সম্প্রতি ‘সরকার দাবি করে বিএনপি ও জামাত আগুন দিয়েছে, আসলে কে আগুন দিয়েছে নিচের ভিডিওতে দেখুন’ শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে।
যা দাবি করা হচ্ছে
একজন সংবাদকর্মী ও কয়েকজন পুলিশ সদস্য বিএনপি-পুলিশের সংঘর্ষ চলাকালে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। অথচ সরকার দাবি করে, সংঘর্ষ চলাকালে বিএনপি ও জামাত আগুন দিয়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে(আর্কাইভ), এখানে(আর্কাইভ), এখানে(আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

টিকটকে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে(আর্কাইভ), এখানে(আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র ডাকা মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সংঘর্ষে পুলিশ ও সাংবাদিক মিলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার কোনো ঘটনার নয়। প্রকৃতপক্ষে সংঘর্ষ চলাকালে টিয়ারশেলের ঝাঁঝের তীব্রতা থেকে আগুন জ্বালিয়ে একজন পুলিশ ও সংবাদকর্মীর রক্ষা পাওয়ার চেষ্টার সময় ধারণকৃত ভিডিওকেই ভিন্ন দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।
অনুসন্ধান যেভাবে
আলোচিত ভিডিওটি নিয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ভিডিওটিতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাছরাঙা টিভির একটি মাইক্রোফোন ও চ্যানেলটির লোগো সম্বলিত ভেস্ট পরিহিত একজন সংবাদকর্মীকে দেখা যায়। যেখানে তাকে কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ কাগজ সদৃশ কোনো বস্তুতে আগুন ধরানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়।

এসব সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিডিওটিতে দৃশ্যমান সংবাদকর্মীর নাম মাহমুদ কমল। তিনি মাছরাঙা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার।
পরবর্তীতে তার কাছে ভিডিওটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, সংঘর্ষের দিন বাতাসে ছড়িয়ে পড়া টিয়ারশেল গ্যাসে আক্রান্ত হতে হয় পুলিশ, সাংবাদিকসহ আশপাশে থাকা প্রত্যেকটি মানুষকে। যেকোনো কিছুতে আগুন ধরিয়ে এই টিয়ারশেলের ঝাঁঝের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে হয়। আগুনের ধোঁয়া এই গ্যাসের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। তেমনই একটি মুহূর্তে নিজেকে ও আক্রান্ত কয়েকজন পুলিশ সদস্য রক্ষা করতে কাগজে আগুন ধরানোর চেষ্টা করি। যদিও আগুন ধরিয়ে ঝাঁঝ থেকে বাঁচার চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ যেটাতে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেছিলাম তা প্লাস্টিক জাতীয় কিছু হওয়ায় আগুন ধরেনি। ভিডিওটিতেও দেখা যায় সেটি। সেই সময়ের একটি ভিডিও ধারণ করে নাগরিক টেলিভিশন।
পাশাপাশি তিনি রিউমর স্ক্যানারের সাথে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্টও শেয়ার করেন। যেখানে তিনি ২৮ অক্টোবরের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। পোস্টটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
তার এ বর্ণনা সূত্রে পরবর্তীতে বেসরকারি টিভি চ্যানেল নাগরিক টিভির ফেসবুক পেজে গত ২৮ অক্টোবর ‘মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ! | BNP News | 28 October Shomabesh | Nagorik TV (আর্কাইভ)’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত ৩ মিনিট ৪২ সেকেন্ডের মূল ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটির ৪০ সেকেন্ড থেকে প্রায় ৫৯ সেকেন্ড পর্যন্ত সময়কালের সঙ্গে ইন্টারনেটে পুলিশ ও সাংবাদিক মিলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

