সম্প্রতি, ‘এক সাথে ছয় বান্ধবী বিসিএস ক্যাডার, একজন এডিসি, একজন আইসিটি অফিসার, একজন ইউএনও, দুইজন এসিল্যান্ড, একজন সিনিয়র সহকারী কমিশনার, মানে সবাই ক্যারিয়ারে সাকসেসফুল এবং সবার পোস্টিং একই জেলায়’ শীর্ষক দাবিতে হলুদ শাড়ি পরিহিত ৬ জন নারীর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও শর্ট ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম টিকটকে প্রচার করা হচ্ছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে টিকটকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভাইরাল ছবির উক্ত নারীরা কেউ কারো বান্ধবী নন বরং তারা শরিয়তপুর জেলায় প্রশাসনের বিভিন্ন পদে কর্মরত থাকাকালীন ২০২৩ সালের পহেলা ফাল্গুনে কিছু ছবি তুলেছিলেন, যা পরবর্তীতে উক্ত দাবিতে ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
ভাইরাল এসব পোস্টে আলোচিত ছবিগুলোর কপিরাইট হিসেবে ‘চিত্রকথা’ নামের একটি পেজের উল্লেখ পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে ‘চিত্রকথা – Chitro Kotha’ নামের উক্ত পেজটি’র সন্ধান পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। পেজটি’র বিস্তারিত বিবরণী পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এটি একটি ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি সম্পর্কিত পেজ। পেজটি শরিয়তপুর সদর থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে।
পেজটিতে ভাইরাল ছবিগুলো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে আলোচিত বিষয়টি নিয়ে একটি পোস্ট (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়।
পোস্টটিতে বলা হয়েছে, “যারা আমার পোস্ট টি কপি করতেছেন, আপনাদের দুইটা হাতে ধরে বলি প্লিজ ডোন্ট ডু দিস, করে থাকলে দয়া করে ডিলিট করে দিন। ছবিগুলো গতবছর পহেলা ফাল্গুনে তোলা ছিলো, ছবি গুলো তোলার জন্য তারা আমাকে ভালো অংকের পারিশ্রমিকও দিয়েছিলো, কিন্তু আমি পোস্ট করার আগে যেহেতু পারমিশন নেইনি তাই আমি এখন হুমকির মুখে। ছয়জন হাই প্রোফাইল ব্যক্তির ছবি পাবলিকলি শেয়ার করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্যের ব্যক্তিগত ছবি বিনা অনুমতিতে পাবলিশ করার জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা ও হয়ে যেতে পারে।”
সেখানে আরও বলা হয়, “পোস্ট টি বাংলাদেশ ব্যাপি ভাইরাল হয়ে যাবে এটা আমি ভাবিইনি, আমি গতকাল রাতেই ডিলিট করে দিছি, তারপরও এখন অব্দি অনেকেই তা পোস্ট করে যাচ্ছেন। আপনি হয়তো পপুলারি বা রিচ রিয়েক্ট পাওয়ার জন্য দিচ্ছেন কিন্তু এতে আমার ক্ষতি হচ্ছে…আপনি আমাকে চিনেন না, জানেন না, সম্পুর্ন অপরিচিত একজন মানুষ আমি, আপনি কি জেনে বুঝে আমার ক্ষতি করবেন? জানি করবেন না, কারণ আপনি একজন মানবিক ও ভালো মানুষ। তাই বলছি প্লিজ ডিলিট করে দিন।”
উক্ত পোস্টের শেষে পোস্টদাতা হিসেবে ‘Afridi’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট মেনশন করা হয়েছে। উক্ত অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, উক্ত অ্যাকাউন্টের মালিকই ‘চিত্রকথা – Chitro Kotha’ নামের পেজের মালিক ও প্রধান চিত্রগ্রাহক।
পরবর্তীতে উক্ত অ্যাকাউন্টটিতে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। জানা যায়, অ্যাকাউন্টটির মালিকের নাম তামিম আফ্রিদি। তিনিই ভাইরাল এই ছবিগুলো তুলেছিলেন।
তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “তারা কেউই বিসিএস এর আগে বান্ধবী ছিলোনা, বিসিএসের পর কর্মক্ষেত্রে একই জেলায় পোস্টিংয়ের কারণে তাদের সুসম্পর্ক তৈরি হয়। ছবিটি তোলা গত বছর তথা ২৩ সালের পহেলা ফাল্গুনে। গতবছর তারা সবাই শরীয়তপুর জেলায় থাকলেও এবছর তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন জেলায়।”
