সম্প্রতি, বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মনোরোগবিদ্যার সিনিয়র কনসালট্যান্ট বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) অধ্যাপক ডা: মো: আজিজুল ইসলামকে দেখিয়েছেন এবং তিনি রুমিনের রোগ শনাক্ত করে কিছু ওষুধ দিয়েছেন দাবিতে একটি প্রেসক্রিপশনের ছবি ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। এই প্রেসক্রিপশন প্রচারের ক্ষেত্রে দেশের মূলধারার দুই জাতীয় দৈনিক কালবেলা এবং আজকের পত্রিকা’র ডিজাইন সম্বলিত ফটোকার্ড ব্যবহার করা হয়েছে।
উক্ত প্রেসক্রিপশনের ছবি কালবেলা’র ডিজাইন সম্বলিত ফটোকার্ডের মাধ্যমে প্রচার করা কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই প্রেসক্রিপশনের ছবি আজকের পত্রিকা’র ডিজাইন সম্বলিত ফটোকার্ডের মাধ্যমে প্রচার করা কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, রুমিন ফারহানার প্রেসক্রিপশন দাবিতে কালবেলা ও আজকের পত্রিকা কোনো ফটোকার্ড প্রকাশ করেনি বরং এই প্রেসক্রিপশনটি ভুয়া বলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন। তাছাড়া, প্রেসক্রিপশনে দৃশ্যমান তথ্যে অসঙ্গতি এবং ভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে উক্ত তথ্য নকলের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
দাবিটির সূত্রপাতের খোঁজে
আলোচিত প্রেসক্রিপশনটি রুমিন ফারহানার শীর্ষক দাবিটির উৎসের খোঁজে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, আজ (০৭ নভেম্বর) রাত ১২ টা ৪৮ মিনিটে ‘আশিকুর রহমান অণু’ নামে একটি ভেরিফাইড অ্যাকাউন্ট থেকে এ সংক্রান্ত সম্ভাব্য প্রথম পোস্টটি (আর্কাইভ) করা হয়। জনাব অণু প্রেসক্রিপশনের ছবিটি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেন, “O M G!! তীব্র মানসিক অবসাদ মানে ডিপ্রেশনে আছেন রুমিন ফারহানা!! সূত্র: স্কয়ার হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন।”
এই পোস্টের ঠিক ২৫ মিনিট পর রাত ১ টা ১৩ মিনিটে অণু এ সংক্রান্ত আরেকটি পোস্ট (আর্কাইভ) করেন, যেখানে তিনি কালবেলা’র ডিজাইন সম্বলিত একটি ফটোকার্ড যুক্ত করেন। এই ফটোকার্ডেও আলোচিত প্রেসক্রিপশনের ছবিটি দেখা যাচ্ছিল। ০৭ নভেম্বর তারিখ উল্লিখিত এই ফটোকার্ডের শিরোনাম ছিল এমন, “সাবেক বিএনপি সাংসদ রুমিন ফারহানা ওসিডি (অবসেসিভ কম্পোলসিভ ডিজঅর্ডার) তে ভুগছেন।” জনাব অণু এই পোস্টের ক্যাপশনে জানতে চেয়েছেন, এটি সত্যি কিনা।
এই পোস্টের কমেন্ট সেকশনে Farhana Akter নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে রাত ১ টা ৫৮ মিনিটে একই প্রেসক্রিপশন ব্যবহার করে আজকের পত্রিকা’র ডিজাইন সম্বলিত একটি ফটোকার্ড কমেন্ট করতে দেখা যায়। ফটোকার্ডটির শিরোনাম ছিল এমন, “তীব্র অবসাদ আর মানসিক রোগে ভুগছেন বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা।”
ফারহানা আক্তার নামে অ্যাকাউন্টটি (আর্কাইভ) আমরা পর্যবেক্ষণ করে এটিকে ফেক অ্যাকাউন্ট বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
এই দুই পোস্টের পর আজ সকাল নাগাদ উক্ত দুইটি ফটোকার্ডের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
কালবেলা এবং আজকের পত্রিকা কি এ সংক্রান্ত কোনো ফটোকার্ড প্রকাশ করেছে?
