“জিহ্বার বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ অনুভব করে” শীর্ষক একটি তথ্য বহু বছর ধরেই গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনকি পাঠ্যবইয়েও প্রচার হয়ে আসছে।
গণমাধ্যমে উক্ত তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন দেখুন – কালের কন্ঠ (আর্কাইভ)।

ষষ্ঠ শ্রেণীর বিজ্ঞান বইয়ে (৪৬ পৃঃ) এ সম্পর্কিত তথ্য দেখুন – এখানে।
উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে গাজী আজমল ও গাজী আসমত রচিত জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র বইয়ে (১৪৬ পৃষ্ঠা) এ সম্পর্কিত তথ্য দেখুন – এখানে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন – এখানে, এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন – এখানে, এখানে।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, জিহ্বার বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ গ্রহণ করার দাবিটি সঠিক নয় বরং জিহ্বার সব অংশই সকল রকম স্বাদ অনুভব করতে পারে।
কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি‘র ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “জিহ্বার বিভিন্ন অঞ্চল যে কোনও কিছুর স্বাদ নিতে পারে।”
তবে জিহ্বার কিছু অংশ নির্দিষ্ট স্বাদের জন্য কিছুটা বেশি সংবেদনশীল উল্লেখ করে ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাদ এবং গন্ধ কেন্দ্রের সহযোগী পরিচালক স্টিভেন মুঙ্গেরের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, “এই পার্থক্য খুবই অল্প (minute)।”

স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট healthline ২০২০ সালের ১৫ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও একই তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ অনুভবের জন্য জিহ্বাতে আলাদা কোনো অংশে বিভক্তি করা নেই। তবে জিহ্বার কেন্দ্রের তুলনায়, জিহ্বার পার্শ্ববর্তী অংশগুলো প্রতিটি ধরণের স্বাদের জন্য আরও সংবেদনশীল।”

মার্কিন একাডেমিক চিকিৎসা কেন্দ্র Cleveland Clinic প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “একটি সাধারণ ভুল ধারণা রয়েছে যে জিহ্বার বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন জিনিসের স্বাদ পাওয়া যায়। বাস্তবে, আপনার সমস্ত স্বাদ কোরক-ই (taste bud) পাঁচটি স্বাদ সনাক্ত করার ক্ষমতা রাখে – আপনার জিহ্বার কিছু অংশ নির্দিষ্ট স্বাদের জন্য সামান্য বেশি সংবেদনশীল। “

২০০৫ সালে মার্কিন গবেষক ক্রিস্টিন স্কট (Kristin Scott) প্রকাশিত এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, “জিহ্বা স্পষ্টভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত নয় যা একচেটিয়াভাবে বিভিন্ন স্বাদকে চিনতে পারে।”
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে বহুল পঠিত একটি বই Ganong’s Review of Medical Physiology। এই বইটির ৪২৯ পৃষ্ঠায় টেস্ট বাড সংক্রান্ত আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, “সমস্ত স্বাদ জিহ্বার সমস্ত অংশ এবং সংলগ্ন কাঠামো থেকে অনুভূত হয়।”
তথ্যের সূত্রপাত যেভাবে
১৯০১ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ডেভিড পলি হানিগ (David Pauli Hanig) একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। মানুষের জিহ্বার বিভিন্ন অংশে নোনতা, মিষ্টি, টক এবং তেতো নমুনার ফোঁটা দিয়ে তিনি দেখেন যে স্বাদ কোরকগুলোর সংবেদনশীলতা জিহ্বার বিভিন্ন অংশে পরিবর্তিত হয়। বিবিসি বলছে, “তিনি জিহ্বার ডগা এবং প্রান্তগুলোকে সবচেয়ে সংবেদনশীল বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু তিনি দাবি করেননি যে এটি স্বাদের উপর নির্ভর করে। তবুও যখন তিনি এই তথ্যগুলোকে একটি গ্রাফে স্থানান্তর করেছিলেন, তখন ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন স্বাদের সাথে মিলে যায়।”
স্টিভেন মুঙ্গের বলছেন, “এটি তার (ডেভিড পলি হানিগ) পরিমাপের একটি সঠিক উপস্থাপনার চেয়ে শৈল্পিক ব্যাখ্যা ছিল। এবং এটি এমন দেখায় যে জিহ্বার বিভিন্ন অংশ ভিন্ন স্বাদের জন্য দায়ী, বরং জিহ্বার কিছু অংশ অন্যদের তুলনায় নির্দিষ্ট স্বাদের প্রতি কিছুটা বেশি সংবেদনশীল ছিল।
হানিগের প্রবন্ধের বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনাই পরবর্তীতে ভুল বার্তা হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে।