তিনি আরও বলেন, “ছবির চিত্রগ্রাহক এভাবে বুঝাতে চেয়েছেন, ধরুন ছয় বান্ধবী একসাথে বিসিএস ক্যাডার তাহলে কত সুন্দর একটা ব্যাপার হবে? কিন্তু নেটিজেনরা বুঝেছেন তারা ছয় বান্ধবী, পোস্ট উল্লেখ করা ছিলো একজন এডিসি এবং একজন নির্বাহী ম্যাজিস্টেট একজন মানুষ এতে এমনিতেই বুঝে যাওয়ার কথা যে এডিসি আর এসিল্যান্ড কখনো বান্ধবী হতে পারেনা, পদের দিক থেকে তারা অনেক সিনিয়র জুনিয়র।”
এই ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে ভাইরাল ছবিগুলোতে প্রদর্শিত নারীদের মধ্যে ৪ জনের নাম জানা যায়। তারা হলেন- শামসুন নাহার, হাছিবা খান, উম্মে সালমা রুমা এবং মনিজা মনি।
ম্যানুয়ালি অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের পরিচয় সম্পর্কে ‘বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ ওয়েবসাইটে অনুসন্ধান চালায় রিউমর স্ক্যানার টিম। আমরা ভাইরাল ছবির নারীদের মধ্যে ০৩ জনের পরিচয় নিশ্চিত হতে পেরেছি।
সরকারি ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, শামছুন নাহার বর্তমানে শরিয়তপুর জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি বিসিএস (প্রশাসন) ৩১ তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি ২০২২ সালের ০৫ ডিসেম্বর থেকে উক্ত পদে কর্মরত।
এছাড়াও, সরকারি ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, হাছিবা খান বর্তমানে নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি বিসিএস (প্রশাসন) ৩৪ তম ব্যাচের কর্মকর্তা। ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি বর্তমান কর্মস্থলে যোগদান করেন। যিনি পূর্বে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সরকারি ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, উম্মে সালমা রুমা বিসিএস (প্রশাসন) ৪০ তম ব্যাচের কর্মকর্তা যিনি বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি বর্তমান কর্মস্থলে যোগদান করেন। যিনি পূর্বে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (শিক্ষানবিশ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পরবর্তীতে রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে ভাইরাল ছবিতে থাকা নারী শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও
বর্তমানে নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাছিবা খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “আমরা কেউই বান্ধবী না, কলিগ ছিলাম। শরিয়তপুর জেলায় বিভিন্ন পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় গতবছর ছবিটি তোলা হয়েছিল। ফটোগ্রাফার ছেলেটি ভুল করে ওগুলো লিখে পোস্ট দিয়েছিল, পরে বুঝতে পেরে ডিলিট করেছে। ওগুলো সত্যি নয়।”
অর্থাৎ, উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, ভাইরাল ছবিগুলোতে প্রদর্শিত নারীরা কেউই বিসিএসের একই ব্যাচের কর্মকর্তা নন এবং তারা একে অপরের বান্ধবীও নন। বরং তারা ২০২৩ সালে একই জেলায় বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে কর্মরত সহকর্মী ছিলেন।
মূলত, সম্প্রতি ইন্টারনেটে ফাল্গুনের সাজে হলুদ শাড়ি পরিহিত ছয় জন নারীর কয়েকটি ছবি প্রচার করে দাবি করা হয় তারা একে অপরের বান্ধবী এবং তারা সবাই একসাথে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। আলোচিত পোস্টগুলোতে বলা হয়, এদের মধ্যে একজন এডিসি, একজন আইসিটি অফিসার, একজন ইউএনও, দুইজন এসিল্যান্ড এবং একজন সিনিয়র সহকারী কমিশনার। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত নারীরা কেউ কারো বান্ধবী নন। প্রকৃতপক্ষে তারা সবাই ২০২৩ সালে শরিয়তপুর জেলায় বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে কর্মরত ছিলেন। সেই বছরের পহেলা ফাল্গুন তারা একসাথে কিছু ছবি তুলেছিলেন, যা পরবর্তীতে উক্ত দাবিতে ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়।
সুতরাং, ৬ বান্ধবীর একসাথে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ভাইরাল এই গল্পটি বানোয়াট ও মিথ্যা।