আমরা অনুসন্ধানে দেখেছি, কালবেলা’র ডিজাইন সম্বলিত আলোচিত ফটোকার্ডটি যখন ০৭ নভেম্বর রাত ১ টা ১৩ মিনিটে ফেসবুকে প্রথম প্রচার হয় তার পূর্বে একই তারিখ উল্লেখ করে কালবেলা’র ফেসবুক পেজে দুইটি ফটোকার্ড প্রকাশ করা হয়৷ রাত ১২ টা ১৬ মিনিটে এবং রাত ১২ টা ৫৫ মিনিটে করা দুইটি পোস্টের ফটোকার্ডে রুমিন ফারহানা বা বিএনপি সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্যই ছিল না। বরং এই দুই ফটোকার্ড ছিল আগেরদিন হওয়া বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ম্যাচের বিষয়ে।
পরবর্তীতে কালবেলা’র ওয়েবসাইটে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে রুমিন ফারহানার বিষয়ে অতি সাম্প্রতিক সময়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ হতে দেখেনি রিউমর স্ক্যানার টিম। সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর তার একটি মতামত কলাম প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায় ওয়েবসাইটে।
একই পদ্ধতিতে আজকের পত্রিকা’র ফেসবুক পেজেও অনুসন্ধান করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। পেজে আলোচিত ফটোকার্ডটির অস্তিত্ব না পাওয়া গেলেও একইদিন সন্ধ্যায় পত্রিকাটি এক ফেসবুক পোস্টে জানায়, আলোচিত ফটোকার্ডটি তাদের নয়। গণমাধ্যমটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজকের পত্রিকা সব সময় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার নীতি মেনে চলে, ফলে গণমাধ্যমটি কোনো ব্যক্তির চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র প্রতিবেদনে বা ফটোকার্ডে কখনো ব্যবহার করে না।
প্রেসক্রিপশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে যা জানা যাচ্ছে
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে প্রেসক্রিপশনটি স্কয়ার হাসপাতালের বলে দাবি করা হয়েছে। গুগলের প্লে স্টোরে স্কয়ার হাসপাতালের একটি এপ্লিকেশন খুঁজে পেয়েছি আমরা। এটির ইন্টারফেসের সাথে আলোচিত স্ক্রিনশটটির দৃশ্যমান মিল পাওয়া যায়।
এবার, প্রেসক্রিপশনটি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যাক। এপ্লিকেশনে প্রবেশ করতে শুরুতে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়, রিউমর স্ক্যানার টিমও একটি অ্যাকাউন্ট খুলেই প্রবেশ করে। ছবিতে প্রেসক্রিপশনের উপরের দিকে অ্যাকাউন্টধারীর নাম Rumeen Farhana উল্লেখ রয়েছে।
প্রেসক্রিপশনে রোগীর রোগের লক্ষণ, রোগের বর্ণনা, টেস্ট এবং ওষুধের নাম উল্লেখ দেখা যাচ্ছে। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী, রুমিন ফারহানা Major Depressive Disorder এবং Post Traumatic Stress Disorder (PTSD) নামে দুইটি রোগে আক্রান্ত বলে দাবি করা হয়েছে।
প্রেসক্রিপশনে সাতটি Symptoms বা রোগের লক্ষণ রয়েছে। এই লক্ষণগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে মার্কিন মানবস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান WebMD এর ওয়েবসাইটে গত আগস্টে ডিপ্রেশন বিষয়ক একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। এই প্রতিবেদনে ডিপ্রেশনের নয়টি লক্ষণ উল্লেখ দেখেছি আমরা। এর মধ্যে ৩ এবং ৪ নং ছাড়া বাকি সাতটি লক্ষণের সাথে আলোচিত প্রেসক্রিপশনে থাকা সাতটি লক্ষণের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
একই প্রতিবেদনে ডিপ্রেশন নির্ণয়ে পয়েন্ট আকারে তিনটি টেস্টের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে MRI, EKG এবং EEG। মজার বিষয় হচ্ছে, প্রেসক্রিপশনটিতেও একই ক্রমধারায় এই তিনটি টেস্টের বিষয়ই উল্লেখ রয়েছে।
২৮ অক্টোবর ২০২৩ তারিখের এই প্রেসক্রিপশনে ডাক্তার আজিজুল ইসলাম তিনটি ওষুধ দিয়েছেন বলে দেখা যাচ্ছে।
প্রথমটি Arpolax tablet 20mg। এটি দিনে তিনটি করে সকাল বা সন্ধ্যায় খেতে বলা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এই ওষুধ তৈরি করে থাকে ইনসেপটা পার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ট্যাবলেট সাধারণত PTSD এর রোগীরাও গ্রহণ করেন। সাধারণ মাত্রায় দিনে একটি খেতে হয় এটি। তবে অবস্থা গুরুতর হলে দিনে তিনটি খাওয়ারও পরামর্শ দিয়ে থাকে ডাক্তাররা।
দ্বিতীয়টি Melixol tablet 10mg। এটি দিনে দুইটি করে দুপুরে খেতে বলা হয়েছে। এটির প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান স্কয়ার পার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সাধারণ মাত্রায় প্রতিদিন Melixol এর একটি করে ট্যাবলেট সকালে এবং দুপুরে খেয়ে থাকে রোগীরা। তবে সমস্যা গুরুতর হলে সকালের ডোজে দুইটি করে ট্যাবলেট খাওয়া যায়।
তৃতীয়টি Anaframil tablet 150mg। এটি দিনে একটি করে ঘুমানোর পূর্বে খেতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই ট্যাবলেটের নাম কিওয়ার্ড সার্চ করে হুবহু একই নামে কোনো ট্যাবলেটের অস্তিত্ব মেলেনি। তবে Anafranil নামে একটি ট্যাবলেটের খোঁজ মিলেছে যা Sandoz নামে একটি কোম্পানি তৈরি করে থাকে৷ এই ওষুধ সাধারণত ২৫ মিলিগ্রাম পরিমাণে পাওয়া যায়। ডিপ্রেশনের রোগীদের এই ট্যাবলেট দিনে ১০ থেকে ১৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পরিমাণে খেতে পরামর্শ দিয়ে থাকে ডাক্তাররা৷
অর্থাৎ, প্রথম ওষুধটির বিষয়ে প্রচারিত তথ্যগুলো সঠিক বলে প্রতীয়মান হলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওষুধটির তথ্যে গরমিল রয়েছে।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?
