বাংলাদেশে ওরিও বিস্কুট কি হালাল না হারাম?

আবহমানকাল ধরেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে নাস্তা কিংবা ‘ছোট ক্ষিধে’ মেটানোর উপাদান হিসেবে বিস্কুট এক জনপ্রিয় খাবার হিসেবে প্রচলিত। বিস্কুটের চাহিদা তাই সবসময় বাজারে দেখা যায়। দেশের বিস্কুটের বাজার কত বড়, এর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বা তথ্য নেই। একাধিক কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশের বিস্কুটের বাজার প্রায় ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার। তার মধ্যে ব্র্যান্ডের বিস্কুটের বাজার প্রায় অর্ধেক, ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বিস্কুটের এ বাজার বড় হচ্ছে। 

বিস্কুটের এই বাজারে পরিচিত এক নাম ওরিও (oreo)। বিদেশী এই ব্র্যান্ড বাংলাদেশের ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয় এক বিস্কুট ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবসা করে আসলেও সাম্প্রতিক সময়ে এই বিস্কুটের বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। 

বাংলাদেশে ওরিও বিস্কুট এসেছে কবে থেকে? 

ওরিও বিস্কুট মূলত উৎপাদন করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ‘মন্ডলেজ ইন্টারন্যাশনাল’ (Mondelēz International)। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই কোম্পানি বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে তাদের স্ন্যাকস পণ্য রপ্তানী করছে। ওরিও ছাড়াও কোম্পানিটির অন্যান্য বিস্কুট ব্র্যান্ড যেমন বার্নি, প্রিন্স, রিটয বেশ বিখ্যাত। বিস্কুট ছাড়াও চকলেট,বেভারেজ, বেকড স্ন্যাকসসহ বেশ কিছু ক্যাটাগরির স্ন্যাকস পণ্য রয়েছে মন্ডলেজের। 

Image: Mondelēz International

বাংলাদেশে মন্ডলেজের কোনো শাখা নেই। বাংলাদেশে ওরিও বিস্কুটসহ মন্ডলেজের যে পণ্যগুলো পাওয়া যায় সেগুলো আসে মন্ডলেজের ভারত শাখা থেকে। ভারতে মন্ডলেজের চারটি ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাসিলিটি/ফ্যাক্টরি রয়েছে। এগুলো পুনে, সোলান, গোয়ালিওর এবং চিতরে অবস্থিত। 

বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া ওরিও বিস্কুটের প্যাকেটের গায়ের লেখাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। প্যাকেটের গায়ে লেখা রয়েছে, ওরিও বিস্কুটটি ম্যানুফ্যাকচার অর্থাৎ তৈরি হয়েছে ভারতের ‘মিসেস বেকটর ফুড স্পেশালিস্ট লিমিটেড’ এবং ‘পারসন নিউট্রিশনালস প্রাইভেট লিমিটেড’ কোম্পানিতে৷ এছাড়া, এটি মার্কেটিং করেছে মন্ডলেজ ইন্ডিয়া ফুড প্রাইভেট লিমিটেড। 

অর্থাৎ, নিরামিষ বা ভেজ উপাদান দিয়ে তৈরি হলেও বাংলাদেশে বাজারকৃত ওরিও বিস্কুটকে যাচাই বা পরীক্ষা করা ছাড়া হালাল বা হারাম বলার সুযোগ নেই।

ওরিও বিস্কুট নিয়ে কী বিতর্ক চলছে?

সাম্প্রতিক সময়ে, “Oreo বিস্কুট হালাল নয়” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে

বিতর্কের শুরু কীভাবে? 

ওরিওর বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে মূলত একটি টুইট স্ক্রিনশটকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালের ১১ মে ‘coco meera’ নামক একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে একটি টুইট করে বলা হয়, “@Oreo please is Oreo halal.” উক্ত টুইটে Oreo Cookies এর অফিশিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে একটি রিপ্লে দেওয়ার স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। স্ক্রিনশটে দেখা যায়, Oreo Cookies এর অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, “ওরিও কুকিজ হালাল নয়৷”

তবে আলোচিত টুইটটিতে উক্ত রিপ্লেটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে coco meera একই টুইটে এক ব্যক্তির জিজ্ঞাসার জবাবে লিখেছেন, “স্ক্রিনশটটি ভুয়া নয়। ওরিও সত্যিই রিপ্লে করেছিল কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটি আপনি কোথায় থাকেন তার উপর নির্ভর করে।”

