গত ০৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনের আগের রাত অর্থাৎ ০৬ জানুয়ারি রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে সংঘর্ষে মৃত্যুর ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
০৭ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে শুরু করে দিনভর একাধিক পোস্টে দাবি করা হচ্ছিল, সে সময় পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে সারাদেশে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের সমর্থকদের সাথে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের সংঘর্ষে ২৫ জন নিহত হয়েছে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য ফেসবুকে লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে এ সংক্রান্ত দাবি করলেও পরে ভিডিওটি সরিয়ে নেন (গুগল ড্রাইভে ভিডিওটি দেখুন এখানে)। লাইভ ভিডিও প্রকাশের কিছুক্ষণ পরেই তিনি তার ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন যাতে ২৫ জন নিহত হওয়ার কথা সরাসরি উল্লেখ না করে দাবি করেন, ২৫ উইকেটের পতন হয়েছে।
২৫ জন নিহত হওয়া সংক্রান্ত দাবিতে কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
কিছু পোস্টে মৃতের সংখ্যা ২৮ জন বলেও দাবি করা হয়েছে। দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
আমাদের নজরে এমন পোস্টও এসেছে যেখানে মৃতের সংখ্যাটা ৪৫ জন বলে দাবি করা হয়েছে। দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
পরদিন (০৮ জানুয়ারি) ফেসবুকের কিছু পোস্টে এই সংখ্যার দাবিটি ৭০ এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ সংক্রান্ত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
অর্থাৎ, ভোটকেন্দ্র দখলসহ নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতায় সর্বনিম্ন ২৫ জন থেকে সর্বোচ্চ ৭০ জন পর্যন্ত মৃত্যুর দাবি ছড়িয়েছে ফেসবুকে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভোটকেন্দ্র দখলসহ নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতায় ২৫, ২৮, ৪৫ বা ৭০ জন নিহতের দাবিটি সঠিক নয় বরং গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত নয় জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে নির্বাচনের দিন (০৭ জানুয়ারি) নিহত হয়েছে দুইজন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে গত ০৬ জানুয়ারি ‘বিবিসি নিউজ বাংলা’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে জানানো হয়, ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনি প্রচার শুরুর পর থেকে ০৫ জানুয়ারি পর্যন্ত (সেদিন সকালেই প্রচারণা শেষ হয়) ১৮ দিনে ১৫৬টি জায়গায় নির্বাচনি সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আর এতে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের সংগঠন মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের বার্ষিক রিপোর্টের বরাত দিয়ে একই তথ্য দিয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলা।
জাতীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো একই তথ্য উল্লেখ করে জানিয়েছে, নির্বাচনী প্রচারে প্রাণহানির প্রথম ঘটনা ঘটে গত ২৩ ডিসেম্বর, মাদারীপুরের কালকিনিতে। সেদিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক সমর্থককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া, মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় গত ০৩ জানুয়ারি (বুধবার) দিবাগত রাতে নৌকার প্রার্থীর এক সমর্থককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে, একইদিন দুপুরে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বাদুরা গ্রামে নির্বাচনী সহিংসতায় আহত স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে ভিন্ন কথা। পিরোজপুরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পূর্বশত্রুতার জের ধরে ঘটেছে।
নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালীন মৃত্যুর একই সংখ্যা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত আরো কিছু প্রতিবেদন দেখুন চ্যানেল২৪, সময়ের আলো, সংবাদ।
পরবর্তীতে নির্বাচনের আগেরদিন (০৬ জানুয়ারি) ভোটকেন্দ্র দখল বা সংশ্লিষ্ট কারণগুলোয় কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে কিনা এমন তথ্যের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেদিন সকালে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে ভোট কেন্দ্র পাহারায় থাকা এক গ্রাম পুলিশের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বালিয়াকান্দি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্মা (ওসি) আলমগীর হোসেন বলেন, ‘তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজবাড়ী মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে।’
এর বাইরে সেদিন একাধিক স্থানে ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়াসহ সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনায় কেউ নিহত হয়নি।
অন্যদিকে, নির্বাচনের দিন (০৭ জানুয়ারি) সহিংসতায় দুইজন মৃত্যুর খবর দিয়েছে গণমাধ্যমগুলো (১, ২, ৩)। মুন্সিগঞ্জে নৌকা প্রার্থীর এক সমর্থককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর কুমিল্লায় তর্কাতর্কির একপর্যায়ে ঈগল প্রতীকের কিছু সমর্থকের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন এক ব্যক্তি।
এছাড়া, মাদারীপুর ও নেত্রকোনায় নির্বাচন পরবর্তী বিজয় মিছিলে হামলার ঘটনায় দুইজন মারা যাওয়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। এর বাইরে ঝালকাঠিতে একজন নিহত হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত তাদের এক বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সে বছর (৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) নির্বাচনী সহিংসতায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১০।
মূলত, গত ০৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গেল ডিসেম্বরে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকে নির্বাচন পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের আগের রাত অর্থাৎ ০৬ জানুয়ারি রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচনী সহিংসতা ও সংঘর্ষে মৃত্যুর ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা (২৫, ২৮, ৪৫, ৭০) প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, নিহতের যে সংখ্যাগুলো প্রচার করা হয়েছে তার কোনোটিই সঠিক নয়। নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর থেকে প্রচারণার শেষ দিন পর্যন্ত সহিংসতায় মারা গেছে তিনজন। এছাড়া, নির্বাচনের আগের দিন একজন, নির্বাচনের দিন দুইজন এবং নির্বাচনের পরের দিন থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত সহিংসতায় মারা গেছে তিনজন। এ হিসেবে এখন অবধি মোট নিহতের সংখ্যা নয় জন। এছাড়া, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২০২৩ সালে (৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) নির্বাচনী সহিংসতায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১০। অর্থাৎ, নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা কোনোভাবেই ২৫ বা তার উপরের সংখ্যাগুলোয় পৌঁছায়নি।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর দিন থেকে নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত ২১ দিনে সারা দেশে ২২ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ভোটের দিনের সহিংসতাতেই ১৭ জন নিহত হয়।
সুতরাং, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতায় নয়জন মারা গেলেও মৃত্যুর ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- BBC News Bangla: নির্বাচনের আগেরদিন ব্যাপক সহিংসতা,ভোট নিরাপদ করতে যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে
- VOA Bangla: সংঘর্ষ, সহিংসতা ও প্রাণহানিতে শেষ হলো নির্বাচনী প্রচারণা
- Prothom Alo: সংঘাত, মৃত্যুতে শেষ হলো প্রচার
- BBC News Bangla: ‘১৪ ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, গ্রাম পুলিশের লাশ উদ্ধার’
- Prothom Alo: দুজন নিহত, ৩৮ প্রার্থীর ভোট বর্জন
- Rumor Scanner’s own analysis