সার্বিক বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম স্কয়ার হাসপাতালে মনোরোগবিদ্যার সিনিয়র কনসালট্যান্ট বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) অধ্যাপক ডা: মো: আজিজুল ইসলামের সাথে কথা বলেছে। তার সাথে আমাদের দীর্ঘ আলাপ হয়েছে এ বিষয়ে। তিনি বলছিলেন, এটা তার দেয়া প্রেসক্রিপশন নয়। “আর এই ওষুধ কখনো কোনো পেশেন্টকে দিয়েছি বলে মনে হয় না।”
সম্প্রতি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তার কাছে গিয়েছিলেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানালেন, এটি বলা সমীচীন হবে না। কারণ পেশেন্টদের তথ্য বাইরে প্রকাশ করা উচিত নয় বলেই মনে করেন তিনি। তবে তিনি এটা নিশ্চিত করেছেন যে এই প্রেসক্রিপশন তিনি দেননি৷
ডাক্তার আজিজুল বলছেন, এগুলো (ডাক্তারদের বিষয়ে ভুল তথ্য) আসলে বন্ধ হওয়া দরকার।
আমরা এ বিষয়ে জানতে রুমিন ফারহানার সাথেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মূলত, সম্প্রতি বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক রুমিন ফারহানা রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মনোরোগবিদ্যার সিনিয়র কনসালট্যান্ট বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) অধ্যাপক ডা: মো: আজিজুল ইসলামকে দেখিয়েছেন এবং তিনি রুমিনের রোগ শনাক্ত করে কিছু ওষুধ দিয়েছেন দাবিতে একটি প্রেসক্রিপশনের ছবি দেশের দুই গণমাধ্যম কালবেলা এবং আজকের পত্রিকা’র ডিজাইন সম্বলিত ফটোকার্ডের মাধ্যমে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, সংশ্লিষ্ট দুই গণমাধ্যমসহ দেশের কোনো গণমাধ্যমেই এ সংক্রান্ত কোনো ফটোকার্ড বা সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। তাছাড়া, আলোচিত ফটোকার্ডে বিদ্যমান প্রেসক্রিপশনের ছবিতে থাকা তথ্যগুলো যাচাই করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, টেস্টের নাম এবং রোগের লক্ষণগুলো মার্কিন মানবস্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান WebMD থেকে হুবহু কপি করা হয়েছে। পাশাপাশি, প্রেসক্রিপশনে উল্লিখিত তিনটি ওষুধের প্রথমটির বিষয়ে প্রচারিত তথ্যগুলো সঠিক বলে প্রতীয়মান হলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওষুধটির তথ্যে গরমিল দেখা গেছে। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট ডাক্তারও এটি তার দেওয়া প্রেসক্রিপশন নয় বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন।
সুতরাং, বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানার স্কয়ার হাসাপাতালের প্রেসক্রিপশনের ছবি দাবিতে প্রচারিত তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং একই দাবিতে কালবেলা ও আজকের পত্রিকা’র নামে প্রচারিত ফটোকার্ডগুলো ভুয়া বা বানোয়াট।
তথ্যসূত্র
- WebMD: Depression Diagnosis
- Rumor Scanner’s own investigation
- Statement from Prof. Dr. Brig. Gen. Md. Azizul Islam
- Prescription Analyses