হালাল-হারাম বিষয়ে প্রাথমিক পাঠ

জাতীয় দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সাধারণত ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে সব বৈধ বিষয়কে হালাল ও সব অবৈধ বিষয়কে হারাম বলা হয়।” মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে, “তিনি তাদের জন্য পবিত্র (ও উত্তম) বস্তু হালাল করেছেন এবং অপবিত্র (ও অনুত্তম) বস্তু হারাম করেছেন।” (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৫৭)

বিদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে হালাল সনদের গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ সনদ দিচ্ছে। বিএসটিআই এ সম্পর্কে তাদের গেজেটে বলেছে, ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়াজাত দ্রব্য, প্রসাধনসামগ্রী, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া বা সেবাকে ‘হালাল’ বলে। 

২০০৭ সালের আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইসলামিক ফাউন্ডেশন হালাল সনদ দিয়ে আসছে। অন্যদিকে ২০২১ সাল থেকে এই সনদ দিচ্ছে বিএসটিআই। 

পণ্যের প্যাকেটের গায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ লোগো। ছবি: প্রথম আলো

প্রাথমিক অনুসন্ধানে যা জানা গিয়েছিল

ওরিও কুকিজের আলোচিত স্ক্রিনশটের সূত্র ধরে অনুসন্ধানের শুরুতে ওরিও কুকিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট এবং ওরিও হালাল কিনা এ বিষয়ে টুইটারে কিওয়ার্ড সার্চ রেজাল্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২২) Hamza নামক একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে Oreo কে মেনশন করে এক টুইটে ওরিও হালাল কিনা জিজ্ঞেস করলে Oreo’র ভেরিফাইড টুইটার অ্যাকাউন্ট (oreo cookies) থেকে রিটুইট করে ওই প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়। 

জবাবে ওরিও কুকিজ লিখেছে, “ওরিও হালাল কিনা তা নির্ভর করে আপনি কোন দেশে বাস করেন তার উপর। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে উৎপাদিত ওরিও হালাল সনদপ্রাপ্ত নয়। কেনার আগে সবসময় প্যাকেটের লেভেল এবং উপকরণগুলো দেখে নেওয়ার পরামর্শ দেই আমরা।”

২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ওরিওর পক্ষ থেকে একটি টুইট রিপ্লেতে বলা হয়েছে, “মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও পাকিস্তানের জন্য উৎপাদিত ওরিও বিস্কুট অ্যালকহোলমুক্ত এবং স্থানীয় চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ৷ এই অঞ্চলগুলোতে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থাও হালাল সার্টিফিকেশন স্বীকৃত।”

এছাড়া, যুক্তরাজ্যের ‘Oreo’ এর ওয়েবসাইটের FAQs সেকশনে ওরিও হালাল কিনা এমন প্রশ্নে বলা হয়েছে, “ইউরোপে উৎপাদিত ওরিও বিস্কুট হালাল সার্টিফাইড নয় কিন্তু এগুলোর গঠন বা উৎপাদন প্রক্রিয়া মুসলিম খাদ্যাভাসের জন্য অনুপযুক্ত করে না।”

অর্থাৎ, ওরিও বিস্কুট হালাল সার্টিফাইড কিনা তা নির্ভর করে বিস্কুটটি কোন অঞ্চলে উৎপাদিত হয় তার উপর। 

কী বলছে মন্ডলেজ? 

ভারতে নির্মিত ওরিও বিস্কুট যেগুলো বাংলাদেশে আসে সেগুলো হালাল কিনা সে বিষয়ে জানতে মন্ডলেজ ভারত শাখার সিনিয়র ডিরেক্টর ওপিরা ভাটিয়া’র সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “ভারতে Mondelez India Foods Pvt Ltd দ্বারা উৎপাদিত সমস্ত পণ্য নিরামিষ (vegetarian) উৎস থেকে আসে। মোড়কের সবুজ বিন্দু এটি নিশ্চিত করে। বাংলাদেশেও বিক্রি হওয়া ওরিও ইন্ডিয়ার যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রেও একই তথ্য প্রযোজ্য।”

অর্থাৎ, মন্ডলেজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে বাজারজাতকৃত ওরিও বিস্কুট হালাল না কি হারাম সে বিষয়টি পরিস্কার না করলেও তারা বলছেন, এই বিস্কুট নিরামিষ উৎস থেকে উৎপাদিত হয়। 

নিরামিষ উৎস কী? 

