ফেসবুকে লাইক, কমেন্ট, শেয়ারে কী আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায়?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে সারাবিশ্বেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে ফেসবুক। বাংলাদেশেও সমান জনপ্রিয় এই মাধ্যমটি। এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ফেসবুকে নিত্য নতুন উপায়ে প্রতারণা করতে দেখা যায়। 

ফেসবুকে প্রতারণার যে পদ্ধতি প্রচার হয়ে আসছে

১. ফেসবুকে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর Help Line নামক পেজ থেকে ছেলেটির জন্য একটু প্রার্থনা করো (আর্কাইভ) শিরোনামে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টটিতে একটি ছেলের ছবি সংযুক্ত করে ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়, পোস্টে ১ লাইক দিলে ১ টাকা, ১ শেয়ার দিলে ১৫ টাকা এবং ১ টি গ্রুপ শেয়ার দিলে ২৫ টাকা সাহায্য হবে।  এই ধরনের পোস্টগুলো বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে প্রচার হয়ে আসছে। 

এরকম আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং  এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। 

২. এই ধরনের পোস্টগুলোয় লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের অনুরোধের পাশাপাশি পোস্টে সাহায্যপ্রার্থীর ছবি যুক্ত করে সাহায্যের জন্য বিকাশ বা সমজাতীয় পেমেন্টের তথ্য দেওয়া থাকে। রিউমর স্ক্যানার গত বছর থেকে এই ধরনের পোস্টগুলোর বিষয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ধরনের পোস্টে যে ছবি যুক্ত করা হয় সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুয়া অর্থাৎ অন্য কারো ছবি ব্যবহার করা হয়। যে বিকাশ নম্বরগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলো আর্থিক প্রতারক চক্রের নাম্বার। রিউমর স্ক্যানার প্রকাশিত এই ধরনের কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। 

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই ধরনের পোস্টগুলোতে লাইক, কমেন্ট বা শেয়ারের মাধ্যমে যে সাহায্যের কথা বলা হয় সেটি কি আসলেই ঘটে? এই ধরনের পোস্টের মাধ্যমে ফেসবুক কি সত্যিই অর্থ সহায়তা দেয়? 

লাইক, কমেন্ট, শেয়ারে অর্থ সাহায্য মেলে? 

২০১৬ সালের ২ আগস্ট বিবিসি Free chickenpox jab call after toddler suffers ‘worst case’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারাহ এ্যালেন নামক যুক্তরাজ্যের এক নাগরিকের দুই বছর বয়সী ছেলে সন্তান জেসপার এ্যালেন চিকেনপক্স রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে হাসপাতালে জেসপারের আক্রান্ত অবস্থার ছবিও প্রকাশ করা হয়। সে সময় অন্যান্য গণমাধ্যমেও জেসপারের সে সময়কার ছবি প্রকাশ করে। চিকেনপক্স সাধারণ রোগ হলেও সে সময় জেসপারের আক্রান্ত হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে আসার কারণ ছিল দুইটি। 

বিবিসি বলছে, জেসপারের ক্ষেত্রে রোগটি তীব্র ছিল এবং তার মা চিকেনপক্সের টিকা সবার জন্য বিনামূল্যে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। জেসপার পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে উঠেছিল। 

সমস্যার শুরু পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে। সে বছর পহেলা ফেব্রুয়ারী Pooran Singh নামক একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু ছবি সংযুক্ত করে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা ছিল, “This little baby has cancer and he need money for surgery. Facebook has decided to help by giving 1 Like = 2 dollar, 1 comment = 4 dollar, 1 share = 8 dollars ” পোস্টের ছবিগুলোর সাথে জেসপারের রোগাক্রান্ত সময়ের ছবির হুবহু মিল পাওয়া যায়। এই পোস্টে সে সময় ২ লাখ ৪১ হাজারেরও বেশি বার লাইক পড়েছিল, শেয়ার করেছিল প্রায় ১২ লক্ষাধিক মানুষ, কমেন্ট এসেছিল ১ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি। 

এই পোস্ট নজরে আসে জেসপারের মা সারাহ এ্যালেনের। তিনি ফেসবুককে কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে অবহিত করেন। ফেসবুক ঐ অ্যাকাউন্টটি ১০ ফেব্রুয়ারী মুছে (remove) দেয়।

ভারতীয় ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান Factly ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, “একটি পোস্ট লাইক বা শেয়ার করা হলে ফেসবুক গুরুতর অসুস্থ রোগীদের টাকা দেয় কিনা তা জানতে গুগলে অনুসন্ধান করা হলে, এই সমস্যা সম্পর্কিত ফেসবুক টিমের একটি উত্তর ‘ফেসবুক সহায়তা বিভাগে’ পাওয়া যায়। সেখানে ফেসবুক টিমের পক্ষে একজন সদস্য জানিয়েছেন যে ব্যবহারকারীর এই ধরনের কোনও পোস্টে ফেসবুক টাকা দেয় না।”

