সম্প্রতি, “আলু এবং মাখন এই দুটি খাবার খেয়ে মানুষ সারাজীবন বেঁচে থাকতে পারে। কারণ এই খাবারে আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, খনিজ এবং নিউট্রেশন রয়েছে।” শীর্ষক দাবি সংবলিত একটি ডিজিটাল ব্যানার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে। উক্ত পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, “আলু এবং মাখন এই দুটি খাবার খেয়ে মানুষ সারাজীবন বেঁচে থাকতে পারে” শীর্ষক দাবিটি এককভাবে সত্য নয় বরং এই জাতীয় খাদ্যতালিকায় একজন ব্যক্তি দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে কিনা তা অন্যান্য স্বাস্থ্যগত কারণের উপর নির্ভর করবে।
আলু এবং মাখন এই দুটি খাবার খেয়ে মানুষ সারাজীবন বেঁচে থাকতে পারে কিনা তা যাচাই করার আগে আমাদের জানতে হবে বেঁচে থাকতে আমাদের কী ধরনের খাদ্য কত পরিমাণে প্রয়োজন? জানতে হবে, প্রয়োজনীয় কত ধরনের খাদ্য রয়েছে এবং এর ব্যতিক্রম ঘটলে কী হতে পারে ইত্যাদি তথ্য।
সুষম খাদ্য কী?
আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে খাবারগুলো খেয়ে থাকি এতে মূলত ছয় ধরনের খাদ্য উপাদান রয়েছে। এগুলো হচ্ছে: শর্করা, আমিষ, স্নেহ, ভিটামিন, মিনারেল এবং পানি। মানবদেহের স্বাভাবিক পুষ্টির চাহিদা পুরনের জন্য আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে উক্ত ছয়টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবারগুলো সঠিক অনুপাতে থাকলে তাকে সুষম খাদ্য বলে।
সাধারণত, আমাদের দেহে সব খাদ্য উপাদানের চাহিদা সমান নয়। খেয়াল করলে দেখা যায় যে, একজন মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ভাত, রুটি, আলু অর্থাৎ শর্করা জাতীয় খাবারগুলোর পরিমাণই সবচেয়ে বেশি থাকে। শর্করার পর মানুষেরা তালিকায় থাকে শাক-সবজি, মাছ ,ডিম এবং অন্যান্য খাবার।
আর এভাবে একটি খাদ্য তালিকায় শর্করার পরিমাণ বেশি রেখে এবং শর্করাকে নিচু স্তরে রেখে পর্যায়ক্রমে পরিমাণগত দিক বিবেচনা করে শাকসবজি, ফলমূল, আমিষ, স্নেহ ও চর্বি জাতীয় খাদ্যকে সাজালে যে কাল্পনিক পিরামিড তৈরি হয় তাকে আদর্শ খাদ্য পিরামিড বলে। খাদ্য পিরামিড থেকে কোন ধরনের খাবার কতটুকু পরিমাণে খেলে তা সুষম খাদ্য গ্রহণ করা হবে তার ধারণা পাওয়া যায়।

সুষম খাদ্য কেন প্রয়োজন?
সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে গেলে খাদ্যের এই ছয়টি উপাদানই আমাদের জন্য অতীব গুরুত্তপূর্ণ। কেননা খাদ্যের এই ছয়টি উপাদানের মধ্যে একেকটির কাজ বা ভূমিকা একেক রকম। আবার এই খাদ্য উপাদানগুলোর কোনো একটির অভাব দেখা দিলে মানবদেহে নানা ধরনের প্রতিকূলতা দেখা দিতে পারে। মানব দেহে কোন খাদ্য উপাদান কোন ধরনের ভূমিকা পালন করে তার একটি ছোট বিবরণী নিম্নে তুলে ধরা হলো:
- শর্করার কাজ: শর্করা হচ্ছে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির প্রধান জোগানদাতা। শর্করা ভেঙে গ্লুকোজ তৈরি হয়। এই গ্লুকোজ আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে। তাই মানুষের প্রতিদিনের খাবারে মোট ক্যালরির ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শর্করা থাকা উচিত।
- প্রোটিনের কাজ: দেহের ক্ষয়পূরণ, শক্তির জোগান ও দৈহিক বৃদ্ধিসাধনকে ত্বরান্বিত করা।
- ফ্যাট/স্নেহের কাজ: দেহের শক্তির জোগান, কোষের বৃদ্ধিতে সহায়তা করা, শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
- ভিটামিনের কাজ: দেহের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভিটামিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাখে। যেমন: আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, নার্ভকে সুস্থ্য রাখা ইত্যাদি।
- মিনারেলের কাজ: দেহের হাড় এবং দাতের সুরক্ষায়, কোষ অভ্যন্তরীণ তরল পদার্থের চলাচল নিয়ন্ত্রণ, এবং খাদ্য সঞ্চিত শক্তিকে দৈহিক শক্তিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে মিনারেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- পানির কাজ: খাদ্যের ছয়টি উপাদানের মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি। বলা হয়ে থাকে ‘পানির অপর নাম জীবন’। কারণ কোষের প্রোটোপ্লাজমের ৯০ শতাংশই পানি। যদি কোনো কারণে প্রটোপ্লাজমে পানির পরিমাণ কমে যায় তাহলে সেই প্রোটোপ্লাজম সংকুচিত হয়ে মরে যেতে পারে। এ ছাড়া জীবদেহে যত বিপাকীয় বিক্রিয়া চলে তা পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তাই অনেক সময় পানিকে ‘ফ্লুইড অফ লাইফ’ বলা হয়। মানব দেহে তাপের সমতা বজায় রাখা, বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন, দেহের মধ্যে খনিজ পদার্থের চলাচল সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পানি করে থাকে। উল্লেখ্য যে, মানবদেহের শতকরা ৬০% ই হচ্ছে পানি।
