যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিদের ভিসা দেয় না শীর্ষক ভুয়া দাবি এক্সে

গত ২০ মার্চ Voice of Bangladeshi Hindus নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে দাবি করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিদের ভিসা দেয় না। কোনো বাংলাদেশির যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেতে হলে তাকে ভারতে গিয়ে সে দেশের পাসপোর্ট করে সেই পাসপোর্ট ইস্যু করতে হয়। ভারতের মাধ্যম ব্যতীত বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার সুযোগ নেই।

ভিসা দেয় না

 এক্সে প্রচারিত পোস্টটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)

উক্ত দাবির পোস্টটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এ প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি পোস্টটি এক্সে ৬৮বার রি-পোস্ট করা হয়েছে। এছাড়া পোস্টটিতে ১০৪টি পৃথক এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাস উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশিদের নিয়মিত ভিসা দিচ্ছে। এসব ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে কাউকেই ভারতের কোনো সহযোগিতা নিতে হচ্ছে না। দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করেই বাংলাদেশিরা এই ভিসা পাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিদের ভিসা দিচ্ছে না এমন দাবির সত্যতা যাচাইয়ের শুরুতে ২০২৩ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের জন্য আরোপিত ভিসা নীতিটি পড়ে দেখে রিউমর স্ক্যানার টিম।

ভিসা নীতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি জে ব্লিঙ্কেনের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যকে সহায়তা করতে, আমি ইমিগ্রেশন এন্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ধারা 212(a)(3)(C) (“3C”) এর অধীনে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছি। এই নীতির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে। এর মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

অর্থাৎ, এই ভিসা নীতিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িতদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের কথা বলা হয়। তবে এই ভিসা নীতির কোথাও নির্বাচন প্রক্রিয়ার উল্লিখিত কর্মকাণ্ড ব্যতীত বাংলাদেশিদের ভিসা না দেওয়া বা ভিসা প্রদান বন্ধ করে দেওয়ার কোনো কথা বলা হয়নি।

পরবর্তীতে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

ওয়েবসাইটটির ভিসা সেকশন পর্যালোচনা করে এ ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বরং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভিসা সেবা প্রদান করার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। উক্ত সেকশনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা আবেদনের অপশনে যেসব দেশের নাম স্থান পেয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে।

আলোচিত দাবির বিষয়ে আমাদের অনুসন্ধান চলাকালে গত ৭ এপ্রিল বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রাপ্তির বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট ( ,, ) করতে দেখা যায়। পরবর্তীতে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেয়েছে এমন কয়েকজন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে তাদের ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চায় রিউমর স্ক্যানার টিম।

৭ এপ্রিল ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে ভিসা গ্রহণ করা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী বিবি চাঁদ সুলতানা রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “আমি তো বাংলাদেশ, ঢাকা এম্বাসি থেকে আবেদন করলাম অনলাইনে। তারপর গতকাল ভিসা ইন্টারভিউ দিয়ে এপ্রুভড হলাম। আজকে ভিসা ইস্যু হলো case file এ। বরং আমার মনে হলো এখন বাংলাদেশের US Embassy অনেক ফার্স্ট।  আমার অভিজ্ঞতা যদি বলি আমি মাত্র এক সপ্তাহেরও কম সময়ে ভিসা আবেদন করা, এম্বাসি ফি দিয়ে ইনিশিয়াল স্লট পাওয়া তারপর মাত্র ২০ মিনিটেই ইমার্জেন্সি রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট হয়ে ৭ এপ্রিলের ইন্টারভিউ ডেট পেয়ে ২৪ ঘন্টার ভিতর ভিসা ইস্যু হয়েছে।”

ভিসা পেতে ভারতের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,”এখানে ভারতের কোন সহযোগিতা ছিল না।”  

একই দিনে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে ভিসা পাওয়া প্রসঙ্গে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শাবনূর সিদ্দিকা রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “আমার কোনো ভারতের সহযোগিতা লাগেনি। বাংলাদেশ থেকেই পেয়েছি।”

৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক শিক্ষার্থী আসমা ইসলাম বলেন, “সব তথ্য সঠিক হলে এবং কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত না থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ায় কোনো জটিলতা নেই। বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করেই আমি সম্প্রতি ২০২৪ ফলে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেয়েছি। যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো ব্যক্তিকে তাদের দেশের জন্য ক্ষতিকারক মনে না করে এবং ওই ব্যক্তির  সব তথ্য-যুক্তি বৈধ হয় তাহলে অবশ্যই তাকে ভিসা প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বা ভারত-দুই দেশের ক্ষেত্রেই একই নিয়ম। বরং ভুয়া পাসপোর্টে কেউ ভিসা পেতে চাইলে জটিলতা আরও বাড়বে, রিজেক্ট হওয়ারও সম্ভাবনা বেশি। আমার ভিসা পেতে কোনো ভারতীয় মাধ্যমের প্রয়োজন হয়নি।” 

একই সময়ে উচ্চশিক্ষায় ভিসা পাওয়া প্রসঙ্গে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাথী কুন্ডু জানান, “আমার ভারতের কোনো সহযোগিতা তো দূরের কথা কোনো স্পেশাল এজেন্সির সহযোগিতা পর্যন্ত লাগেনি।”

উপরোক্ত তথ্য উপাত্ত থেকে এটা স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিদের নিয়মিতই ভিসা দিচ্ছে।

মূলত, গত ২০ মার্চ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে Voice of Bangladeshi Hindus নামক একটি অ্যাকাউন্ট থেকে দাবি করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশিদের ভিসা দিচ্ছে না। কিন্তু ভারতীয় পাসপোর্ট ইস্যু করে তারপর আমেরিকার ভিসার জন্য আবেদন করলে সহজেই ভিসা পাওয়া যাবে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাস থেকে বাংলাদেশিদের উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নিয়মিতই ভিসা দেওয়া হচ্ছে। এসব ভিসা পেতে কাউকেই ভারতের কোনো সহযোগিতা নিতে হচ্ছে না। গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত ভিসা নীতির কোথাও বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বন্ধ না দেওয়া নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। এই ভিসা নীতি কেবল নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত অসাধু ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। এর সাথে সাধারণ বাংলাদেশিদের ভিসা প্রাপ্তি প্রক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

সুতরাং, বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়া হয় না, ভিসা পেতে হলে ভারতের পাসপোর্ট ইস্যু করতে হয় শীর্ষক দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img