ছবির নারী ও পরিবারটি ৬৯ সন্তানের জননী ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের নয়

দীর্ঘদিন ধরে ‘৪০ বছর ছিলেন গর্ভবতী, আজকাল এমন মেয়ে পাওয়াই যায় না‘ শীর্ষক শিরোনামে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে

Screenshot: Jagonews24

এই বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন বিবার্তা২৪.নেট, জাগো নিউজ২৪,আলোকিত বাংলাদেশ। 

ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন, এখানে
আর্কাইভ ভার্সন দেখুন,,এখানে

ছবিটিতে যা দাবি করা হচ্ছে:

ছবিতে থাকা নারীটির নাম ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভ। তিনি রাশিয়ার মস্কোর সুইয়া নামক গ্রামের এক কৃষক ফেরাও ভাসিলিয়েভের প্রথম স্ত্রী। মিসেস ভাসিলিয়েভ ৬৯ জন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। তিনি তার জীবনে সর্বমোট ২৭ বার গর্ভধারণ করেন। প্রতিবার একের অধিক বাচ্চার জন্ম হয়। ১৭২৫ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি গর্ভধারণ করেই কাটিয়েছেন।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৭২৫ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছর গর্ভধারণ করে কাটিয়ে দেওয়ার দাবিতে প্রচারিত নারী ও পরিবারের ছবিটি সঠিক নয় বরং দুইটি ভিন্ন ভিন্ন ছবিকে প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। 

পরিবারের ছবিটি কার?

রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে pbs.org নামের একটি ওয়েবসাইটে ‘Polygamy and the Church: A History‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের পরিবারের দাবিতে প্রচারিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: pbs.org

ছবিটির বিস্তারিত বিবরণী থেকে জানা যায়, এটি জোসেফ এফ. স্মিথ ও তার পরিবারের একটি ছবি। বহুবিবাহ ও চার্চের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রতিবেদনটিতে জোসেফ এফ. স্মিথ ও তার পরিবারের এই ছবিটি প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হয়েছিল।

এছাড়া প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, যোসেফ এফ. স্মিথ Church of Jesus Christ of Latter-Day of Saints এর ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট এবং এই ছবিটি ১৯০৪ সালে তোলা হয়েছিল।

পাশাপাশি Legends of America নামের আরেকটি ওয়েবসাইটে ‘Traveling through American history, destinations & legends since 2003‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য সম্বলিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Legends of America

উল্লেখ্য, Church of Jesus Christ of Latter-Day of Saints হচ্ছে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত খ্রিস্টানদের একটি অংশের ধর্মীয় উপাসনালয়।

এই ছবিটির সঙ্গে ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের সম্পর্ক কিভাবে?

ছবিটির সঙ্গে ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের সম্পর্ক অনুসন্ধানে আমেরিকান ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Snopes.com এ ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি ‘Does This Photograph Show the Offspring of a Woman Who Gave Birth to 69 Children?‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে Top 10 Lists ‘পৃথিবীর বৃহৎ ১০ পরিবার‘ এর ছবি সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে এই ছবিটি প্রথম ভুলবশত ব্যবহার করা হয়। এরপর থেকে ছবিটি বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েবসাইটে এভাবেই ব্যবহার হয়ে আসছে। 

Screenshot: Snopes.com

Top 10 Lists এর ওয়েবসাইট ঘুরেও এই তথ্যটির সত্যতা মিলে।

Screenshot: Top 10 Lists

অর্থাৎ ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের পরিবারের দাবিতে প্রচারিত ছবিটি তার পরিবারের নয়। প্রকৃতপক্ষে ছবিটি Church of Jesus Christ of Latter-Day of Saints এর ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জোসেফ এফ. স্মিথ ও তার পরিবারের ১৯০৪ সালে তোলা একটি ছবি। যেটি ২০১২ সালে Top 10 Lists নামের একটি ওয়েবসাইট ‘পৃথিবীর বৃহৎ ১০ পরিবার’ এর তালিকা করতে গিয়ে তাদের ওয়েবসাইটে ভুলভাবে ব্যবহার করে।

ছবির নারীটি কি ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভ?

