শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষ এর বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য দাবিতে একটি ভিডিও বেশ কয়েকবছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে।
ভাইরাল ভিডিওটিতে বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায় যে, “যে পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশ এক না হবে আমি আর বাংলাদেশে যাবো না”
চলতি বছর বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বয়কট ক্যাম্পেইনকে কেন্দ্র করে উক্ত ভিডিওটি পুনরায় একই দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
চলতি বছর (২০২৪ সালে) ফেসবুকে উক্ত দাবিতে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) , এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ) ।
একই দাবিতে ভিডিওটি ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালেও প্রচার করা হয়েছে।
ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবেও বিভিন্ন সময়ে উক্ত ভিডিওটি প্রচার করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত পোস্টগুলো দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, অখণ্ড ভারত প্রত্যাশা করে বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তি শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষ নন বরং ভিডিওতে থাকা ব্যক্তির নাম শ্রী জীবন গোস্বামী যিনি হিন্দু মহাজোটের পৃষ্ঠপোষক। ভাইরাল ভিডিওটি ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলনের এবং সেই অনুষ্ঠানে শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষও উপস্থিত ছিলেন। তবে শ্যামলী পরিবহনের মালিক উক্ত অনুষ্ঠানে অখণ্ড ভারত প্রত্যাশা করে কোনো বক্তব্য দেননি বরং তার সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা, অনুষ্ঠানের মঞ্চের পেছনে থাকা ব্যানারে তার নাম থাকা এবং শ্রী জীবন গোস্বামীর বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপরই তার বক্তব্য থাকায় এই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
যেভাবে অনুসন্ধান করা হলো
অনুসন্ধানের শুরুতেই শ্যামলী পরিবহনের মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম। শ্যামলী পরিবহনের ওয়েবসাইট থেকে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় যে, রমেশ চন্দ্র ঘোষ শ্যামলী পরিবহনের কর্ণধার হিসেবে রয়েছেন।
পরবর্তীতে ভাইরাল ভিডিওটির বিভিন্ন ফ্রেম ব্যবহার করে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে Htv news24 নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর “জাতীয় হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন-২০১৭ পর্ব-৩” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ইউটিউব ভিডিওর শেষদিকে অখণ্ড ভারত প্রত্যাশা করে বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তির খণ্ডিত একটি বক্তব্য পাওয়া যায়। তাছাড়া, তার বক্তব্য দেওয়ার পূর্বে উপস্থাপক তাকে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের পৃষ্ঠপোষক শ্রী জীবন গোস্বামী (বাবু লাল মহোদয়) হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।
তবে উপস্থাপকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরপরই ভিডিওটিতে একটি ফ্রেম কাট থাকায় অখণ্ড ভারত প্রত্যাশা করে বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিতে বিস্তর অনুসন্ধান করে ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারিতে ফেসবুকে প্রকাশিত ভিন্ন আরেকটি কোণের ভিডিও খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। ইউটিউব এবং ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া এই ভিডিওগুলো থেকে এটি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, অখণ্ড ভারত প্রত্যাশা করে বক্তব্য দেওয়া সেই ব্যক্তির নাম জীবন গোস্বামী (বাবু লাল)।
পরবর্তীতে Htv news24 নামের সেই ইউটিউব চ্যানেলে “জাতীয় হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন-২০১৭ পর্ব-৪” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত ভিডিওতে জীবন গোস্বামীর বক্তব্যের দ্বিতীয় খণ্ড খুঁজে পাওয়া যায়।
এছাড়া, ২০১৯ সালের এ সংক্রান্ত বিভিন্ন ফেসবুক পোস্টে থাকা মন্তব্যের সূত্রে অনুসন্ধান করে সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরের সেবাইত হিসেবে বাবু লাল গোস্বামীকে (জীবন) খুঁজে পাওয়া যায়। ২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী সার্বজনীন পূজা পরিষদ’ নামের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত পোস্ট ও পোস্টটির (আর্কাইভ)।
শ্যামলী পরিবহনের কর্ণধার রমেশ চন্দ্র ঘোষের নাম জড়াল যেভাবে
শ্যামলী পরিবহনের মালিকের নাম জড়ানোর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা Ripon Dey নামের একটি ফেসবুক আইডিতে উক্ত অনুষ্ঠান নিয়ে ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি পোস্ট খুঁজে পাই। উক্ত পোস্টে সংযুক্ত ছবিগুলো থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, শ্যামলী পরিবহনের কর্ণধার রমেশ চন্দ্র ঘোষও সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া, Ripon Dey নামের ফেসবুক আইডিটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে, ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সেই অনুষ্ঠানে উপস্থাপকের ভূমিকায় ছিলেন তিনি নিজেই।
শ্যামলী পরিবহনের মালিকও কি অখণ্ড ভারত প্রত্যাশা করে কোনো বক্তব্য দিয়েছিলেন?
