রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট কোনো বাস্তব গবেষণা নয়

রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট” নামে এক বৈজ্ঞানিক গবেষণার গল্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে কয়েক বছর ধরে প্রচারিত হয়ে আসছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানেএখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এখানে

ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিও পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানেএখানে

ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে। ভিডিওটির আর্কাইভ দেখুন এখানে

যা দাবি করা হচ্ছ

স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট নামে রাশিয়ায় সত্যি একটি গবেষণা হয়েছিলো বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রচার করা হয়ে আসছে কয়েক বছর ধরে। আলোচিত সেই গল্পটি হলো-

“চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে মানবদেহের উপর এক্সপেরিমেন্ট সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। কিন্তু গত শতাব্দীতে মানুষকে গিনিপিগ পরীক্ষা চালানোর উদাহরণ অনেক বেশী। তাদের মধ্যে একটি হল “রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট”। কি ছিল সেই এক্সপেরিমেন্টে, চলুন পড়ে ফেলা যাক……

দিনের পর দিন ঘুমাতে না দেয়া!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ৫ বন্দীর উপরে এক অদ্ভুত পরীক্ষা চালায় রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা। তাদের লক্ষ্য এমন একটি গ্যাস আবিষ্কার করা যা ঘুমের প্রয়োজনকে দূর করবে। প্রাথমিকভাবে যে গ্যাসটি তারা তৈরী করেন (যা তখন পারভিটিন নামে পরিচিত ছিল) তার সাফল্য কতখানি তা পরীক্ষা করার গিনিপিগ হিসেবে বেছে নেয় ওই ৫ বন্দীকে।

বাইরে থেকে সিল করা একটি ঘরে রাখা হয় ওই ৫ বন্দীকে। তাদের কথা শোনার হন্য ছিল মাইক্রোফোন। ভেতরে খাদ্য এবং টয়লেটের বন্দোবস্ত ছিল শুধু। বন্দীদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল ৩০ দিন বন্দী দশার পড়ে তাদের মুক্তি দেয়া হবে। এরপরই ঘুম বিরোধী গ্যাস প্রবেশ করানো হয়। প্রথম তিন দিন সব ঠিকঠাক চললো। পাঁচ দিনের পর থেকে মাইক্রোফোনে শোনা গেল, বন্দীরা তাদের অতীত জীবনে কৃত নানা অপরাধের কথা নিজেরদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে। তারপর শুরু হল তাদের প্রলাপ বকা এবং অনুশোচনা।

১০ দিন পর ক্রমশ উন্মাদনার লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। একজন বন্দী একদিন একটানা তিন ঘন্টা চিৎকার করে যায়। ১৪দিনের দিন কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে পিশাচ গবেষকরা কৌতূহলী হয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে বন্দীদের সাথে। মনে করিয়ে দেয়, যদি এই পরীক্ষায় সহযোগিতা করে তাহলে ৩০ পর তারা মুক্ত।

অস্বাভাবিক আচরণে চিন্তিত বিজ্ঞানীরা ১৫তম দিনে গ্যাসের প্রয়োগ বন্ধ করেন। কিন্তু গ্যাস বন্ধ করার সাথে সাথে বন্দীরা গ্যাস চালু করার জন্য কাকুতি মিনতি শুরু করে। সিদ্ধান্ত হয় তাদের বের করে আনার।

দরজা খুলে এক বীভৎস দৃশ্য দেখা যায়। ৪ জন জীবিত এবং বাকি ১ জন মৃতের দেহ থেকে মাংস খুবলে নেয়ার চিহ্ন। বুঝতে বাকি থাকে না তারা স্বাভাবিক খাবার বাদ দিয়ে নিজেদের খাওয়া শুরু করেছিল। জীবিত ৩ জনকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তি শুরু করলে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। ঘুমের অভাব যে মানুষের শরীর ও মনের উপর কী মারাত্নক প্রভাব ফেলতে পারে তার এক চরম নিদর্শন হয়ে রয়েছে রুশ বিজ্ঞানীদের এই পরীক্ষা।”

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট নামে এই পরীক্ষাটি বাস্তব কোনো গবেষণার নয় বরং এটি একটি কল্পকাহিনী।

কি-ওয়ার্ড সার্চে, ১৬ আগস্ট ২০১০ তারিখে ‘Fandom.com’ নামের একটি ওয়েবসাটে ‘CreepyPasta Wiki’ নামের সেকশনে  “The Russian Sleep Experiment” শীর্ষক শিরোনামে গল্পটি খুঁজে পাওয়া যায়।

screenshot from creepypasta wiki, fandom.com

গল্পের লেখকের নাম হিসেবে ওয়েবসাইটটিতে যে নাম পাওয়া যায় তা হলো “Orange Soda”। গল্পের প্রকৃত লেখকের কোনো তথ্য ওয়েবসাইটটিতে দেওয়া হয়নি। গল্পের পেইজে উপরে ডান দিকে “View Source” এ ক্লিক করলে গল্পের সোর্সের ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

