কোনো নির্দিষ্ট ফল কি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য নিষিদ্ধ?

ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদী কার্বোহাইড্রেট মেটাবলিক ডিসঅর্ডার যা রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রার বিঘ্ন ঘটিয়ে হৃৎপিণ্ড, কিডনি, রক্তবাহিকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি সাধন করে থাকে। আমরা যখন খাবার খাই, তখন আমাদের অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিন নামক একধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। ইনসুলিনের খাদ্যের অতিরিক্ত গ্লুকোজ কমিয়ে দেয়। যখন ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায় কিংবা দেহে পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদিত হওয়ার পরও যখন তার কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, তখন শরীরে অতিরিক্ত গ্লুকোজ জমা হয়। এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ডায়াবেটিস বলে। মানুষের দেহে বিভিন্ন প্রকারের ডায়াবেটিস দেখতে পাওয়া যায়। তবে, মোটাদাগে ডায়াবেটিস তিন ধরনের

  • টাইপ-১ ডায়াবেটিস
  • টাইপ-২ ডায়াবেটিস
  • জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস

এগুলোর মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪২২ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এছাড়াও, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ডায়াবেটিসের কারণে মারা যান। বিগত কয়েক দশক ধরে ডায়াবেটিসের এই প্রাদুর্ভাব বাড়ছে বলেও জানায় সংস্থাটি।

যুক্তরাজ্যের ডায়াবেটিস সংস্থার তথ্যানুসারে, এখন পর্যন্ত ডায়াবেটিস একটি অনিরাময়যোগ্য ব্যাধি। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখাই আক্রান্ত ব্যক্তির একমাত্র পাথেয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোগীদের নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন, শারীরিক ব্যায়াম ও খাদ্যাভাসের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। 

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টটিউট অব ডায়বেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজ এর ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরল ও গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্যতালিকায় নিম্নোক্ত খাদ্যগুলো রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়-

  • উচ্চ স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার
  • উচ্চ সোডিয়ামযুক্ত খাবার
  • মিষ্টিজাতীয় খাবার (যেমন: কেক, মিষ্টি ড্রিংকস, ফ্লেভারড কফি ইত্যাদি)

কোনো ফল কি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিষিদ্ধ?

স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিন মেডিকেল নিউজ টুডে’র তথ্যমতে, ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্যতালিকায় মিস্টিজাতীয় খাবার রাখতে নিরুৎসাহিত করা হলেও ফলের বিষয়ে তেমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। কোনো নির্দিস্ট ফল ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিষিদ্ধও নয়। পুষ্টির উৎস হিসেবে যেকোনো ফলই গ্রহণ করতে পারবেন ডায়াবেটিস রোগীরা। তবে, এক্ষেত্রে ফলে উপস্থিত কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বিবেচনায় রাখতে হবে।

ফলে কতটুকু কার্বোহাইড্রেট থাকলে সেটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিরাপদ?

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ডায়াবেটিস রোগীরা তিনটি ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে নিজেদের খাদ্যতালিকায় ফলের পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারেন। সেগুলো হলো-

কার্ব কাউন্ট

ডায়াবেটিস রোগীরা প্রতিবেলার খাদ্যতালিকায় ১৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেটযুক্ত ফল রাখতে পারেন। তাজা ফলের একটি ছোট টুকরা কিংবা ১/২ কাপ ফ্রোজেন বা ক্যানড ফ্রুটে ১৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়। এছাড়াও, ৩/৪ কাপ থেকে ১ কাপ তাজা বেরি ও তরমুজ জাতীয় ফল কিংবা ১/৩-১/২ কাপ ফলের রসে ১৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে। এভাবে নির্দিষ্ট ফলের নির্দিষ্ট পরিমাণে উপস্থিত কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ ১৫ গ্রামের নিচে থাকলেই ডায়াবেটিস রোগী নিজের খাদ্যতালিকায় সে ফল স্বচ্ছন্দে স্থান দিতে পারেন। এক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ মুখ্য, ফলের প্রজাতি নয়। 

ডায়াবেটিস প্লেট মেথড

এই পদ্ধতিতে কার্বোহাইড্রেট এর পরিমাণ পুরো প্লেটের আনুপাতিক হারে নির্ধারণ করা হয়। ৯ ইঞ্চির একটি প্লেটকে সমান চারভাগে ভাগ করা হয়। এবার পুরো প্লেটের ২ ভাগ ননস্টার্চ ভেজিটেবল, ১ ভাগ কার্বোহাইড্রেট(ভাত, ফল ইত্যাদি) এবং ১ ভাগ প্রোটিন জাতীয় খাবার অন্তর্ভুক্ত করে খাদ্যতালিকা নির্ধারণ করতে হয়। 

Source: NIDDK

গ্লাইসেমিক ইনডেক্স

গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের (জিআই) মাধ্যমেও খাদ্যে থাকা কার্বোহাইড্রেট বা শর্করার পরিমাণ সম্পর্কে জানা যায়। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স হলো, ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত স্কেলে খাদ্যের রেটিং। এই স্কোর নির্দেশ করে খাবার কত দ্রুত রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে। সাধারণভাবে শরীর মাঝারি বা নিম্ন জিআই খাবারের তুলনায় উচ্চ জিআই খাবার দ্রুত শোষণ করে।

জিআই স্কোরের ভিত্তিতে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ফল একটি ভালো খাদ্য। কারণ, বেশির ভাগ ফলে ফ্রুক্টোজ এবং প্রচুর ফাইবার থাকায় এদের জিআই স্কোর কম থাকে।

এছাড়াও, ডায়াবেটিস রোগীর খবর হিসেবে একটি ফলের তালিকাও উল্লেখ করে আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন। সেখানে, আপেল, আঙুর, কলা, পেঁপে, আনারস সহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলকে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ভালো হিসেবে উল্লেখ করা হয়। 

Source: আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের  একাধিক গবেষণাপত্রের (, ) তথ্যমতে, নিয়মিত খাদ্যতালিকায় ফল রাখা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। এসব গবেষণাপত্র আরো জানায়, দৈনিক ২০০ গ্রাম ফল গ্রহণ টাইপ-২ ডায়বেটিসের প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও, দৈনিক ১৩৩ গ্রাম পর্যন্ত ফলাহার টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জটিলতা ও মৃত্যুহার উভয়ই কমিয়ে দেয় বলে এসব গবেষণায় জানা যায়।

মূলত, ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্যতালিকায় মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিহার করার পরামর্শ থাকলেও কোনো নির্দিষ্ট ফল খাওয়ার ব্যাপারে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। ডায়াবেটিস রোগীরা যেকোনো ফলই খেতে পারবেন কিন্তু ফলে উপস্থিত কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বিবেচনায় রাখতে হবে। ফলে, উচ্চমাত্রার কার্বোহাইড্রেট থাকলে সে ফলও ডায়াবেটিস রোগীর খেতে পারবেন, তবে কম পরিমাণে। সুতরাং, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ফল নিষিদ্ধ নয় বরং কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে যেকোনো ফলই তারা খেতে পারেন।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img