ব্রিটিশ নিরাপত্তা বিষয়ক ব্লগার Graham Cluley বিবিসিকে বলেছেন, “এমন অনেক স্ক্যাম রয়েছে যা এই ধরণের আবেগপূর্ণ ছবি ব্যবহার করে – প্রায়শই এটি অর্থ উপার্জনের জন্য করা হয়।”

এই উপায়ে যদিও অর্থ দিচ্ছে না ফেসবুক, তবে এই ধরনের পোস্টের মাধ্যমে আরো বেশি মানুষকে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে যুক্ত করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন মার্কিন এই নিরাপত্তা বিষয়ক ব্লগার। “স্ক্যামাররা মানুষকে একটি ফেসবুক পোস্টের সাথে যুক্ত করতে চায় যাতে তারা হয় তাদের কাছে আরও বার্তা পাঠাতে পারে বা প্রোফাইল এবং এর সমস্ত পরিচিতি বিক্রি করতে পারে। ” 

একই মত দিয়েছে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান Snopes। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, “এমনকি যদি এই পোস্টগুলোর সাথে কোনও অর্থ হাতবদল নাও হয়, তবে সেগুলো শেয়ারের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে স্ক্যামারদের তাদের সোশ্যাল মিডিয়া পেজগুলোতে ফলোয়ার, শেয়ার এবং লাইক বৃদ্ধি করে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয় যেখান থেকে তারা অন্যান্য প্রতারণামূলক স্কিম চালু করতে পারে।” 

মানুষ কেন প্রভাবিত হচ্ছে?  

Help Line নামক পেজ থেকে ছেলেটির জন্য একটু প্রার্থনা করো (আর্কাইভ) শিরোনামে প্রকাশ করা পোস্টটিতে এখন পর্যন্ত ১ লক্ষ দুই হাজার লাইক পড়েছে এবং ২ লাখ ২৯ হাজার শেয়ার করা হয়েছে। 

একই ধরনের আরেক পোস্টের ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়েছে, “এমন কোনো পাথরের মানুষ থাকবে যে শেয়ার করবে না।” গত বছরের (২০২১) এই পোস্ট এখন পর্যন্ত শেয়ার হয়েছে ২৬ হাজার বার। 

কিন্তু কেন শুধু ছবি এবং ক্যাপশন দেখে এত মানুষ পোস্টটিতে লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ার করেছেন? 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক মার্কেটপ্লেস বেটার বিজনেস ব্যুরো (Better Businesses Bureau) ২০১৫ সালে এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন (আর্কাইভ) প্রকাশ করে। সংস্থাটি প্রতিবেদনে জানায়, “এই ধরনের পোস্টে প্রচুর মানুষের যুক্ত থাকার পেছনে কারণ হতে পারে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বাক্য বা গল্প।” এই ধরনের ঘটনাকে ”Facebook Like Farming’ আখ্যা দিয়ে সংস্থাটি জানায়, “সুন্দরভাবে লেখা কোনো গল্প আপনার হৃদয়কে টানে। আপনাকে তখন বলা হয় এটি আবার পোস্ট বা শেয়ার করতে।”  

ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান Fact-watch বলছে, এ ধরনের স্পর্শকাতর ছবি কিংবা ক্যাপশনের কারণে অনেকেই এসব পোস্ট শেয়ার করেন।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম USA TODAY ২০১৬ সালে Like farming বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বেটার বিজনেস ব্যুরো’র প্রতিবেদনটির বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়, “স্ক্যামাররা তাদের অপারেশনের প্রাথমিক পর্যায়ে রাডারের নীচে উড়ে যাওয়ার একটি সহজ উপায় খুঁজে পেয়েছে। তারা মূলত ফেসবুকে যে গল্পটি পোস্ট করে তাতে বিপজ্জনক কিছু নেই। এটা শুধুমাত্র একটি নিয়মিত গল্প যে কেউ পোস্ট করতে পারে। পোস্টটি নির্দিষ্ট সংখ্যক লাইক এবং শেয়ার পাওয়ার পরেই স্ক্যামার এটি সম্পাদনা করে এবং বিদ্বেষপরায়ন (malicious) কিছু যোগ করে।” 

Graham Cluley বিবিসিকে বলেছেন, “সমস্যা হল যে মানুষ কেবল অনলাইনে পোস্ট করা জিনিসগুলোকে বিশ্বাস করে এবং তারা কী পছন্দ করে এবং কী শেয়ার করে সে সম্পর্কে তাদের আরও বেশি যত্নবান হওয়া দরকার৷” 

USA TODAY বলছে, “প্রকৃতপক্ষে, আপনি যদি আপনার লাইক দেওয়া পোস্টগুলোর history চেক করেন, আপনি দেখতে পাবেন যে তাদের মধ্যে কিছু পোস্ট এমন কিছুতে পরিবর্তিত হয়েছে যা আপনি এক মিলিয়ন বছরেও পছন্দ করতেন না।” 