Fandom.com এর Creepypasta সেকশনটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় সেখানে এধরণে অদ্ভুতুড়ে আরও অনেক গল্প আপলোড করা আছে। ঐ ওয়েবসাইটে এধরণের অদ্ভুতুড়ে গল্পকে বলা হয় “Pasta”।

screenshot from creepypasta wiki, fandom.com

‘Creepypasta’ সেকশনে ‘pasta of the month’ নামে একটি ড্রপ ডাউন দেখতে পাওয়া যায়। ড্রপ ডাউনটিতে ক্লিক করলে দেখা যায় “Current Pasta of the month” “Previous winner” নামের সাব সেকশন। এই নামগুলো দেখে ধারণা করা যায় Creepy Pasta একটি অদ্ভুতুড়ে কল্পকাহিনীর সাইট। এবং প্রতি মাসে সেই গল্পগুলোর মধ্য থেকে সেরা অদ্ভুতুড়ে গল্প নির্বাচিত হয়। 

পরবর্তীতে, রিভার্স ইমেজ সার্চে, গল্পটির সাথে প্রচারিত ছবিগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। Fandom.com নামের ওয়েবসাইটেই গল্পটির সাথে সর্বাধিক প্রচারিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot from the halloween manufacturer wiki, fandom.com

ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় এটি হ্যালোইনের জন্য বানানো একটি প্রপ, যার নাম “স্প্যাজম”। স্প্যাজম সম্পর্কে ওয়েবসাইটিতে বলা হয়েছে, “Spazm is a prop made by Morbid Enterprises, new for the 2005 Halloween season. You could commonly pick up this prop in locations like Spirit. It might have been a small prop at the time but, after being used for the creepypasta “Russian Sleep Experiment” it gained traction. You could still buy this prop on some places online, mostly on eBay. Spazm is NOT a real victim and if you read this paragraph, you would see THE RUSSIAN SLEEP EXPERIMENT IS A CREEPYPASTA: MEANING IT IS FAKE>”। 

যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “মরবিড এন্টারপ্রাইজ ২০০৫ সালের হ্যালোইনে স্প্যাজম নামে এই প্রপটি বানিয়েছিলো। আপনি Spirit এর মতো জায়গাগুলোতে এটা নিয়ে যেতে পারবেন। যখন এটা প্রথম বাজারে আনা হয়েছিলো তখন এর চাহিদা খুব বেশী না থাকলেও, ক্রিপি পাস্তার “দা রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট” এ এটাকে ব্যবহার করার পর থেকে এর চাহিদা এখন তুঙ্গে। তাই আপনি চাইলে এখনও অনলাইনে স্প্যাজমকে কিনতে পারবেন। স্প্যাজম রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমান্টের শিকার নয়। আপনি যদি গল্পটি পড়ে থাকেন তাহলে আপনি দেখবেন “রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট একটি ক্রিপি পাস্তা: অর্থাৎ এটি সত্য নয়।”

স্প্যাজম সম্পর্কে ফ্যানডম ওয়েবসাইটের এই বিবৃতিই প্রমাণ করে Russian Sleep experiment সত্য কোনো ঘটনা নয়।

পরবর্তীতে, গল্পের সাথে ব্যবহৃত মাস্ক পরিহিত ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চে, ২৯ অক্টোবর ২০১৮ সালে ‘armscontrol.org’ ওয়েবসাইটে “The Past, Present and Future of the Chemical Weapons Convention” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot from armscontrol.org

ছবির নীচে উল্লিখিত তথ্য থেকে জানা যায়, ছবিটি প্রকৃতপক্ষে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত ৪ ধরণের গ্যাস মাস্কের এবং এটি “Kansas City National World War 1 Museum and Memorial” নামের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

মূলত, Fandom.com নামের একটি ওয়েবসাইটে Creepypasta wiki সেকশনে অদ্ভুতুড়ে গল্প লিখে আপলোড করা হয়। তেমনই একটি কল্পকাহিনী এই “Russian Sleep Experiment”, যা ১৬ আগস্ট ২০১০ তারিখে সাইটটিতে আপলোড করা হয়। পরবর্তীতে এই গল্পটি কপি পেস্ট ও ভিডিও আকারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বাস্তব ঘটনা হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে এবং বছরের পর বছর ধরে মানুষ এই গল্পটিকে সত্য হিসেবেই বিশ্বাস করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে, রাশিয়ায় এরকম কোনো গবেষণা কখনো সংঘটিত হয়নি, এটি নিতান্তই একটি কাল্পনিক গল্প।

উল্লেখ্য, ২৭ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে “The Soviet Sleep Experiment” নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায়। একই বছর ৭ নভেম্বর “Russian Sleep Experiment” নামে একটি শর্ট ফিল্ম ও ২০২২ সালে ডিসেম্বরে “The Sleep Experiment” নামে একটি সিনেমা মুক্তি পায় এবং এই তিনটি সিনেমাই “‘Creepypasta’য় প্রকাশিত “Russian Sleep Experiment” নামক গল্পটির উপর নির্মিত।

সুতরাং, রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট নামে একটি কল্পকাহিনীর গল্পকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় সংঘটিত এক সত্য গবেষণার কাহিনী হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img