গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন নামের এক বাঙালি যুবককে হত্যা করার জের ধরে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ এবং হামলার ঘটনা ঘটেছে। সংঘাতের এই রেশ পার্শ্ববর্তী জেলা রাঙামাটিতেও ছড়িয়েছে। এসেছে মৃত্যুর খবরও। এই ইস্যুতে থেমে নেই গুজব ও অপতথ্যের প্রবাহও। রিউমর স্ক্যানার পাহাড়ের এই সংকট নিয়ে এখন পর্যন্ত ১১টি গুজব শনাক্ত করেছে।
গতকাল (২০ সেপ্টেম্বর) বেশ কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের সাথে অস্ত্র হাতে পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তির ছবি পোস্ট (১, ২) করে দাবি করা হয়, ছবিটি সম্প্রতি পাবর্ত্য এলাকার ঘটনার দৃশ্য।
তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ছবিটি পার্বত্য এলাকার নয়। রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত একজন কয়েদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত ১৬ আগস্ট শুক্রবার কারাগারে উত্তেজনা বিরাজ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যায় সেনাবাহিনীর একটি দল। সে সময়ের ছবি এটি। তবে অস্ত্র হাতে পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ সংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সে সময় সিভিল ড্রেসে থাকা একাধিক ব্যক্তির হাতেই অস্ত্র ছিল।
রিউমর স্ক্যানারকে কারাগারটির সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক বলেছেন, এই ব্যক্তির নাম মোঃ মিজানুর রহমান। তিনি কারারক্ষী হিসেবে রংপুর কারাগারে কর্মরত রয়েছেন।
খাগড়াছড়ির দিঘীনালাকে হ্যাশট্যাগে রেখে কতিপয় ফেসবুক পোস্টে জঙ্গল সদৃশ এলাকায় কিছু পাহাড়ি ব্যক্তির জড়ো হয়ে বসে থাকার দৃশ্য যুক্ত করে দাবি করা হচ্ছে, “অনেকের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। না জানি আজ রাতে আরো কতজনের ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়, কত জনকে হত্যা করা হয়। সেজন্য এরা পালিয়ে বেরাচ্ছে।”
তবে এই ছবিটিও সাম্প্রতিক সময়ের নয়। ছবিটি অন্তত চলতি বছরের মে মাস থেকে ইন্টারনেটে রয়েছে। এক্সে গত ১৯ মে এই ছবিসহ একটি পোস্ট পাওয়া যায়। ২০ মে ভারতীয় গণমাধ্যম ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনেও একই ছবি প্রচার করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বেশকিছু শরণার্থী ভারতের মিজোরামের লংৎলাই জেলায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
অপতথ্যের এই প্রবাহে ধর্মীয় স্থাপনা সংক্রান্ত ভুল তথ্যের প্রচারও থেমে নেই। এক্সে ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন খাগড়াছড়ি এবং ফেসবুকে রাঙ্গামাটির দৃশ্য দাবিতে পোড়া মূর্তির ছবি প্রচার করে এটিকে পাহাড়ে সংকটের সাম্প্রতিক দৃশ্য বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে ভাইরাল ছবিটি অন্তত চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ইন্টারনেটে রয়েছে।
গত ১০ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত একাধিক পোস্ট (১, ২) পাওয়া যায়, যেখানে দাবি করা হচ্ছে, এটি ০৬ জানুয়ারির ঘটনা। সেদিন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার শরনংকর ভিক্ষুর মন্দির জ্ঞানশরণ মহারণ্য বৌদ্ধ বিহার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়৷
এদিকে অস্ত্রসহ রাস্তা পার হচ্ছে পাহাড়ি ব্যক্তিরা এমন দাবিতে দুইটি ভিডিও (১, ২) পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক দৃশ্য বলে দাবি করা হচ্ছে ফেসবুকে। তবে রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে দেখেছে, ভিডিও দুটি ফিলিপাইনের।
সাত্তার জাক্কাল নামের একটি ফেসবুক পেজে এই দুই ভিডিও (১, ২) ১৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। পেজটি ফিলিপাইন থেকে পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়া, ভিডিওর বিভিন্ন উপাদান (গাড়ির নাম্বারপ্লেট, গ্যাস স্টেশনের নাম, মোবাইল পেমেন্ট পরিষেবা জিক্যাশের ব্যানার) বিশ্লেষণ এবং পরবর্তীতে যাচাই করে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভিডিও দুইটি ফিলিপাইনেরই।
অস্ত্র হাতে আরো কিছু ব্যক্তির ভিন্ন আরেকটি ভিডিওকেও পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃশ্য বলে দাবি করা হচ্ছে ফেসবুক ও ইউটিউবে। তবে রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধান করে দেখেছে, ভিডিওটি ভারতের আসামের।
ভিডিওটির অগ্রভাগে যাকে দেখা যাচ্ছে, তার নাম সামবোর রংপি। তিনি আসামের একজন পুলিশ সদস্য। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ১৭ জুলাই মূল ভিডিওটি পোস্ট করা হয়।
একই ব্যক্তি গত ০৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করেন তার অ্যাকাউন্টে। এটিকেও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের দাবিতে গতকাল প্রচার করা হয়েছে ফেসবুকে।
রাঙামাটিতে মার্কিন সেনারা ঢুকে পড়ছে এমন দাবিতে একটি ভিডিও প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। যাচাই করে দেখা গেছে, এই ভিডিও সাম্প্রতিক সময়ের নয়৷
ভিডিওটি এক্সে গত ৩০ মে বায়োতে ফ্রান্স উল্লেখ আছে এমন একটি অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়। তবে ভিডিওটির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। এটা নিশ্চিত যে, এটি বাংলাদেশের বা সাম্প্রতিক সময়ের ভিডিও নয়।
বর্তমানে রাঙ্গামাটির অবস্থা দাবি করে একটি ছবি পোস্ট হচ্ছে ফেসবুকের একাধিক অ্যাকাউন্টে। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ছবিটি মিয়ানমারের।
গত সপ্তাহে দেশটির একটি গ্রামে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় এই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
দেশের যে কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে মৃত্যুর গুজব একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে ওঠেছে৷ পাহাড়ের সাম্প্রতিক সংকটেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। ব্যারিস্টার এবং সলিসিটর নিঝুম মজুমদার, আওয়ামী যুব মহিলা লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি ইয়াসমিন সুলতানা পোলেনসহ একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে জেনার চাকমা নামে এক ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পুরোনো পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সংঘাতের ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানারকে জেনার চাকমা নিশ্চিত করেছেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব। তিনি সুস্থ আছেন এবং বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
এই বিষয়ে বিভ্রান্তি মূলত নামের কারণে। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ এবং গোলাগুলিতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে গণমাধ্যম। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে জুনান চাকমা (২০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। ‘জুনান’ নামটিকে ‘জেনার’ ভেবে নিয়ে জীবিত ব্যক্তির নিহত হওয়ার দাবি সম্বলিত পোস্ট করেছেন নেটিজেনরা।