৃক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিষয়ে অভিযোগ এনে করা পোস্টগুলোর কমেন্টেও তিনি জাফর ইকবাল বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেন।
তার কিছু নমুনা দেখুন স্ক্রিনশটে-
উক্ত লাইভটি পরবর্তীতে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীই ডাউনলোড করে পোস্ট করেছেন। দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
গত ২১ এপ্রিল ‘ফেস দ্য পিপল’ নামে একটি ফেসবুক পেজের লাইভ অনুষ্ঠানে (আর্কাইভ) বিদ্যুৎ কুমার রায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সেখানে তার অভিযোগগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
এ সংক্রান্ত বিদ্যুৎ কুমার রায়ের অভিযোগগুলোর বিষয়ে নিশ্চিত হতে আমরা তার সাথে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের সুনির্দিষ্ট চারটি অভিযোগ জানান।
প্রথম অভিযোগ হচ্ছে, বইটির লেখক হিসেবে তিনি প্রাপ্য সম্মান পাননি। রসায়ন বইতে লেখক এবং সম্পাদনসহ বই সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত সকলের নাম একসাথে থাকায় লেখক হিসেবে তার নাম আলাদাভাবে হাইলাইট হয়নি।
জনাব বিদ্যুৎ কুমার রায়ের দ্বিতীয় অভিযোগ, লেখক হিসেবে তার নামের সাথে তার কলেজের নাম এবং ফোন নম্বরও যুক্ত করতে বলেছিলেন জাফর ইকবালকে। কিন্তু তিনি তাতে সাড়া দেননি।
তৃতীয় অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, রসায়ন বইটির লেখার দায়িত্ব একমাত্র তিনজনের ছিল, যেখানে জাফর ইকবালের নাম নেই। তবু রসায়ন বইয়ের লেখক হিসেবে জাফর ইকবালের নামই জেনে আসছে মানুষ। যা লেখক হিসেবে তাকে পীড়া দেয়।
সর্বশেষ অভিযোগে জনাব বিদ্যুৎ কুমার রায় জানান, রসায়ন বইয়ে যে ছবিগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো জাফর ইকবালের দেওয়া। কিন্তু ছবিগুলো বিষয়বস্তুর সাথে প্রাসঙ্গিক নয়। ছবিগুলো চূড়ান্ত হওয়ার পর তাকে দেখানো হয়নি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, রসায়ন বইটির সর্বশেষ পরিমার্জিত সংস্করণ বেরিয়েছে ২০১৭ সালে। ছয় বছর পর এসে তিনি অভিযোগ করছেন। সেটিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নয়, অভিযোগ উত্থাপন করেছেন ফেসবুকে।
আরও অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে, বই সংশ্লিষ্টদের নামের তালিকায় আলাদা করে লেখকদের কোনো নাম নেই। এ সংক্রান্ত পাতায় বইটিকে সহজপাঠ্য, আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করার জন্য পরিমার্জিত সংস্করণে প্রয়োজনীয় সংযোজন, পরিবর্ধন, পুনর্লিখন ও সম্পাদনার জন্য একটি দল কাজ করেছে। এই দলের শুরুতেই বিদ্যুৎ কুমার রায়ের নাম দেখা যাচ্ছে। তালিকার ৪র্থ নামটি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের।
তালিকায় প্রথমেই লেখক হিসেবে বিদ্যুৎ কুমার রায়ের নাম থাকায় তিনি হাইলাইট না হওয়া বিষয়ক যে অভিযোগটি করেছেন তা অবান্তর বলেই প্রতীয়মান হয়৷
বিদ্যুৎ কুমার রায় লেখক হিসেবে তার নামের সাথে তার কলেজের নাম এবং ফোন নম্বরও যুক্ত করতে বলেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের একাধিক সংস্করণের পাঠ্যবই রিউমর স্ক্যানার টিম যাচাই করে দেখেছে। কোনো বইতেই এমন রীতির প্রচলন নেই। এক্ষেত্রে তাই জাফর ইকবালকে এখানে ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করার সুযোগ নেই বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাথে কথা বলেছি আমরা।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “বইয়ের উন্নত সংস্করণের কাজে এডিটরদের কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কাজটাকে এগিয়ে নিতে হয়েছে৷ আমি এবং ড. কায়কোবাদ সে সময় বিজ্ঞান এবং গণিতের ছয়টি বইয়ের সম্পাদনায় ছিলাম। আমি আপনাকে এ বিষয়ে এনসিটিবির সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দিচ্ছি এবং একইসাথে যে নিয়মগুলো মানতে হয়েছে সেগুলোও খুঁজে বের করার অনুরোধ করছি। আমার এ বিষয়ে ব্যক্তিগত কোনো মতামত নেই।”
জাফর ইকবালের সাথে কথা বলার পর গত এপ্রিলের শেষ দিকে রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করি আমরা। অভিযোগগুলো তাকে দেখানোর পর তিনি জানান, “আমি এ বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি। মূল সমন্বয়কারীকে বিস্তারিত জানাতে বলেছি। আমি যতটুকু জেনেছি মূল লেখক সে (বিদ্যুৎ কুমার রায়) ছিলনা, বইটি সুখপাঠ্য করার সময়ে সে সাহায্য করেছে মাত্র।”
এ বিষয়ে ফলোআপ জানতে চেয়ে গত ২৮ মে ফের জনাব অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “রসায়ন বইটির মূল লেখক হিসেবে তিনি (বিদ্যুৎ কুমার রায়) কখনোই ছিলেন না। ২০১২ এর শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকটি ২০১৩ সালে প্রনয়ণ করা হয়েছে। তবে ২০১৭ সালে বইটি সুখপাঠ্য করা হয়। মোট ১২টি বই তখন সুখপাঠ্য করা হয়। সুখপাঠ্য করার সময় তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এমতাবস্থায় তার দাবীর যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি জাফর ইকবাল স্যার, সদস্য শিক্ষাক্রম বা অন্যরা আমলে নিচ্ছে না।”
জনাব বিদ্যুৎ কুমার রায় ইতোমধ্যেই তার এ সংক্রান্ত দুইটি ভিডিও এবং একটি স্ট্যাটাস ফেসবুক থেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
সুতরাং, সংশ্লিষ্ট সকলের বক্তব্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কুমার রায়ের অভিযোগগুলো আমলে নেওয়ার মতো কোনো ভিত্তি নেই বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
তথ্যসূত্র
- Class 9-10: Chemistry Book
- Statement from Biddut Kumer Ray
- Statement from Dr. Muhammed Zafar Iqbal
- Statement from Prof Md Farhadul Islam, Chairman, NCTB
- Rumor Scanner’s own analysis