ইসলাম প্রসঙ্গে নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামসের মন্তব্য দাবিতে বিবিসিকে উদ্ধৃত করে ভুয়া তথ্য প্রচার

সুনিতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর, নাসার এই দুই মহাকাশচারী গত বছরের জুন মাস থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) অবস্থান করছিলেন। মূলত, তাঁরা বোয়িংয়ের স্টারলাইনার মহাকাশযানে করে একটি আট দিনের মিশনে সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে, স্টারলাইনার মহাকাশযানের ত্রুটির কারণে তাঁদের পৃথিবীতে ফিরে আসা বিলম্বিত হয়। প্রায় ৯ মাস পর তাঁরা নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরেন।

এরই প্রেক্ষিতে, বিবিসির বরাত দিয়ে একটি বার্তা ইন্টারনেটে প্রচারিত হচ্ছে, যাতে দাবি করা হয়েছে সুনিতা উইলিয়ামস বলেছেন তিনি মহাকাশে কুরআন পাঠ করতেন এবং সেখানে কম খাওয়া ও পান করার জন্য রমজানের রোজা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি কুরআনকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন এবং এর বৈজ্ঞানিক দিকগুলো নিয়ে গবেষণা করতে চান।

 ৯ মাস মহাকাশে কাটিয়ে এক সপ্তাহের মিশন থেকে ফিরে এসে সুনিতা সাংবাদিকদের যা বলেছিলেন তা এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার একটি আলোচিত বিষয় উল্লেখ করে বিবিসির বরাত দিয়ে সুনিতা উইলিয়ামসের মন্তব্য দাবিতে প্রচারিত বার্তায় যা দাবি করা হচ্ছে,

১. আমার মনে হচ্ছে এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল যে আমি মহাকাশে আটকা পড়ি। যখন আমার বয়স ২০ দিন, তখন আমি এমনভাবে বেঁচে ছিলাম যেন আমি মৃত্যুর মুখোমুখি। যখন আমি ভাবছিলাম যে এখন আমার কাছে থাকা খাবার এবং জল ফুরিয়ে গেছে, তখন কীভাবে এগিয়ে যাব, তখন আমার মুসলিমদের রোজার মাসের কথা মনে পড়ে গেল।  সেই দিন থেকে, আমি সন্ধ্যায় অল্প খাবার এবং জল পান করব, এবং সকালে অল্প জল।  এক মাস পর, আমি সুস্থ এবং সতেজ বোধ করলাম।  আমি বুঝতে পারলাম যে আমি আরও কিছুক্ষণ ধরে রাখতে পারব। 

২. যখন আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলাম, তখন আমি কম্পিউটার খুললাম এই ভেবে যে আমি একদিন বাইবেল পড়ব।”  আমি এটি আগে অনেকবার পড়েছি, তাই মাত্র এক পৃষ্ঠা পড়ার পরই আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তখনই আমার আবার কুরআন পড়ার ইচ্ছা জাগলো (এখন মনে হচ্ছে এটি আমাকে এক ধরণের শক্তি দিয়েছে)। আমি এটি ডাউনলোড করে (ইংরেজি অনুবাদ) পড়া শুরু করলাম।  ১০-১৫ পৃষ্ঠা পড়ার পর আমি অবাক হয়ে গেলাম।  এর মধ্যে ভ্রূণতত্ত্ব, গভীর সমুদ্র এবং আকাশ, এটি ছিল আশ্চর্যজনক। আমার মনে হলো পৃথিবীকে এটা বলা উচিত। 

৩.  মহাকাশ থেকে দেখলে সূর্যকে মনে হয় যেন এটি কাদার গর্তে বসে আছে। মাঝে মাঝে আমি উপর থেকে কিছু শব্দ শুনতে পাই, যেমন মন্ত্র জপ করা, আমার মনে হয়েছিল এটা আরবি ভাষার মতো।  আমার ভ্রমণসঙ্গী, ব্যারি উইলমোর, আমাকে বলেছিলেন যে আমি প্রতিদিন কুরআন পড়ি বলেই এমনটা হয়েছে। এরপর, আমি গভীরভাবে কুরআন পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং তাফসীরগুলো ডাউনলোড করলাম। এটা একটা দারুন অভিজ্ঞতা ছিল। আমি তাৎক্ষণিকভাবে ইলন মাস্ককে ফোন করে বিষয়টি জানাই।  তিনি বললেন, খুব শীঘ্রই তিনি তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে বিষয়টি শেয়ার করবেন। 

৪. এখন তুমি অবাক হবে… কিছু দিন আমরা আমাদের মহাকাশ স্টেশনের দিকে ছুটে আসা বড় উল্কাপিণ্ড দেখে ভীত হব।’  যেহেতু আর কোন উপায় ছিল না, আমরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম এবং অলৌকিকভাবে, কিছু ছোট গোলাকার আলো (যা দেখতে তারার মতো) উড়ে এসে ভিতরের সবকিছু ধ্বংস করে দিত।  যখন আমরা এটির দিকে তাকাই, তখন মনে হয় আমরা এটির দিকে তারা ছুঁড়ে মারছি।  এটা আমাদের অবাক করেছে। নাসা শীঘ্রই এই বিষয়ে আরও তদন্ত পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 

