সম্প্রতি, জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে মামলা ও সাঈদীর চিকিৎসার সাথে জড়িত চিকিৎসককে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে শীর্ষক দাবিতে কিছু ভিডিও ইউটিউবে প্রচার করা হচ্ছে।
ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও এমন ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেলাওয়ার হোসাইন মৃত্যুর ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে তার ছেলের বা সাঈদীর দল জামায়াতে ইসলামীর আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা ও সাঈদীকে চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তার সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারের দাবিটি সঠিক নয় বরং ভিন্ন ভিন্ন ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করে চটকদার থাম্বনেইলের মাধ্যমে উক্ত ভিডিওগুলো প্রচার করা হচ্ছে।
প্রথম ভিডিও যাচাই
অনুসন্ধানে দেখা যায়, MKtv News Bangla নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলে গত ২১ আগস্ট “হাসিনার নামে মামলা করলো সাঈদীর ছেলে, সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলো ডাক্তার” শীর্ষক থাম্বনেইলে আলোচিত ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়েছে।
৮ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের এই ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, কিছু ভিডিও ক্লিপ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদীর একটি বক্তব্য জুড়ে দিয়ে পুরো ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
এর মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদীর দেওয়া বক্তব্যের মূল ভিডিওটি (আর্কাইভ) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওটি গত ১৮ আগস্ট ২ টা ৫৯ মিনিটে প্রচার করা হয়েছিল।
ভিডিওটিতে থাকা মাসুদ সাঈদীর বক্তব্যের সাথে ইউটিউব চ্যানেলটিতে প্রচারিত মাসুদ সাঈদীর বক্তব্যের হুবহু মিল রয়েছে। তবে তার এই বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার ব্যাপারে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
এছাড়া ভিডিওটিতে অন্যান্য যেসব খন্ডিত বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে সেগুলোতেও এমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলের মামলা করা ও তাকে চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তারকে সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
দ্বিতীয় ভিডিও যাচাই
Love TV নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৯ আগস্ট ‘আল্লামা সাঈদীর মৃত্যু নিয়ে ডাক্তার গ্রেপ্তার, হাসিনার উপর আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা (আর্কাইভ) শীর্ষক একটি থাম্বনেইলে উক্ত ভিডিওটি প্রচার করা হয়।
৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এটিতেও ভিন্ন ভিন্ন ভিডিও ক্লিপ একসাথে সংযুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে।
ভিডিওটির শুরুতেই র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈনকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বক্তব্যটি দিয়েছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তার এস এম মোস্তফা জামানকে হত্যা হুমকিদ্বারী তফসিরুল ইসলাম গ্রেফতার করার পর একটি প্রেস ব্রিফিং এ।
এছাড়া চ্যানেলটিতে প্রচারিত ভিডিওটির দ্বিতীয় অংশ নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই অংশটি নেওয়া হয়েছে “Nayeem Elli-Nayeem korea” নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে। গত ১৮ আগস্ট “আন্তর্জাতিক আদালতে একি কান্ড জামায়াতের।। তলেতলে একি ঘটিয়ে এলো” শীর্ষক শিরোনামে পেজটিতে উক্ত ভিডিওটি (আর্কাইভ) প্রচার করা হয়।
৬ মিনিট ১৮ সেকেন্ডের উক্ত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সেখানে উপস্থাপক জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানের সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করেন। তার এই আলোচনার অংশটুকুই Love TV এর ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিওটির শুরু থেকে ৫ মিনিট পর্যন্ত হুবহু তুলে ধরা হয়েছে।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন
- আন্তর্জাতিক আদালতে আবার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ
- Lawyers to provide ICC evidence of rights abuse in Bangladesh
আন্তর্জাতিক আদালতে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের এই বিষয়টিকেই সাঈদীর মৃত্যুতে চিকিৎসককে গ্রেফতারের দাবির সঙ্গে মিলিয়ে বিভ্রান্তিকর থাম্বনেইলে প্রচার করা হচ্ছে।
অপরদিকে অনুসন্ধানে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে মামলা এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চিকিৎসক এস এম মোস্তফা জামানকে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে এমন কোনো তথ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া যায়নি।
মূলত, গত ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে মামলা করেছেন এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া ডাক্তার এস এম মোস্তফা জামানকে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে শীর্ষক দাবিতে কিছু ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে। তবে, অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিন্ন ভিন্ন ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করে দিয়ে এবং চটকদাদ্বার থাম্বনেইলের মাধ্যমে ভিডিওগুলো প্রচার করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামীর হয়ে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ২০১০ সালের ২৯শে জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে করা একটি মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। পরে ২ আগস্ট এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর থেকেই কারাগারে ছিলেন জামায়াতের এই নেতা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মোট ২০ টি অভিযোগের মধ্যে ০৮ টিতে তিনি আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর দুটো অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আদালত ২০১৩ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়। তবে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে ২০১৪ সালে আপীল বিভাগ সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। দণ্ডাদেশ পুনর্বিবেচনা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও সাঈদীর পৃথক রিভিউ আবেদন খারিজ করে ২০১৭ সালের ১৫ মে আমৃত্যু কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়। এরপর থেকে কারাগারে থেকেই সাজা ভোগ করছিলেন তিনি।
এছাড়া, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গত ১৪ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক এস এম মোস্তফা জামান। পরবর্তীতে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হলে তিনি ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক এস এম মোস্তফা জামানকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে দুইজনকে গ্রেফতার ও করে পুলিশ।
সুতরাং, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে মামলা এবং সাঈদীকে চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তার এস এম মোস্তফা জামানকে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করেছে দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Bangladesh Jamaat-e-Ismai verified Facebook Page Post
- BBC- দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যেভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন
- Daily Star – দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা গেছেন
- bdnews24- যুদ্ধাপরাধী সাঈদী মারা গেছেন
- bdnews24- সাঈদীর মৃত্যু: চিকিৎসককে প্রাণনাশের হুমকি, থানায় জিডি
- bdnews24- সাঈদীর চিকিৎসককে হুমকি: ঢাকা-ঝিনাইদহে আটক ২
- Nayeem Elli-Nayeem korea: “আন্তর্জাতিক আদালতে একি কান্ড জামায়াতের।। তলেতলে একি ঘটিয়ে এলো
- Rumor Scanner’s Own Analysis