জেসপার এ্যালেনের ঘটনার প্রেক্ষিতে মার্কিন টেলিভিশন এবং রেডিও সার্ভিসের সংবাদ বিভাগ সিবিসি নিউজ Like Farming বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “যদিও কখনও কখনও কোন পোস্টগুলো আসল এবং কোনটি নকল তা নির্ধারণ করা কঠিন, তবে কয়েকটি সহজ সূত্র রয়েছে যা এই “লাইক-ফার্মিং” পোস্টগুলোর মধ্যে মিল খুঁজে দেয়। 

এগুলো হলো:

১. তারা দাবি করে যে কারো ক্যান্সার বা অন্য কোনো গুরুতর রোগ আছে এবং অস্ত্রোপচারের জন্য অর্থের প্রয়োজন।

২. তারা দাবি করে যে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ “লাইক”, “কমেন্ট” বা “শেয়ার” এর জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দান করে “সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে”।

৩. তারা সাধারণত একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীকে পোস্টের শেষে “আমিন” মন্তব্য করতে বলে।

পরের বার এই ধরনের হৃদয় বিদারক ছবি সহ একটি পোস্ট নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে নজরে পড়লে লাইক, কমেন্ট কিংবা শেয়ার করার আগে এই চিহ্নগুলো দেখতে পরামর্শ দিয়েছে সিবিসি নিউজ৷ যদি সন্দেহ হয় যে পোস্টটি একটি স্কয়াম, তাহলে অবিলম্বে ফেসবুকে রিপোর্ট করতেও বলেছে সংবাদমাধ্যমটি। 

ফেসবুকে সাহায্য পেতে স্বীকৃত কোনো পদ্ধতি রয়েছে? 

লাইক, কমেন্ট কিংবা শেয়ারের মাধ্যমে ফেসবুক কর্গৃপক্ষকে সাহায্যপ্রার্থীকে অর্থ সহায়তা না দিলেও ফেসবুকে অর্থ সাহায্য চাওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির বিশেষ একটি টুল রয়েছে। Fundraisers নামের এই ব্যবস্থা চালু করা হয় ২০১৫ সালে। 

Screenshot source : Facebook

এই ব্যবস্থাটির মাধ্যমে ব্যবহারকারী নিজের জন্য, তার বন্ধুর জন্য কিংবা একটি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ফেসবুকের ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আবেদন যাচাই করে দেখে। যাচাই সাপেক্ষে টাকা সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়। 

পাশ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের ৪৭ টি দেশে এই অপশনটি ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও বাংলাদেশের নেই। তবে বাংলাদেশী অনেকেই যেসব দেশের ব্যবহারকারীদের এটি ব্যবহারের অনুমতি আছে তাদের মাধ্যমে অপশনটি ব্যবহার করে আসছে।

Screenshot source : Facebook

এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বেসরকারি অনেক সংস্থা ও এনজিও বিভিন্ন দূর্যোগ কবলিত মানুষ ও অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে। এই মুহূর্তে যেমন বাংলাদেশের জাগো ফাউন্ডেশন বন্যা দুর্গতদের সহায়তার উদ্দেশ্যে Fundraiser অপশনটি ব্যবহার করছে। 

অর্থাৎ, বিগত কয়েক বছর ধরে ফেসবুকে লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ারের মাধ্যমে অর্থ সাহায্য পাওয়া যায় এমন এক ধরনের রীতির প্রচলন হয়ে আসছে। অথচ এই পদ্ধতির কোনো ভিত্তি নেই। বরং এই ধরনের স্ক্যাম কমেন্টের ফলে ফেসবুকের পক্ষ থেকে অ্যাকাউন্ট ও পেজ মুছে দেওয়ার উদাহরণ রয়েছে। প্রতারকরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই ধরনের পোস্ট করে আসছে বলে মত দিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।     

তথ্যসূত্র

  1. Better Businesses Bureau : DON’T FALL FOR FAKE FACEBOOK PAGES! 
  2. BBC : Facebook investigates fake cancer child post 
  3. BBC : Free chickenpox jab call after toddler suffers ‘worst case’
  4. BBC : Facebook deletes fake child-cancer posts accounts
  5. Factly : Facebook doesn’t give money when any posts are liked, shared or commented
  6. Snopes : Is $1 Donated for a Girl’s Kidney Transplant Every Time Her Photo Is Shared on Social Media?   
  7. USA TODAY : Don’t click ‘like’ on Facebook again until you read this 
  8. CBS News : Dangerous “like-farming” scam returns to Facebook. Here’s what you need to know
  9. Facebook : Fundraisers
  10. Facebook : Is fundraising on Facebook available in my country?  
  11. Fact watch : সাহায্যপ্রার্থীর কোনো ছবি লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করলে কি ফেসবুক টাকা দেয়?

আরও পড়ুন

spot_img