তাই, একজন ব্যক্তির সামগ্রিক সুস্বাস্থের জন্য দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় অবশ্যই সুষম খাদ্য নিশ্চিত করে অতি আবশ্যক। কারণ শুধু এক ধরনের খাবার দিয়েই শরীরের সব ঘাটতি পোষানো সম্ভব নয়।
শুধু আলু এবং মাখন খাওয়ার মাধ্যমে কি একজন মানুষের সারাজীবন বেঁচে থাকা সম্ভব?
সাধারণত আলু কার্বোহাইড্রেট এর খুব ভালো একটি উৎস। প্রতি ১০০ গ্রাম আলুর মধ্যে প্রায় ২০ গ্রাম শর্করা রয়েছে। তবে এটিতে প্রোটিনের পরিমাণ খুবই কম। তাছাড়া এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পটাসিয়াম, ভিটামিন B এবং C থাকলেও এতে ভিটামিন A, D সহ বিভিন্ন খনিজ লবণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের মধ্যেই শুধু আলু খাওয়ার (Potato Based Diet) মাধ্যমে ওজন কমানোর প্রবণতা রয়েছে। যেমন: বিজ্ঞান ভিত্তিক সাইট Live Science এর এই প্রতিবেদনে Chris Voigt নামক একজন ব্যক্তির টানা ২ মাস শুধু আলু খাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। যদিও তিনি ওই ডায়েট ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই করেছেন। তবে, উক্ত প্রতিবেদনে প্রফেসর Barry Swanson নামের একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, আলু স্বাস্থ্যকর খাবারের একটি ভালো উৎস হতে পারে কিন্তু শুধু একক ডায়েট হিসেবে এটি স্বাস্থ্যকর নয়।
আবার, Live Science এর এই প্রতিবেদনে বলা হয় যে অধিকাংশ ডায়েটিশিয়ানরা খাদ্য হিসেবে এককভাবে অধিক পরিমাণে আলু খাওয়াকে উৎসাহিত করেননা। কারণ শুধু আলু খাওয়ার মাধ্যমে আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ২০ টি অ্যামিনো অ্যাসিড এবং প্রায় ৩০ রকমের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের ঘাটতি পূরণ সম্ভব না।
স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট HealthyfyMe এর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “যদিও আলুতে অধিক পরিমাণ ফাইবার এবং প্রয়োজনীয় কিছু নিউট্রিশন রয়েছে তবে কেউ যদি তার খাদ্য তালিকায় শুধু আলুকেই বেছে নেয় তবে তার মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
তাছাড়া স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথলাইনে, দ্রুত ওজন কমানোর ক্ষেত্রে (Potato Diate) কে এক প্রকার নিরুতসাহিত করা হয়েছে। হেলথ লাইন ডায়েট স্কোর হিসেবে আলুর ডায়েট কে ৫ এ মাত্র ১.০৮ দেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া আলুর মধ্যে যেহেতু অধিক মাত্রায় পটাসিয়াম রয়েছে তাই দীর্ঘদিন ধরে খাবার হিসেবে শুধু আলু খেলে একজন মানুষের বৃক্কে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া যাদের ইতিমধ্যে chronic kidney disease (CKD) রয়েছে তাদেরকে আলুর মতো উচ্চ পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার কম খাওয়া উচিত।
অর্থাৎ, আলু এবং মাখনের মধ্যে আমাদের দেহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পুষ্টি উপাদান থাকলেও একজন মানুষের সর্বোত্তম স্বাস্থ্যের জন্য এই পুষ্টি যথেষ্ট নয়।
অপরপক্ষে, আলুর পাশাপাশি মাখনের বেলায়ও একজন মানুষের বেশ কয়েকটি ব্যাপারে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। মাখনে রয়েছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট। তাই কোনো ব্যাক্তি দীর্ঘদিন যদি খাদ্য হিসেবে আলুর পাশাপাশি মাখন খায় তাহলে তার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ মাখনে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাট আমাদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া মাখনে আমাদের দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন এবং মিনারেলের পরিমাণ খুবই কম।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় সংক্রান্ত নিউজ এবং রিসার্চপেপার দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
