ভিডিওটি রাসেল’স ভাইপারের নয় এবং রাসেল’স ভাইপার পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপ নয়

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি সাপের ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে ভিডিওটি রাসেল’স ভাইপারের এবং রাসেল’স ভাইপার পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপ।

বিষধর সাপ

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি উক্ত দাবির ভিডিও পোস্টগুলো সম্মিলিতভাবে মোট ৪০ লক্ষেরও অধিক বার দেখা হয়েছে এবং ৩০ হাজারেরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওগুলোতে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত সাপটি রাসেল’স ভাইপার সাপ নয়, বরং নির্বিষ রম্বিক এগ-ইটার বা কমন এগ ইটার সাপ। তাছাড়া, রাসেল’স ভাইপার বিশ্বের সবচেয়ে বিষধর সাপ নয়।

অনুসন্ধানের প্রাথমিক পর্যায়ে অনলাইনে বিদ্যমান রাসেল’স ভাইপারের ছবি কিংবা গঠনগত বৈশিষ্ট্যের সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সাপটির পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রাসেল’স ভাইপারের বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii এবং রাসেল’স ভাইপারের মাথার আকৃতি ত্রিকোণাকার এবং রাসেল’স ভাইপারের গায়ে স্পষ্ট গোলাকার অনেকটা চেইনের মতো দাগ থাকে৷ তাছাড়া, বাংলাদেশ এলাকায় প্রাপ্ত রাসেল’স ভাইপারে সাধারণত উজ্জ্বল আকৃতির বাদামি বর্ণের মধ্যে স্পষ্ট গোলাকার দাগ থাকে। উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সাপটির সাথে মিলে না।

Comparison : Rumor Scanner

অপরদিকে প্রচারিত সাপটির সাথে রম্বিক এগ-ইটার বা কমন এগ ইটার সাপের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। HONGKONGSNAKEID নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, রম্বিক এগ ইটার সাপের বৈজ্ঞানিক নাম Dasypeltis scabra. রম্বিক এগ ইটারকে এর ধূসর থেকে বাদামি রঙ এবং শরীরের দৈর্ঘ্য বরাবর কালো ও বাদামি অনিয়মিত আকৃতির দাগ ও বিন্দু দ্বারা সহজেই শনাক্ত করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে বিন্দুর পরিবর্তে সংযুক্ত খাঁজযুক্ত ব্যান্ড প্রদর্শিত হতে পারে। প্রায় সব ক্ষেত্রে মাথার উপরের দিকে বাদামি “V” আকৃতির চিহ্ন দেখা যায় এবং তাদের শরীর খুব সুস্পষ্ট লম্বা সরু সমান ব্যাসার্ধের। তাদের মাথা এবং ঘাড়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকে না। উপরের চোয়াল লাইনে খাড়াভাবে বাদামি ডোরা দাগও দেখা যায়। মাথা শরীরের তুলনায় ছোট এবং নাক ভোঁতা। চোখ বাদামি বা সোনালি রঙের এবং চক্ষু তারা উল্লম্ব। মাঝে মাঝে অচিহ্নিত বাদামি/সবুজ রঙেও দেখা যেতে পারে। এদের বিষ নেই বা এরা নির্বিষ। এদেরকে জঙ্গলের প্রান্ত, খোলা সমভূমির মধ্যে থাকা পোকাদের ঢিবি এবং তৃণভূমির মধ্যে আশ্রয় নেয়। সাব-সাহারান আফ্রিকাতে এই প্রজাতির সাপকে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশে Saw Scaled Viper এর পরিসীমায়ও এদেরকে পাওয়া যায়।

তাছাড়া, আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য বিষয়ক ওয়েবসাইট Biodiversity Explorer এর নিবন্ধ থেকে জানা যায়, এরা দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বত্র বিস্তৃত এবং মরুভূমি ও বনাঞ্চল ছাড়া যেকোনো আবাসস্থলে পাওয়া যায়। এই সাপটির গড় দৈর্ঘ্য ০.৭৫ মিটার, তবে এটি প্রায় ১.২ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এরা কেবলমাত্র পাখির ডিম খায় এবং এরা নির্বিষ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নয়৷ 

African Snakebite Institute এর ওয়েবসাইটেও তথ্যগুলোর সত্যতা পাওয়া যায় এবং এটিকে “ক্ষতিকারক নয়” হিসেবে চিহ্নিত করতে দেখা যায়। Gewone Eirvreter নামে এটির অন্য একটি নাম আছে বলেও নিবন্ধটি থেকে জানা যায়।

Photo : African Snakebite Institute

উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে প্রচারিত ভিডিওটির মিল পাওয়া যায়৷ যা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি রাসেল’স ভাইপারের নয়, বরং রম্বিক এগ-ইটার বা কমন এগ ইটার বা Gewone Eiervreter এবং সাপটি নির্বিষ।

এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার যোগাযোগ করে সাপ ও সাপের উদ্ধার নিয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম Snake Rescue Team Bangladesh এর জেনারেল সেক্রেটারি প্রিতম সুর রায়ের সাথে৷ তিনি আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সাপটি রাসেল’স ভাইপার নয়, বরং রম্বিক এগ ইটার সাপ বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন।

রাসেল’স ভাইপার কি বিশ্বের সবচেয়ে বিষধর সাপ? 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নানা প্রতিষ্ঠানের বেশকিছু প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোথাও রাসেল’স ভাইপারকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপ বলে দাবি করতে দেখা যায়নি। 

বিবিসি ওয়াইল্ড লাইফের প্রতিবেদন অনুসারে, সবচেয়ে বিষধর সাপ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় ইনল্যান্ড তাইপান নামের সাপ। অনুমান করা হয়, এই সাপটির এক কামড়ের বিষ ১০০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে মারতে সক্ষম। উল্লেখ্য যে, ইনল্যান্ড তাইপান সবচেয়ে বিষধর হলেও সবচেয়ে বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন Saw Scaled Viper এর কারণে। এদেরকে মূলত মধ্যপ্র্যাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় পাওয়া যায়। এদের নামের মধ্যে ভাইপার থাকলেও এরা রাসেল’স ভাইপার থেকে আলাদা৷ 

বিষধর সাপদের তালিকায় রাসেল’স ভাইপার কততম অবস্থানে আছে তা নিয়ে একেকটি প্ল্যাটফর্মে একেকটি অবস্থান উল্লেখ করা থাকলেও বিশ্বস্ত সূত্রে কোথাও রাসেল’স কে বিশ্বের সবচেয়ে বিষধর সাপ বলা হয়নি। 

বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্স ১৩ টি সবচেয়ে বিষধর সাপের একটি তালিকা প্রকাশ করলে সেখানেও শীর্ষ স্থানে ইনল্যান্ড তাইপানকে দেখতে পাওয়া যায়। রাসেল’স ভাইপারের অবস্থান সেখানে ষষ্ঠ। তবে, তারা কীসের ভিত্তিতে এই ক্রম সাজিয়েছে তা উল্লেখ করেনি। 

এ বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে সাপেকাটা বিষয়ে সতর্কতা, প্রকৃতি সংরক্ষণের মতো বিষয় নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান Deep Ecology And Snake Conservation Foundation এর ফেসবুক গ্রুপে তাদের কনটেন্ট বিশেষজ্ঞ রাশিক আজমাইনের একটি পোস্ট দেখা যায় যেখানে তিনি SC LD50 এর মান অনুযায়ী বিশ্বের শীর্ষ ৪০ টি বিষধর সাপের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন৷ 

সহজ ভাষায়, LD50 হচ্ছে কোন একটি পদার্থের সর্বনিম্ন যে পরিমাণ কোন প্রাণীর (নির্দিষ্ট সময় পর টেস্টকৃত সদস্যদের অর্ধেক) মৃত্যু ঘটাতে পারে। এর মান যত কম হবে সেটি তত বেশি ক্ষতিকর বা তীব্র। 

Photo : রাশিক আজমাইন (Deep Ecology And Snake Conservation Foundation)

রাশিক আজমাইনের পোস্ট অনুসারে, এই মাত্রা অনুযায়ী সবচেয়ে বিষধর সাপ হচ্ছে ইনল্যান্ড তাইপান৷ উক্ত তালিকায় রাসেল’স ভাইপারের অবস্থান দেখতে পাওয়া যায় ৩৩তম স্থানে।

এ বিষয়ে সাপ ও সাপের উদ্ধার নিয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম Snake Rescue Team Bangladesh এর জেনারেল সেক্রেটারি প্রিতম সুর রায়ের সাথে কথা বললে তিনিও জানান, তীব্র বিষধর সাপের তালিকায় রাসেল’স ভাইপার শীর্ষ ৩০ এও না থাকতে পারে।

মূলত, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে ভিডিওটিতে প্রদর্শিত সাপটি রাসেল’স ভাইপার এবং রাসেল’স ভাইপার পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপ। কিন্তু, রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত সাপটি রাসেল’স ভাইপার সাপ নয়, বরং রম্বিক এগ ইটার সাপ। তাছাড়া, রাসেল’স ভাইপার বিশ্বের সবচেয়ে বিষধর সাপ নয়। 

সুতরাং, প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত সাপটি রাসেল’স ভাইপার এবং রাসেল’স ভাইপার পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপ মর্মে প্রচারিত দাবিগুলো মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img