নিরামিষ উৎস বলতে সাধারণত মাংস, মাছ বা পোলট্রি বিহীন উপাদানকে বোঝানো হয়। ধর্মীয় রীতির বাইরে এসব দেশে স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং পরিবেশগত দিকের কথা চিন্তা করে প্রাণীজ উৎস থেকে মুখ ফেরাচ্ছে মানুষ। 

ইফার হালাল সনদ বিভাগ কী বলেছে? 

ওরিও নিরামিষ উৎস থেকে তৈরি হয় এমন তথ্য পাওয়ার পর এই নিরামিষ উৎসকে হালাল বলা যাবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) হালাল সনদ বিভাগে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে হালাল সনদ বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মাও. মোঃ আবু ছালেহ পাটোয়ারী রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “এটি পরীক্ষা না করে বলা যাবে না। এক্ষেত্রে Halal certificate এর জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আবেদন করলে আমরা বিষয়টি দেখব।” 

সেক্ষেত্রে শস্যবীজ বা ভেজ উপাদান দিয়ে তৈরি খাবারকেও পরীক্ষা ছাড়া হালাল বলা যাবে কি না এমন প্রশ্নে জনাব পাটোয়ারী রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “একটা খাদ্য তৈরিতে অনেক উপকরণ থাকে। একজন বললেই তা যাচাই না করে বলা যাবে না। বিশেষ করে যেখানে হারাম মিশ্রণ এর অবকাশ আছে তা তো পরীক্ষা না করে বলা ই যাবেনা।” 

এ বিষয়ে থার্ড পার্টি অর্থাৎ রিউমর স্ক্যানার পরীক্ষার আবেদন করতে পারবে না। হালাল সনদের জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকেই আবেদন করতে হয়। 

অর্থাৎ, নিরামিষ বা ভেজ উপাদান দিয়ে তৈরি হলেও বাংলাদেশে বাজারকৃত ওরিও বিস্কুটকে যাচাই বা পরীক্ষা করা ছাড়া হালাল বা হারাম বলার সুযোগ নেই।

মূলত, ২০১৯ সালে ওরিও কুকিজের “ওরিও হালাল নয়” শীর্ষক একটি টুইট রিপ্লেকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বাজারজাতকৃত ওরিও হালাল নয় শীর্ষক সমালোচনা শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখে রিউমর স্ক্যানার টিম। ওরিও বিস্কুট হালাল কিনা তা নির্ভর করে সেটি পৃথিবীর কোন অঞ্চলে উৎপাদিত হচ্ছে তার উপর। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও পাকিস্তানের জন্য উৎপাদিত ওরিও বিস্কুট হালাল সনদপ্রাপ্ত। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার জন্য উৎপাদিত ওরিও বিস্কুট হালাল সনদপ্রাপ্ত নয়। বাংলাদেশে ওরিও আসে এর উৎপাদন প্রতিষ্ঠান মন্ডলেজের ভারত শাখা থেকে। বাংলাদেশের ওরিও হালাল সনদপ্রাপ্ত কিনা এমন প্রশ্নের স্পষ্টভাবে না উত্তর দিয়ে মন্ডলেজের ভারত শাখা রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছে, “ওরিও উৎপাদনের কাঁচামাল নিরামিষ (vegetarian) উৎস থেকেই আসে। মোড়কের সবুজ বিন্দু সেটিই নিশ্চিত করে।” এই নিরামিষ উৎসকে হালাল বলা যাবে কিনা এমন প্রশ্নে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ বিভাগ রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছে, যাচাই বা পরীক্ষা করা ছাড়া হালাল বা হারাম বলার সুযোগ নেই। 

সুতরাং, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওরিও বিস্কুট হালাল সনদপ্রাপ্ত হলেও বাংলাদেশে বাজারকৃত ওরিও বিস্কুট হালাল বা হারাম কিনা সে প্রশ্নে স্পষ্ট কিছু না জানালেও উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এর কাঁচামাল নিরামিষ (vegetarian) উৎস থেকেই আসে বলে জানিয়েছে। 

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img