সম্প্রতি, “নতুন কারিকুলাম আবার ফিরে যাচ্ছে আগের পরীক্ষা পদ্ধতিতে! ২০২৪ ব্যাচ থেকে PSC ও JSC পরিক্ষা নেওয়ার চূড়ান্ত ঘোষণা” শীর্ষক একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকের নিজস্ব মনিটরিং টুলস ক্রাউট্যাঙ্গেল অনুযায়ী, প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত একই ক্যাপশনে এক হাজারেরও বেশি পোস্ট হয়েছে এবং সবগুলো পোস্ট মিলিয়ে ১ লক্ষ ৭৩ হাজারেরও অধিক রিয়্যাক্ট পড়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, ফেসবুকের এই টুলস ব্যক্তিগত আইডি থেকে করা পোস্টের সংখ্যা দেখায় না এবং যেসব ফেসবুক পেজ, গ্রুপ ও ভেরিফাইড আইডির পোস্ট দেখায় সেগুলোরও নির্দিষ্ট ফলোয়ার সংখ্যা পার হয়ে আসতে হয়। অর্থাৎ, ছড়ানোর প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
উক্ত দাবিতে ভাইরাল কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নতুন শিক্ষা কারিকুলাম প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া এবং ২০২৪ ব্যাচ থেকে পুনরায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা চালুর দাবিটি সত্য নয়। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সম্প্রতি ‘নতুন কারিকুলামের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে প্রয়োজনে পরিবর্তন আসবে’ শীর্ষক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কোনো সূত্র ছাড়াই উক্ত দাবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে গুজব বলে রিউমর স্ক্যানারকে জানানো হয়েছে।
গুজবের সূত্রপাত
বিষয়টি যাচাইয়ে এই দাবির সম্ভাব্য সূত্রপাত খুঁজে বের করার চেষ্টা করি আমরা। গত ১৪ জানুয়ারি ভোর ৬টা ৩১ মিনিটে ‘Raju’s English Plus’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে ‘Mostafizar Rahman Raju’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ‘পরীক্ষা পদ্ধতি আবারও ফিরতে পারে নতুন শিক্ষাক্রমে’ শীর্ষক ক্যাপশনে একটি পোস্ট (আর্কাইভ) প্রচার হতে দেখি আমরা। তবে এই পোস্টে কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করা ছিল না।
পরবর্তীতে উক্ত পোস্টের প্রায় ৪ ঘণ্টা পর সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে ‘Polapain Of HSC 2K24’ নামের আরেকটি ফেসবুক গ্রুপে একই ক্যাপশনে আরো একটি পোস্ট (আর্কাইভ) খুঁজে পাই। উক্ত পোস্টের কমেন্টে সূত্র হিসেবে ‘dailycampuslive’ নামের একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের লিংক দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এই প্রতিবেদনটি ডিলেট করা হয়েছে। তবে একই প্রতিবেদন ‘shikshabarta’ নামের আরেকটি অনলাইন পোর্টাল পাই।
উক্ত প্রতিবেদনটি জুড়ে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদনটিতে সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর গত ১২ জানুয়ারি করা মন্তব্য সম্পর্কে লেখা হয়-
‘পরীক্ষা পদ্ধতিতে ফেরার ইঙ্গিত দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম ও এর মূল্যায়ন পদ্ধতিতে প্রয়োজনে পরিবর্তন আনা হতে পারে। এটি এখন যে একেবারে শতভাগ স্থায়ী তা কিন্তু নয়। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রশাসনের কাছে যে ‘কারেকশনগুলো’ আসবে সেগুলো সমাধান করা হবে।’
প্রতিবেদন জুড়ে ‘ফিরতে পারে’ এবং ‘ইঙ্গিত’ শীর্ষক শব্দচয়নের ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রতিবেদনটি অনুমান নির্ভর।
গত ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটে ‘Md Mostakin Hosen’ (আর্কাইভ) নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ‘dailycampuslive’ নামের উক্ত অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত উক্ত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট যুক্ত করে লেখা হয়েছে ‘নতুন কারিকুলাম আবার ফিরে যাচ্ছে আগের পরীক্ষা পদ্ধতিতে!’। এখানেই ঘটেছে তথ্যের বিকৃতি। আবারও ‘ফিরতে পারে’ হয়ে গেছে ‘ফিরে যাচ্ছে’। পরবর্তীতে এই ক্যাপশনে ফেসবুকে আরো অসংখ্য প্রচার হয়। এমন কিছু পোস্টের আর্কাইভ দেখুন এখানে এবং এখানে।