এই ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে সংবাদকর্মী মাহমুদ কমলের দেওয়া বর্ণনার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটিতে দেখা যায়, সংবাদকর্মী মাহমুদ কমল ও কয়েকজন পুলিশ সদস্য কাগজ জাতীয় কিছুতে আগুন ধরানোর চেষ্টা করছেন। তবে সেটিতে আগুন ধরতে দেখা যায়নি।
এছাড়া ভিডিওটি সূক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা কাগজ জাতীয় যে বস্তুটিতে আগুন ধরানোর চেষ্টা করছেন সেটি সাধারণ কোনো কাগজ নয় বরং রঙিন প্লাস্টিকের তৈরি পোস্টার জাতীয় কিছু ছিল। ফলে সেখানে আগুন ধরেনি।
পাশাপাশি নাগরিক টিভির প্রতিবেদনটিতেও এমন কোনো তথ্যের উল্লেখ করা হয়নি, যার দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে, তারা কোথাও আগুন লাগিয়ে দিচ্ছেন।
উপরিউক্ত বর্ণনা ও নাগরিক টিভির মূল ভিডিও বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, ২৮ অক্টোবর সংঘর্ষের সময় ঐ সংবাদকর্মী ও পুলিশ সদস্যরা মূলত টিয়ারশেলের ঝাঁঝের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছিলেন।
টিয়ারশেলের ঝাঁঝের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে আগুন
একাধিক গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলে দেখা যায়, বিভিন্ন সংঘর্ষ ও বিক্ষোভ চলাকালে টিয়ারশেল ছোড়া হলে ঝাঁঝের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে আগুন জ্বালানোর চর্চা আছে।
২৮ অক্টোবর সংঘর্ষ চলাকালে সেখানে উপস্থিত থাকা প্রতিদিনের বাংলাদেশের স্টাফ রিপোর্টার আবু বকর রায়হান রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, সেদিন বাতাসের কারণে পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেলের ঝাঁঝ আমাদের দিকে আসছিলো। তখন অনেককেই দেখেছি আগুন জ্বালিয়ে এর থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমিও নিজেই তাই করেছি।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা২৪.কমের অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদক আল-আমিন রাজু বলেন, টিয়ারগ্যাস তাৎক্ষণিকভাবে খুবই কষ্টের একটা মুহূর্ত তৈরি করে। আমি নিজেও ২৮ অক্টোবর একাধিকবার টিয়ারগ্যাসের মুখোমুখি হয়েছি। টিয়ারগ্যাস থেকে বাঁচতে আগুন তৈরি করে কষ্ট কমানোর চেষ্টা করে। এমন কি যারা টিয়ারগ্যাস মারে সেই পুলিশও এর বাইরে না। তারাও পিকেটারদের সরিয়ে দিয়ে নিজেরা বাঁচতে আগুন জ্বালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে৷ তবে সেই আগুন বড় নয়, বড়জোড় একটি কাগজের টুকরো। পেশাগত কাজে পুলিশের পাশাপাশি সাংবাদিকদের কাজ করার কারণে এমনটা করে থাকে৷ এখানে গুজব ছড়িয়ে বিষয়টা ঘোলাটে করার অপচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।
দৈনিক নয়া শতাব্দীর স্টাফ রিপোর্টার (ক্রাইম) জাফর ইকবাল বলেন, বিভিন্ন ক্রাইসিসে তথ্য সংগ্রহে আমাদের মাঠেঘাটে কাজ করতে হয়। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এসব টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় চোখ মারাক্তক জ্বলে, একদম তাকানো যায় না। এমন পরিস্থিতিতে আমরা সাধারণত আগুন জ্বালিয়ে নিজেদের টিয়ারশেলের ধোঁয়া থেকে সেভ করে থাকি। আগুনে টিয়ারশেলের ধোঁয়ার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। এটা একটা সাধারণ প্রক্রিয়া।
এছাড়া গণমাধ্যম সূত্রেও টিয়ার শেল থেকে রক্ষা পেতে ২৮ অক্টোবর বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের আগুন জ্বালানোর খবর পাওয়া যায়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন
- সংঘাত আগুন প্রাণহানি হরতাল (সমকাল)
- সংঘর্ষের পর বিএনপির হরতালের ডাক (বিডিনিউজ২৪)
প্রসঙ্গত, গত ২৮ অক্টোবর সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রাজধানীতে মহাসমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তবে পরবর্তীতে এ মহাসমাবেশ ঘিরে বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পুলিশের হিসাবে নয়াপল্টন ও আশপাশ এলাকায় অ্যাম্বুলেন্স,পুলিশের গাড়ি, বাসসহ ৮৭টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৪১টি ও ১০টি ভ্যান এবং রিকশা রয়েছে।
এর মধ্যে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট পরিহিত এক যুবককে শনাক্ত করেছে পুলিশ। গণমাধ্যম থেকে পুলিশের বরাতে জানা যায়, বাসে আগুন দেওয়া ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট পরিহিত ওই যুবক হলেন রবিউল ইসলাম নয়ন। তিনি যুবদল ঢাকা দক্ষিণের সদস্য সচিব।
মূলত, গত ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে মহাসমাবেশের ডাক দেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তবে পরবর্তীতে এ মহাসমাবেশ ভণ্ডুল হয়ে যায় এবং বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেলের ঝাঁঝের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে মাছরাঙা টিভির একজন সংবাদকর্মী ও কয়েকজন পুলিশ সদস্য কাগজ জাতীয় বস্তুতে আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সে সময়ের ধারণকৃত একটি ভিডিওকেই সম্প্রতি বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংগঠিত সংঘর্ষে পুলিশ ও সাংবাদিক মিলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, পূর্বেও বিএনপি’র এই মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়ানো হলে তা শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
- খিচুড়ি খেয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের অসুস্থ হওয়ার ভুয়া দাবি প্রথম আলো ও কালবেলার নকল ফটোকার্ডে প্রচার
- কালবেলা’র নকল ফটোকার্ডে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরকে জড়িয়ে ভুয়া তথ্য প্রচার
সুতরাং, টিয়ার শেলের ঝাঁঝের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে পুলিশ ও সাংবাদিকের চেষ্টাকে বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংগঠিত সংঘর্ষে পুলিশ ও সাংবাদিক মিলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার দৃশ্য দাবিতে ইন্টারনেটে একটি ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে; যা সত্য নয়।
তথ্যসূত্র
- Nagorik TV: ‘মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ! | BNP News | 28 October Shomabesh | Nagorik TV (আর্কাইভ)
- Mahmud Komol Facebook Post: Mahmud Komol Facebook Post (আর্কাইভ)
- Samakal: সংঘাত আগুন প্রাণহানি হরতাল
- BDnews24: সংঘর্ষের পর বিএনপির হরতালের ডাক
- Protidiner Bangladesh: মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারাদিনে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও হামলার সারসংক্ষেপ
- Bangla Tribune: গাড়িতে আগুন দেওয়া সেই ভেস্ট পরা যুবক শনাক্ত