কীভাবে স্বাদ পাওয়া যায় জিহ্বায়?
মানুষ সাধারণত পাঁচ ধরনের স্বাদ অনুভব করতে পারে। এগুলো হলো মিষ্টি, টক, তেতো, নোনতা এবং উমামি বা সুস্বাদু। আমাদের জিহ্বায় হাজার হাজার ক্ষুদ্রাকৃতির বাম্প (bumps) রয়েছে যাকে স্বাদ প্যাপিলি (taste papillae) বলা হয়। প্রতিটি প্যাপিলায় ১০ থেকে ৫০ টি রিসেপ্টর কোষ সহ একাধিক স্বাদ কোরক (taste bud) থাকে। মুখের ছাদ বরাবর এবং গলার আস্তরণে স্বাদ গ্রহণকারী কোষ রয়েছে। আমরা যখন কিছু খাই, রিসেপ্টরগুলো খাবারের রাসায়নিক যৌগগুলোকে বিশ্লেষণ করে। এরপরে, তারা মস্তিষ্কে স্নায়ু সংকেত পাঠায়, যা স্বাদের উপলব্ধি তৈরি করে। এটি আমাদের বিভিন্ন আবেগের সাথে বিভিন্ন স্বাদ যুক্ত করতে সক্ষম করে।
healthline বলছে, “ব্যতিক্রম হল জিহ্বার পিছনের অংশ। এই অংশটি তিক্ততার প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীল, যা বিষাক্ত খাবার গিলে ফেলার আগে আমাদের বুঝতে সাহায্য করে বলে মনে করা হয়।”

মূলত, জার্মান বিজ্ঞানী ডেভিড পলি হানিগ ১৯০১ সালে এক প্রবন্ধে জানান, জিহ্বার স্বাদকোরকগুলোর সংবেদনশীলতা জিহ্বার বিভিন্ন অংশে পরিবর্তিত হয়। তবে এটি স্বাদের উপর নির্ভর করে এমন দাবি না করলেও তিনি যখন এই তথ্য গ্রাফের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন তখন এটি এমন বোঝা যাচ্ছিল যে, বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন স্বাদের সাথে জড়িত। এভাবেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে বহু বছর ধরে জিহ্বার একেক অংশ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ অনুভব করে বলে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এমনকি পাঠ্যবইয়েও প্রচার হয়ে আসছে। তবে একাধিক বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন, জিহ্বার বিভিন্ন অঞ্চল যে কোনও কিছুর স্বাদ নিতে পারলেও কিছু অংশ নির্দিষ্ট স্বাদের জন্য সামান্য বেশি সংবেদনশীল।
উল্লেখ্য, শুরুর দিকে চার ধরনের স্বাদ অনুভবের বিষয়টি প্রচলিত থাকলেও পরবর্তীতে উমামি বা সুস্বাদু বলে আরেকটি স্বাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উমামি স্বাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায় টেস্টিং সল্ট অর্থাৎ মনোসোডিয়াম গ্লুটামেটযুক্ত খাবারে।
প্রসঙ্গত, উমামি বা সুস্বাদু স্বাদ সমৃদ্ধ টেস্টিং সল্ট ক্ষতিকারক কি না এ বিষয়ে বহুদিন ধরে বিতর্ক চলছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত ফ্যাক্ট ফাইল প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, জিহ্বার বিভিন্ন অংশে ভিন্ন স্বাদ অনুভর করার দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- BBC: The real truth about whether our tongues have ‘taste zones’
- Healthline: What to Know About Your Sense of Taste
- Cleveland Clinic: Tongue
- The Conversation : That neat and tidy map of tastes on the tongue you learned in school is all wrong
- Live Science: The Tongue Map: Tasteless Myth Debunked