পরবর্তীতে উক্ত দাবি বিবর্তিত হয়ে ‘নতুন কারিকুলাম আবার ফিরে যাচ্ছে আগের পরীক্ষা পদ্ধতিতে! ২০২৪ ব্যাচ থেকে PSC ও JSC পরিক্ষা নেওয়ার চূড়ান্ত ঘোষণা’ শীর্ষক দাবিটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
গত ০৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন চট্টগ্রাম-৯ আসনের সংসদ সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী। দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি একাধিকবার (১,২) প্রয়োজনে নতুন কারিকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানিয়েছেন। তবে পুনরায় পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা ফিরার ব্যাপারে বা নতুন শিক্ষা কারিকুলাম প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেননি তিনি।
এই বিষয়টি সত্যতা যাচাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়েরের সাথে যোগাযোগ করি আমরা। তিনি জানান, ‘এটা গুজব। এমন কোনো নির্দেশনা নাই।’
তৎক্ষণাৎ বিষয়টি গুজব জানিয়ে গতকাল ১৫ জানুয়ারি রাতে আমাদের ফেসবুক পেজে একটি ডিজিটাল ব্যানার পোস্ট করা হয়। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজেও বিষয়টি গুজব জানিয়ে একটি পোস্ট করা হয়। পরবর্তীতে একাধিক গণমাধ্যমেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে বিষয়টিকে গুজব জানিয়ে সংবাদ প্রচার হয়।
আজ ১৬ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এই বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ব্যক্তি প্রচার করছেন যে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে ফিরে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০২৪ সালে জেএসসি এবং পিএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এই তথ্যটি মিথ্যা ও বানোয়াট। এ ধরনের তথ্যে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ করা হল।”

মূলত, সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী দায়িত্ব পাওয়ার পর একাধিকবার প্রয়োজনে নতুন কারিকুলাম ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে পারে জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তার এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কিছু অনলাইন পোর্টালে ‘পরীক্ষা পদ্ধতি আবারও ফিরতে পারে নতুন শিক্ষাক্রমে’ শীর্ষক সংবাদ প্রচার হয়। পরবর্তীতে উক্ত বিষয়টি বিবর্তিত হয়ে “নতুন কারিকুলাম আবার ফিরে যাচ্ছে আগের পরীক্ষা পদ্ধতিতে! ২০২৪ ব্যাচ থেকে PSC ও JSC পরিক্ষা নেওয়ার চূড়ান্ত ঘোষণা” শীর্ষক দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। উক্ত বিষয়টি গুজব বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে।
সুতরাং, নতুন শিক্ষা কারিকুলাম প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া এবং ২০২৪ ব্যাচ থেকে পুনরায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা চালুর ঘোষণা হওয়ার দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s own analysis.
- Statement from Ministry of Education, Bangladesh.
- Bangladesh Journal – নতুন শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আসতে পারে: শিক্ষামন্ত্রী
- Prothom Alo – নতুন কারিকুলাম ও মূল্যায়নে আসতে পারে পরিবর্তন: শিক্ষামন্ত্রী
- Bangla Tribune – প্রয়োজনে নতুন কারিকুলামের মূল্যায়নে পরিবর্তন আসবে: শিক্ষামন্ত্রী
- The Business Standard – ২০২৩ সাল থেকে থাকছে না পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা