তুরস্কে ভূমিকম্প: তুর্কি প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক ঘোষণা শীর্ষক দাবিটি বিভ্রান্তিকর

সম্প্রতি, তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে “তুর্কি প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক ঘোষণা” শিরোনামে কিছু তথ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। 

কী দাবি করা হচ্ছে?

ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, “ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান।

তিনি আজ এক বার্তায় বলেন – আল্লাহ যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে। আপনারা যা হারিয়েছেন, তা আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না। তবে আপনাদের হতাশ হবার কিছু নেই। এক লিরাও (তুর্কি মুদ্রা) কাউকে দিবেন না। আমি সকলকে এর চেয়ে উন্নত ঘরবাড়ি প্রস্তুত করে দিব ইনশাআল্লাহ। তিনি আরও বলেন – যে একটি গাছ হারিয়েছে, আমি তাকে দশটি গাছ দিব।এভাবেই তিনি নাগরিকদের আশ্বস্ত করেন। আল্লাহ তা’আলা  তাকে সর্বোত্তম বিনিময় দিন……।  আমীন।”

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

Screenshot source : Tiktok

একই দাবিতে টিকটকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, তুর্কি প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক ঘোষণা শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়াই এরদোয়ানকে উদ্ধৃত করে উক্ত দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। 

গত ০৬ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ তুরস্ক এবং উত্তর সিরিয়ায় বিধ্বংসী ভূমিকম্পে অসংখ্য  মানুষের মৃত্যুর খবর আসে গণমাধ্যমে।  তুরস্কের সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্পের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান সকলকে উন্নত বাড়ি তৈরি করে দেওয়া এবং যে একটি গাছ হারিয়েছে তাকে দশটি গাছ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে ঐতিহাসিক এক ঘোষণা দিয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। 

গুজবের সূত্র ধরে অনুসন্ধান

অধিকাংশ পোস্ট একটি ছবি ব্যবহার করে ছড়িয়েছে। ছবিতে এরদোয়ানকে এক শিশুকে চুমু দিতে দেখা যাচ্ছে। উক্ত ছবির নিচে আলোচিত ঐতিহাসিক ঘোষণাটি উল্লেখ করা হয়েছে। ছবিটিতে ‘Fatih News 24’ নামক একটি ফেসবুক পেজের ইউজারনেম দেওয়া হয়েছে। 

কিওয়ার্ড সার্চ করে উক্ত পেজে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রকাশিত উক্ত বিষয়ের মূল পোস্টটি (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot source : Facebook

পোস্টে তথ্যগুলোর কোনো সূত্র না থাকায় পেজের এডমিনের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। পেজটির এডমিন রিউমর স্ক্যানারকে জানান, তারা যে উৎস থেকে উক্ত তথ্যগুলো পেয়েছেন সেটি ছিল একটি আরব চ্যানেল। কিন্তু চ্যানেলটির সূত্রের লিংক দিতে পারেননি তিনি। 

পোস্টটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেখানে লেখা রয়েছে, “প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আজ এক বার্তায় উক্ত ঘোষণা দিয়েছেন।” 

পোস্টটি ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হওয়ায় ‘আজ’ বলতে ৮ ফেব্রুয়ারিকে বোঝানো হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। 

এই তথ্যের সূত্র ধরে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সেদিন (৮ ফেব্রুয়ারি) কোনো বক্তব্য দিয়েছেন কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

তুরস্কের প্রেসিডেন্টের ‘Presidency Of The Republic Of Turkey’ নামে একটি অফিশিয়াল ওয়েবসাইট রয়েছে। সাইটটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, প্রেসিডেন্টের নিয়মিত কার্যক্রমের আপডেট এই সাইটে দেওয়া হয়ে থাকে। 

ওয়েবসাইটটি থেকে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ৮ ফেব্রুয়ারি বেশ কিছু স্থানে কর্মসূচী ছিল। 

এরদোয়ান সেদিন শুরুতেই যান তুরস্কের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের শহর কাহরামানমারাসে (kahramanmaraş)। সেখানকার উদ্ধার কার্যক্রম এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে দেখা করার পর সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দেন তিনি। 

বক্তব্যে তিনি বলেন (আর্কাইভ), কাহরামানমারাস-কেন্দ্রিক ভূমিকম্পটি দশটি প্রদেশে আঘাত করেছে। দেশটি একটি বিশাল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে।