উল্লেখ্য যে, স্বাস্থ্য বিষয়ক ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান THIP এর এক ফ্যক্টচেকিং প্রতিবেদনে সার্টিফাইড ডায়েটিশিয়ান এবং স্বাস্থ্য প্রশিক্ষক এর বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে “ শুধু আলু ও মাখন খেয়ে সারাজীবন বেঁচে থাকা সম্ভব নয়” (সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে)। প্রতিবেদনটিতে তিনি হার্ভার্ডের একটি সমীক্ষার বরাতে আরো জানিয়েছেন যে, “নিয়মিত আলু এবং মাখন একত্রে খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। আলু ভাজা, বেক করা বা ম্যাশড (মাখন যুক্ত করা সহ) এর ফলে ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এর ঝুঁকি রয়েছে।”
মূলত, শুধু আলু ও মাখনভিত্তিক ডায়েটের মাধ্যম একজন মানুষের অনির্দিষ্টকালের জন্য বেঁচে থাকা সম্ভব হলেও এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। এই অনির্দিষ্টকালের দাবিটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় সারা জীবন বেঁচে থাকা সম্ভব হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। বিদেশী ভাষা থেকে দাবিটি পরবর্তীতে রূপান্তর হয়ে বাংলা ভাষায়ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, দাবিটি এককভাবে সত্য নয় বরং এই জাতীয় খাদ্যতালিকায় একজন ব্যক্তি দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে কিনা তা অন্যান্য স্বাস্থ্যগত কারণের উপর নির্ভর করবে। তাছাড়া এটি মানব শরীরের জন্য শুধু অস্বাস্থ্যকরই নয় বরং দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের ডায়েট ফলো করলে নানান প্রকার রোগ বালাইয়ের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Snopes এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী; স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু আলু ও মাখন ভিত্তিক ডায়েটের ওপর ভিত্তি করে একজন মানুষ কেবলমাত্র বেঁচে থাকতে পারে, তবে ‘বেঁচে থাকার’ এই সময়সীমা সারাজীবন নয়, বরং অনির্ধারিত। উক্ত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় একজন মানুষের কোনো রকমে বেঁচে থাকা আর ভালোভাবে সুস্বাস্থ্য এবং কর্মক্ষমতার সাথে বেঁচে থাকার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আলু এবং মাখন ভিত্তিক ডায়েট আপনাকে অনির্ধারিত সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারবে কিন্তু এটি স্বাস্থ্যকর এবং সুষম নয়।
সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত “আলু এবং মাখন এই দুটি খাবার খেয়ে মানুষ সারাজীবন বেঁচে থাকতে পারে” শীর্ষক দাবি প্রচার করা হচ্ছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Food Data Central || Nutrition Value of Potatoes Per 100g
- Live Science || Man Eating Nothing But Potatoes for 2 Months.
- Live Science || Dieticians do not recommend a high potato consumption diet because it is almost impossible to get all 20 essential amino acids and 30 vitamins and minerals from one food. A mix of white and sweet potatoes would, however, get you closer than most foods.
- HealthyfyMe || Everything You Need to Know About the Potato Diet.
- Helthline || Diet Score: 1.08 out of 5
- Harvard T.H. Chan School of Public Health || Consuming high amounts of saturated fats linked to increased heart disease risk.
- Food Navigator Europe || In the UK for example it’s recommended men it no more than 30g of saturated fat a day no more than 20g.
- NCBI || Saturated Fat Consumption and Risk of Coronary Heart Disease and Ischemic Stroke: A Science Update
- NCBI || Dietary Saturated Fats and Health: Are the U.S. Guidelines Evidence-Based?
- Healthline || 5 Studies on Saturated Fat — Time to Retire the Myth?
- THIP || Fact Check: Can you survive by eating only potatoes and butter?
- Snopes || Can a Person Live Off of a Diet of Potatoes and Butter?