ড. ইউনূসকে গ্রেফতার এবং নির্বাচন বন্ধের গুজব 

সম্প্রতি, দোষ না করেই শাস্তি পেলাম ড. ইউনুস, গ্রেফতার ড. ইউনুস, নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা– শীর্ষক থাম্বনেইলে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভিডিওটিতে দাবি করা হচ্ছে, ড. ইউনূস গ্রেফতার হয়েছেন এবং আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

গ্রেফতার

ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস মুহাম্মদ গ্রেফতার হননি এবং আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বন্ধের কোনো ঘোষণা করা হয়নি বরং অধিক ভিউ পাবার আশায় চটকদার থাম্বনেইল ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, প্রথম অংশে ড. ইউনূসকে বক্তব্য দিতে দেখা যায় এবং পরবর্তী অংশে ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়ানো একজন আইনজীবীকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়।

ভিডিও যাচাই- ১

আলোচিত ভিডিওটির এই অংশে ড. ইউনূসকে বক্তব্য দিতে দেখা যায় এবং ফুটেজটিতে বেসরকারি টেলিভিশন বাংলা ভিশনের লোগো দেখা যায়। লোগো এবং ড. ইউনূসের বক্তব্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে বাংলা ভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে গত ১ জানুয়ারি “যে দেষ করি নাই, সে দোষের শাস্তি পেলাম: ড. ইউনূস” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়। 

উক্ত ভিডিওটিতে থাকা ২ মিনিটের পর ড. ইউনূসের দেওয়া বক্তব্যের সাথে আলোচিত ভিডিওটিতে থাকা বক্তব্যের হুবহু মিল রয়েছে। 

Video Comparison: Rumor Scanner 

৩ মিনিট ১ সেকেন্ডের উক্ত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, গত ১ জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সেই রায়ের পর সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন ড. ইউনূস। 

ভিডিওটির ২ মিনিটের পর ড. ইউনূস বলেন, যে দোষ করিনি, সেই দোষে শাস্তি পেলাম। এটা আমাদের কপালে ছিলো, জাতির কপালে ছিলো আমরা সেটা গ্রহণ করলাম।

যা আলোচিত ভিডিওটির সাথে হুবহু মিল রয়েছে। 

ভিডিও যাচাই- ২

আলোচিত ভিডিওটির এই অংশে ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়িয়ে একজন আইনজীবীকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। পরবর্তীতে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেশীয় গণমাধ্যম মানবজমিনের ফেসবুক পেজে গত ১ জানুয়ারি “নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের ৬ মাসের কা রা দন্ড ঘোষণা আদালতের, যা জানাচ্ছেন তার আইনজীবী…. সরাসরি” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি লাইভ ভিডিও পাওয়া যায়। 

উক্ত লাইভ ভিডিওতে আইনজীবীর দেওয়া বক্তব্যের সাথে আলোচিত ভিডিওটিতে থাকা আইনজীবীর বক্তব্যের হুবহু মিল রয়েছে। 

Video Comparison: Rumor Scanner 

১৮ মিনিট ৬ সেকেন্ডের লাইভ ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, গত ১ জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সেই রায়ের পর সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন ড. ইউনূসের আইনজীবী। তখনকার দেওয়া বক্তব্যের কিছু অংশ কেটে আলোচিত ভিডিওতে যুক্ত করে ভিন্ন দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। 

পরবর্তীতে ড. ইউনূসকে গ্রেফতার করেছে কি না সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম। অনুসন্ধানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

তবে, ডয়েচে ভেলের ওয়েবসাইটে গত ১ জানুয়ারি “ড. ইউনূসের ৬ মাসের কারাদণ্ড, আপিলের শর্তে জামিন” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে শ্রম আইন লঙ্ঘন মামলায় ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷ এছাড়া তাদের প্রত্যেককে ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়৷ পরবর্তীতে এক মাসের মধ্যে আপিলের শর্তে জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে৷

বিবিসি বাংলায় একই তারিখে “শ্রম আইন লঙ্ঘনে মুহাম্মদ ইউনূসের ছয় মাসের কারাদণ্ড ও জরিমানা” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা একটি মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। সোমবার(তারিখ) ঢাকার তিন নম্বর শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন।

প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, তবে কারাদণ্ড হলেও এখনি কারাগারে যেতে হবে না ড. ইউনূসকে।

আদালতে তাদের আইনজীবীরা ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার শর্তে জামিন চাইলে পাঁচ হাজার টাকার বন্ডে আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন। অর্থাৎ আগামী একমাসের মধ্যে তাদের শ্রম আপিলেট ট্রাইবুনালে আপিল করতে হবে।

একই তথ্যে সংবাদ প্রকাশ করেছে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমও। প্রতিবেদনগুলো দেখুন- ডেইলি স্টার, কালের কণ্ঠ, আমাদের সময় এবং ইত্তেফাক। 

অর্থাৎ, ড. ইউনূসকে গ্রেফতার করা হয়নি বরং ছয়মাসের কারাদণ্ড হলেও পরবর্তীতে এক মাসের মধ্যে আপিলের শর্তে জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে তাকে। 

পাশাপাশি, নির্বাচন বন্ধের ঘোষণার বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

মূলত, ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে একটি মামলা করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) এসএম আরিফুজ্জামান। গত ১ জানুয়ারি সেই মামলার রায়ে ড. ইউনূসসহ ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। পরবর্তীতে এক মাসের মধ্যে আপিলের শর্তে জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে৷ এরই মধ্যে ইন্টারনেটে “ড. ইউনূসকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে” শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। তবে, রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবিগুলো সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে অধিক পাবার আশায় রায়ের পর সাংবাদিকদের সামনে ড. ইউনূসের দেওয়া বক্তব্যের একটি ভিডিওর এবং ড. ইউনূসের আইনজীবীর দেওয়া বক্তব্যের কিছু অংশ কেটে তা ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। 

প্রসঙ্গত, আগামী ৭ জানুয়ারি রোববার ভোটগ্রহণের দিন রেখে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।

সুতরাং, ড. ইউনূসকে গ্রেফতার এবং আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img