রাষ্ট্র তার সমস্ত উপায় এবং সংস্থান একত্রিত করেছে উল্লেখ করে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জানান, তুর্কি দুর্যোগ ও জরুরী ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (AFAD) এর সমন্বয়ে পৌরসভাগুলোর সাথে সংহতি প্রকাশ করে প্রাসঙ্গিক কাজগুলি করা হচ্ছে।

Screenshot source : Presidency Of The Republic Of Turkey

একই প্রসঙ্গে সেদিন রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘Anadolu Agency’ এর এক প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কর্তৃক কাহরামানমারাসে দেওয়া পুরো বক্তব্য এসেছে। 

এরদোয়ান তার বক্তব্যে ঘোষণা দেন, কাহরামানমারাসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ১০ হাজার লিরা (৫৩০ ডলার) করে সহযোগিতা দেয়া হবে।

তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো এক বছরের মধ্যে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি অঞ্চলে গণ আবাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা, ঠিক যেমন আমরা করেছি অন্যান্য প্রদেশে যেখানে আমরা দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছি।”

Screenshot source: Anadolu Agency

এরদোয়ান তার বক্তব্যে ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে চলমান তার সরকারের নানা কার্যক্রমের বিষয়ে তুলে ধরেন। তবে পুরো বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যে একটি গাছ হারিয়েছে তাকে দশটি গাছ দেওয়া প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেননি। 

একইদিন (৮ ফেব্রুয়ারি) এরদোয়ান কাহরামানমারাসের ওনিকিসিবাত স্টেডিয়ামে স্থাপিত পুর্নবাসন কেন্দ্র পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আল্লাহ আমাদের সহায় হোন এবং ধৈর্য্য দান করুন।”

Screenshot source : Anadolu Agency

একইদিন হাতায়’তে (Hatay) ভূমিকম্প ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তিনি। তার বক্তব্যে নানা প্রসঙ্গের সাথে বাড়ি তৈরির প্রসঙ্গ উঠে এলেও ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে থাকা অন্যান্য তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তার বক্তব্য পড়ুন এখানে। 

অর্থাৎ, ৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এক বক্তব্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়গুলোতে নতুন বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার লক্ষ্যের কথা জানিয়েছেন।

ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে তার সরকারের কার্যক্রমের বিষয়ে অবহিত করতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ৭ এবং ৬ ফেব্রুয়ারি আরও দুইটি বিবৃতি দিয়েছেন। 

৬ ফেব্রুয়ারি দেওয়া বিবৃতি পড়ুন এখানে। 

৭ ফেব্রুয়ারি দেওয়া বিবৃতি পড়ুন এখানে।

বিবৃতিগুলো পড়ে আলোচিত তথ্যগুলোর উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

ছবিটি কবে তোলা?

ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে এরদোয়ানকে এক শিশুকে চুমু দিতে দেখা যাচ্ছে। রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে তুরস্কের সংবাদমাধ্যম ‘Ensonhaber’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালের ২২ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আলোচিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। এরদোয়ানের অফিশিয়াল ফটোগ্রাফার ইয়াসিন বুলবুলের তোলা ছবি এটি।

Screenshot source : Ensonhaber

অর্থাৎ, ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়।

মূলত, গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ায় বিধ্বংসী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর প্রেক্ষিতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ঐতিহাসিক ঘোষণা দাবিতে কিছু তথ্য ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। এরদোয়ানকে উদ্ধৃত করে পোস্টে বলা হয়, “আপনারা যা হারিয়েছেন, তা আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না। তবে আপনাদের হতাশ হবার কিছু নেই। এক লিরাও (তুর্কি মুদ্রা) কাউকে দিবেন না। আমি সকলকে এর চেয়ে উন্নত ঘরবাড়ি প্রস্তুত করে দিব ইনশাআল্লাহ। যে একটি গাছ হারিয়েছে, আমি তাকে দশটি গাছ দিব।” কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেদিন বা ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যে এরদোয়ান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার কথা জানালেও কাউকে এক লিরা না দেওয়া বা একটি গাছের পরিবর্তে দশটি গাছ দেওয়া বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেননি। 

প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে একাধিক গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, তুরস্কে ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে “তুর্কি প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক ঘোষণা” শীর্ষক শিরোনামে কিছু তথ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img