নোয়াখালীর আন্ডারচর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতিকে হত্যার দাবিটি মিথ্যা

গাছের সঙ্গে এক ব্যক্তির ঝুলন্ত মরদেহের একটি ভিডিও ‘নোয়াখালীর আন্ডারচর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতিকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে দুর্বৃত্তরা’ শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। পোস্টগুলোতে ঝুলন্ত মরদেহের ব্যক্তিকে আন্ডারচর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি বলে দাবি করা হয়।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে

এক্স (সাবেক টুইটার)-এ প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে এবং এখানে


ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুক পেজ থেকেও একই পোস্টটি শেয়ার করা হয়। তার পেজ থেকে শেয়ার করা পোস্টটি দেখুন এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত মরদেহের ভিডিওটি আন্ডারচর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতির নয়। সাম্প্রতিক সময়ে আন্ডারচর ইউনিয়নে মো. মাহফুজুর রহমান মাহফুজ নামের একজন ব্যক্তির ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হলেও তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে কিংবা আলোচিত ভিডিওটির সাথে সম্পর্কিত নন। প্রকৃতপক্ষে, নরসিংদীর চরদিঘলদী ইউনিয়নের সাব্বির নামের এক যুবকের ঝুলন্ত মরদেহের ভিডিওকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।

ভিডিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে Saidul Islam Akash নামের এক ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ২০ আগস্ট করা একটি পোস্টের সন্ধান পাওয়া যায়।

পোস্টটিতে তিনি সজীব ওয়াজেদ জয়ের পেজে শেয়ার করা পোস্টটির একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করে দাবি করেন, ভিডিওতে দেখতে পাওয়া মরদেহটি নোয়াখালীর আন্ডারচর ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সভাপতির নয়। বরং, এটি নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার চরদিঘলদী ইউনিয়নের সাব্বির নামের একজন ছেলের মরদেহ। পারিবারিক অশান্তির কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলেও পোস্টটিতে উল্লেখ করা হয়। উক্ত পোস্টের মন্তব্যের ঘর পর্যালোচনা করেও একাধিক ব্যক্তিকে এটি চরদিঘলদী ইউনিয়নের ঘটনা বলে ইঙ্গিত দিতে দেখা যায়। 

পরবর্তীতে সাইদুল ইসলাম আকাশ নামের ওই ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে মৃত সাব্বিরের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং মরদেহের স্পষ্ট ছবি ও ভিডিওসহ আরও কিছু ছবি সরবরাহ করেন। সরবরাহকৃত Arnob Sabbir নামের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি পর্যালোচনা করে উক্ত ব্যক্তির কয়েকটি ছবির সন্ধান পাওয়া যায়। 

আলোচিত লাশের ভিডিওটির সাথে সাব্বির নামের ওই ছেলের চেহারার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়। দুজনের চেহারার হুবহু মিল রয়েছে। উভয় ব্যক্তির চুল ও দাড়ির সাদৃশ্যও লক্ষ্য করা যায়। যা থেকে স্পষ্টত বোঝা যায়, আলোচিত ভিডিওর ঝুলন্ত মরদেহটি সাব্বির নামের এই ব্যক্তিরই।

কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে গত ৯ আগস্ট MD Shukkur Ali নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক আইডিতে করা একটি পোস্টের সন্ধান পাওয়া যায়। উক্ত পোস্টটির ১৫ মিনিট পরেই  করা আরেকটি পোস্টের মাধ্যমে তিনি সবাইকে সাব্বিরের মরদেহের ভিডিও যারা ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তাদের সেটি সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।  


এছাড়াও সাব্বিরের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনার স্থানীয় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সাথে তার ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। পাশাপাশি পোস্টটিতে করা তার মন্তব্য এবং সাইদুল ইসলামের সরবরাহকৃত ছবি থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি স্থানীয় ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।