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের দাবিতে প্রচারিত ছবিটি এই নারীর নয়। ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে Peta Pixel নামে একটি ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট ‘These Elderly New Yorkers Were First Generation to Ever Be Photographed‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের দাবিতে প্রচারিত ছবিটি সহ আরও বেশ কিছু ছবি খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Peta Pixel

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, এই ছবিগুলোতে থাকা ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই নিউ ইয়র্ক এর অধিবাসী। ধারণা করা হয়, তাদের প্রত্যেকে ১৭ শতকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

Screenshot: Peta Pixel

প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, এই ছবিগুলোর কয়েকটি তুলেছিলেন ১৮৪০ সালের দিকে আমেরিকান গৃহযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক ম্যাথিউ ব্র‍্যাডি। 

পাশাপাশি ব্রিটিশ গণমাধ্যম Daily Mail এ ২০১৮ সালের ১৩ এপ্রিল ‘The first Americans ever to be photographed are brought back to life as their portrait shots taken in the 1840s are colorized‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য ও ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: Daily Mail

অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের দাবিতে প্রচারিত ছবিটি মূলত একজন আমেরিকান নারীর। অপরদিকে ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভ সম্পর্কে জানা যায়, তিনি ছিলেন একজন রাশিয়ান। 

ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্যমতে, ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সন্তান জন্ম দেওয়া নারী৷ তিনি রাশিয়ার সুইয়া নামক গ্রামের এক কৃষক ফেরাও ভাসিলিয়েভের স্ত্রী। ভাসিলিয়েভ মোট ২৭ বার গর্ভধারণ করে ৬৯ জন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।

Screenshot: Guinness World Records

এর মধ্যে ১৬ বার জমজ, সাতবার তিন সন্তান ও চারবার চার সন্তান করে একবারে জন্ম দিয়েছিলেন। 

Screenshot: Guinness World Records

তবে অনুসন্ধানে তার বা তার পরিবারের কোনো ছবি পাওয়া যায়নি।

মূলত, ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভ নামে এক রাশিয়ান নারী ১৭২৫ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে দীর্ঘ ৪০ বছরে মোট ২৭ বার গর্ভধারণ করে ৬৯ জন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৬ বার জমজ, সাতবার তিন সন্তান ও চারবার চার সন্তান করে জন্ম দিয়েছিলেন। যা গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃক স্বীকৃত৷ তার ও তার পরিবারের কোনো ছবি পাওয়া না গেলেও দুইটি ভিন্ন ভিন্ন ছবিকে সম্পাদনা করে ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভের পরিবারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই ছবি দুইটির নারীটি একজন আমেরিকান। যেটি তোলা হয়েছে ১৮৪০ এর দশকে ও পরিবারের ছবিটি Church of Jesus Christ of Latter-Day of Saints এর ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট যোসেফ এফ. স্মিথের পরিবারের এবং এই ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯০৪ সালে। অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, ২০১২ সালে Top 10 Lists নামের একটি ওয়েবসাইট ‘পৃথিবীর বৃহৎ ১০ পরিবার’ এর তালিকা করতে গিয়ে তাদের ওয়েবসাইটে সর্বপ্রথম এই ছবিটিকে ভুলভাবে ব্যবহার করে এবং তারপর থেকে ছবিটি এভাবেই বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার হয়ে আসছে। 

সুতরাং, ভ্যালেন্টিনা ভাসিলিয়েভ নামের এক নারীর দীর্ঘ ৪০ বছর গর্ভধারণ করে কাটিয়ে দেওয়ার তথ্যের সাথে ভিন্ন নারী ও পরিবারের ছবি যুক্ত করে প্রচার করা হচ্ছে; যা মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img