“জাতীয় হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন-২০১৭ পর্ব-৪” শীর্ষক শিরোনামের ভিডিওতেই শ্রী জীবন গোস্বামীর অর্থাৎ অখণ্ড ভারত প্রত্যাশা করে বক্তব্য দেওয়া সেই ব্যক্তির বক্তব্যের পরপরই শ্যামলী পরিবহনের মালিককে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। তার সম্পূর্ণ বক্তব্যে (৩ মিনিট ৪ সেকেন্ড থেকে ৬ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড) অখণ্ড ভারত প্রত্যাশা সংক্রান্ত কোনো মন্তব্য শোনা যায়নি।
মূলত, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের পৃষ্ঠপোষক শ্রী জীবন গোস্বামী নামের এক ব্যক্তি ২০১৭ সালে ঢাকার দয়াগঞ্জ শিব মন্দিরে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের জাতীয় হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন-২০১৭-এ বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেন, “আনন্দময়ী মায়ের সামনে প্রতিজ্ঞা করেছি, যে পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশ এক না হবে আমি আর বাংলাদেশে যাবো না”। এই বক্তব্যের ভিডিও ব্যবহার করেই ভিডিওর ব্যক্তি অর্থাৎ জীবন গোস্বামীকে শ্যামলী পরিবহনের কর্ণধার রমেশ চন্দ্র ঘোষ দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করে আসা হচ্ছে। তাছাড়া, শ্যামলী পরিবহনের কর্ণধার রমেশ চন্দ্র ঘোষ একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও তিনি অখণ্ড ভারত নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
উল্লেখ্য, ভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্যের ভিডিও তার নামে প্রচারের কারণে ২০১৯ সালেই শ্যামলী পরিবহনের কর্ণধার রমেশ চন্দ্র ঘোষ মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।
অর্থাৎ, জীবন গোস্বামী নামের ভিন্ন এক ব্যক্তির করা অখণ্ড ভারত সংক্রান্ত মন্তব্যকেই বিগত ৫ বছর যাবত শ্যামলী পরিবহনের কর্ণধার রমেশ চন্দ্র ঘোষ এর মন্তব্য দাবি করে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
সুতরাং, শ্যামলী পরিবহন এর মালিকের অখণ্ড ভারত চেয়ে মন্তব্য দাবিতে ভাইরাল বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Shyamoli Paribahan – Website
- Htv news24 জাতীয় হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন-২০১৭ পর্ব-৩
- Shyamoli Paribahan – জাতীয় হিন্দু প্রতিনিধি সম্মেলন-২০১৭ পর্ব-৪
- Alok Chowdhury – Facebook Post
- শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী সার্বজনীন পূজা পরিষদ – Facebook Post
- Ripon Dey – Facebook Post
- Ekushey TV – ফেসবুকে অপপ্রচারের প্রতিবাদে শ্যামলী পরিবহনের এমডি`র জিডি