 তাই ৮ মাস পর, আমি পুরো কুরআন পড়ে ফেললাম। আমার মনে হতে লাগলো যে আমি আবার পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারব। আমি অনুভব করলাম এক অসাধারণ আত্মবিশ্বাস আমাকে ভরে দিয়েছে।

৫. এপ্রিল মাসে, যখন সূর্য অস্ত যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন একটি ইউনিকর্ন (উড়ন্ত ঘোড়া) সদৃশ একটি প্রাণী উপর থেকে পৃথিবীতে নেমে আসতে দেখা গেল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পৌঁছানোর পর, এটি আর দৃশ্যমান ছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম না এটা কোথা থেকে আসছে, তাই আমি আর আমার ব্যারি উইলিমোর এটা দেখতে শুরু করলাম। আমার কাছে মনে হচ্ছে এটি উপরের একটি বিশেষ স্তর থেকে নেমে আসছে, এবং আমি বুঝতে পারি যে আকাশের একাধিক স্তর রয়েছে।  আমরা যতই ভেবেছি, তবুও বুঝতে পারছি না কেন এই উড়ন্ত ঘোড়াগুলো সেখানে ছিল না।  ঠিক তখনই আমি নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটি দেখি যে হাডসন নদীর উপর অর্ধচন্দ্র দেখা যাচ্ছে এবং খবরটি আসে যে মুসলিমদের রোজা শুরু হয়েছে ২রা মার্চ।  তখন থেকেই নজাঙ্গাল এই ঘটনাটি দেখছে। পরবর্তী দিনগুলিতে, আমরা বুঝতে পারলাম যে পৃথিবীতে উপবাস ভাঙার সময় এসেছে।  আমার মনে হয় তারা হলেন ফেরেশতা যারা ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে আসে। 

৬. এখন আমার মনে হচ্ছে কুরআন সত্য। এখন আমার গবেষণা হবে কুরআনের বিজ্ঞানের উপর।  ভ্রূণবিদ্যা, গভীর সমুদ্র বিজ্ঞান।  আমি জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে সবকিছু শিখতে চাই। কুরআনের অতিপ্রাকৃত শক্তি আবিষ্কারের জন্য নাসায় একটি নতুন বিভাগ শুরু করার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

এছাড়াও, দাবি করা হয়, ট্রাম্প সরকার এর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ করবে কিনা তা নিয়েও সুনিতা তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। 

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মহাকাশে কুরআন পাঠ ও রমজানের রোজা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার বিষয়ে সুনিতা উইলিয়ামসের মন্তব্য দাবিতে বিবিসি এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি বরং, কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই বিবিসির বরাত দিয়ে আলোচিত বার্তা ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে। তাছাড়া, সুনিতা উইলিয়ামসও এমন কোনো মন্তব্য করেননি।

দাবির সত্যতা যাচাইয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ এবং বিবিসির ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করে আলোচিত দাবির বিষয়ে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও, অন্যান্য গণমাধ্যমেও এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে, বিবিসি এর ওয়েবসাইটে ‘Butch Wilmore and Suni Williams return to Earth after nine unplanned months in space’ তাদের অবতরণের একটি লাইভ কভারেজ খুঁজে পাওয়া যায়।

জানা যায়, ফ্লোরিডার উপকূলে স্পেসএক্স ক্রু-৯ এর সফল স্প্ল্যাশডাউনের পর লাইভ কভারেজটি নাসা এবং স্পেসএক্স সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহাকাশচারীরা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না, তবে নাসা কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে তারা ভালো আছেন। তবে, তারা যোগ করেছেন যে মাধ্যাকর্ষণ সাথে পুনরায় মানিয়ে নিতে তাদের কিছু সময় লাগবে এবং পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার আগে উভয় মহাকাশচারীর চিকিৎসা মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

এছাড়াও, বিবিসির ওয়েবসাইটে ‘Astronauts Butch and Suni finally back on Earth’ শীর্ষক শিরোনোমে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মহাকাশে থাকাকালীন সাক্ষাৎকারে বুচ এবং সানি বলেছিলেন যে তারা তাদের প্রত্যাশার চেয়ে দীর্ঘ অবস্থানের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত ছিলেন – তবে বাড়িতে ফিরে তারা কিছু জিনিসের জন্য উন্মুখ ছিলেন।

গত মাসে সিবিএসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সানি উইলিয়ামস বলেছিলেন, “আমি আমার পরিবার, আমার কুকুরদের দেখতে এবং সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে আগ্রহী। পৃথিবীতে ফিরে আসা এবং পৃথিবীর অনুভূতি পাওয়াটা সত্যিই ভালো হবে।”

অর্থাৎ, নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামস মহাকাশে কুরআন পাঠ ও রোজা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন দাবি করে সুনিতাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি।

এছাড়া, প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চ করে অন্য কোনো গণমাধ্যমেও সুনিতার এমন কোনো মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সুতরাং, বিবিসিকে উদ্ধৃত করে ইসলাম প্রসঙ্গে নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামসের মন্তব্য দাবিতে ইন্টাররেটে প্রচারিত বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img