সাব্বিরের মৃত্যুর ঘটনায় গণমাধ্যমে কোনো সংবাদ পাওয়া না গেলেও সাইদুল ইসলাম আকাশ এবং মোঃ শুকুর আলীর সাথে যোগাযোগ করে ভিডিওর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে, এটি সাব্বিরের মরদেহের ভিডিও।

পরবর্তীতে নোয়াখালী আন্ডারচর ইউনিয়নে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো ঝুলন্ত মরহেদ উদ্ধার করা হয়েছে কিনা জানতে অনুসন্ধানে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম আরটিভির ওয়েবসাইটে গত ১৭ আগস্ট রাজমিস্ত্রির মরদেহ উদ্ধার, পরিবারের দাবি পরকীয়ায় বাধা দেওয়ায় হত্যা শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, গত ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে নোয়াখালী সদর উপজেলার আন্ডারচর ইউনিয়নে কাজির চর গ্রামে নিজ বাড়ির রান্না ঘরের পেছন থেকে  মো. মাহফুজ নামের এক রাজমিস্ত্রির মরদেহ পাওয়া যায়। পরদিন দুপুরে পুলিশ তাদের ঘর থেকে মাহফুজের মরদেহটি উদ্ধার করে। 

প্রতিবেদনটিতে নিহতের চাচার বরাতে বলা হয়, রাতে মাহফুজ বাড়ি না ফেরায় পরিবারের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় তাকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তার মা হাজেরা বেগম বাড়ির উত্তর দিকে রান্না ঘরের পিছনে পেয়ারা গাছের সঙ্গে মাহফুজকে বাঁধা অবস্থায় দেখে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন গিয়ে তাকে উদ্ধার করে মৃত অবস্থা দেখে পুলিশে খবর দেয়। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের  চিহ্ন দেখা গেছে।

অর্থাৎ, মাহফুজ নামের ওই ব্যক্তির মরদেহটি ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়নি। এছাড়াও তার মরদেহ রাতে পাওয়া যায়। যা পরদিন দুপুরে পুলিশ এসে বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন। অপরদিকে আলোচিত ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারের ভিডিওটি দিনের আলোয় ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবেদনে ব্যবহৃত মাহফুজের ছবির সাথে আলোচিত মরদেহের চেহারার সাদৃশ্য পাওয়া যায়না। যা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আলোচিত ঝুলন্ত মরদেহের ভিডিওটি নোয়াখালীর আন্ডারচর ইউনিয়নের মাহফুজের নয়।


এছাড়াও তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং বিভিন্ন পোস্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায় মাহফুজ ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আন্ডারচর ইউনিয়ন ছাত্রদলের পক্ষ থেকেও মো. মাহফুজকে নিজেদের কর্মী উল্লেখ করে দেয়া একটি শোক বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

সুতরাং, নোয়াখালীর আন্ডারচর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতিকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখার দাবিটি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

হালনাগাদ

২৪ আগস্ট, ২০২৫ : ভিডিওটি গত ১৬ আগস্ট থেকে বিভিন্ন পোস্টে আন্ডারচর ইউনিয়নের মো. মাহফুজের মরদেহ হিসেবে পোস্ট হতে দেখা যায়। অন্য কোনো দাবিসহ ভিডিওর আর কোনো পোস্ট সেসময় না পাওয়ায় এবং ছাত্রলীগ সভাপতি দাবির পোস্টগুলোতেও আন্ডারচর ইউনিয়নের নাম উল্লেখ থাকায় প্রাথমিকভাবে এটিকে মাহফুজের মরদেহ ধরে প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছিল। তবে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ভিডিওটি নরসিংদীর চরদিঘলদী ইউনিয়নের সাব্বির নামের এক যুবকের ঝুলন্ত মরদেহের বলে জানা যায়। তাই সেই অনুযায়ী প্রতিবেদনটি সংশোধন করা হলো।

আরও পড়ুন

spot_img