বাংলাদেশের পাঠ্যবইগুলোতে ভুলের প্রবণতার বিষয়টি বেশ কয়েক বছর ধরেই সমালোচিত হয়ে আসছে। ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ বিষয়ে কাজ করার তাগিদ থেকে ২০২২ সালে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত ‘রিউমর স্ক্যানার’ পাঠ্যবইয়ে থাকা ভুলের বিষয়ে ফ্যাক্টচেক করা শুরু করে। বছরব্যাপী সর্বমোট তিনটি পাঠ্যবইয়ের (২০২২ সালে মুদ্রিত) ভুলের বিষয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। সেসব নিয়েই আজকের এই লেখা।
১. জিহ্বার বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ অনুভব করার দাবিটি মিথ্যা
“জিহ্বার বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ অনুভব করে” শীর্ষক একটি তথ্য বহু বছর ধরেই বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে প্রচার হয়ে আসছে।
২০২২ সালের ষষ্ঠ শ্রেণীর বিজ্ঞান বইয়ের ৪৬ পৃষ্ঠায় (দেখুন এখানে) এবং ২০২২ সালের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে গাজী আজমল ও গাজী আসমত রচিত জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র বইয়ের ১৪৬ পৃষ্ঠায় (দেখুন এখানে) একইরকম ভুল দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
তবে রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখেছে, জিহ্বার বিভিন্ন অংশে ভিন্ন স্বাদ অনুভর করার দাবিটি মিথ্যা।
এ বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, জার্মান বিজ্ঞানী ডেভিড পলি হানিগ ১৯০১ সালে এক প্রবন্ধে জানান, জিহ্বার স্বাদকোরকগুলোর সংবেদনশীলতা জিহ্বার বিভিন্ন অংশে পরিবর্তিত হয়। তবে এটি স্বাদের উপর নির্ভর করে এমন দাবি না করলেও তিনি যখন এই তথ্য গ্রাফের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন তখন এটি এমন বোঝা যাচ্ছিল যে, বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন স্বাদের সাথে জড়িত। এভাবেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে বহু বছর ধরে জিহ্বার একেক অংশ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ অনুভব করে বলে পাঠ্যবইয়ে প্রচার হয়ে আসছে। তবে একাধিক বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন, জিহ্বার বিভিন্ন অঞ্চল যে কোনও কিছুর স্বাদ নিতে পারলেও কিছু অংশ নির্দিষ্ট স্বাদের জন্য সামান্য বেশি সংবেদনশীল।
অর্থাৎ, জিহ্বার বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ গ্রহণ করার দাবিটি সঠিক নয় বরং জিহ্বার সব অংশই সকল রকম স্বাদ অনুভব করতে পারে।
২. নবম শ্রেণীর ব্যাকরণ: মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়ন ছিল না
“বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত সরকার ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়নের আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে” শীর্ষক একটি তথ্য বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রচার হয়ে আসছে।
মাধ্যমিকের ২০২২ সালের নবম-দশম শ্রেণীর ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ পাঠ্যবইয়ের ১৯৪ নাম্বার পৃষ্ঠায় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ নামক একটি প্রবন্ধে এমন তথ্যই (দেখুন এখানে) এসেছে।
একই তথ্য এসেছে ২০২২ সালের দাখিলের নবম-দশম শ্রেণীর ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ পাঠ্যবইয়ের ১৯৪ নাম্বার পৃষ্ঠাতেও (দেখুন এখানে)৷
তবে রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়ন থাকার দাবিটি মিথ্যা।
এ বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর সদর উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেয়। সেদিনই বৈদ্যনাথতলা বদলে স্থানটির নাম রাখা হয় মুজিবনগর। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণীর ব্যাকরণ পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বৈদ্যনাথতলাকে ইউনিয়ন দাবি করা হয়েছে।
অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়ন ছিল না বরং সে সময় এটি বাগোয়ান ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি গ্রাম ছিল।
৩. মহাকাশে স্পেস স্যুট ছাড়া মানবদেহ বিস্ফোরিত হওয়ার দাবিটি মিথ্যা
“মহাকাশে বাতাস নেই, তাই বাতাসের চাপও নেই, তাই সেখানে শরীরের ভেতরের চাপকে কাটাকাটি (প্রশমিত অর্থে) করার জন্য কিছু নেই এবং এ রকম পরিবেশে মুহূর্তের মাঝে মানুষের শরীর তার ভেতরকার চাপে বিস্ফোরিত হয়ে যেতে পারে৷” শীর্ষক একটি তথ্য বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রচার হয়ে আসছে।
নবম দশম শ্রেণীর ২০২২ সালের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ১৪৩ নাম্বার পৃষ্ঠায় উক্ত তথ্য এসেছে (দেখুন এখানে।)
তবে রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখেছে, মহাকাশের বায়ুহীন স্থানে কোনো স্পেস স্যুট ছাড়া মানুষ গেলে মুহুর্তেই মানবদেহ বিস্ফোরণ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা।
এ বিষয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে রিউমর স্ক্যানার জানিয়েছে, বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই তথ্য সঠিক নয় বলে মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে নাসার এলিমেন্ট সায়েন্টিস্ট ক্রিস লেনহার্টড রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “মহাকাশে স্পেসস্যুট ছাড়া আপনি বিস্ফোরিত হবেন না। তবে আপনার শরীরের তরল পানীয় গ্যাসে পরিবর্তিত হবে এবং সমস্ত ধরণের ক্ষতি করবে।”
অর্থাৎ, মহাকাশে কোনো স্পেস স্যুট ছাড়া মানুষের দেহ মুহূর্তের মাঝে বিস্ফোরিত হবে না বরং বাতাসের চাপের ভারসাম্যহীনতায় শ্বাস বন্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মানবদেহ ফুলে যাবে।
পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক উপাচার্য এবং শিক্ষাবিদ ড. আ.আ.ম.স. আরেফিন সিদ্দিক বলছেন, “পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকা বড় অপরাধ। এটায় অবহেলাই বড় কারণ।” রিউমর স্ক্যানার আশা করে, কোমলমতি শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে পাঠ্যবই থেকে সঠিক এবং স্বচ্ছ তথ্যটিই শিখবে, জানবে এবং জ্ঞানের জগতে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করবে। শিক্ষার্থীদের সেই সুযোগ করে দেওয়ার দায়িত্ব পাঠ্যবই তৈরি সংশ্লিষ্টদের। দায়িত্বশীলরা এক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে, এটাই কাম্য।