গত ৩১ মার্চ, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রলয় গ্যাং’ শীর্ষক শিরোনামে বেসরকারি টিভি চ্যানেল একাত্তর টিভির একটি প্রতিবেদনে প্রলয় গ্যাং এর ছবি দাবি করে কয়েকজন শিক্ষার্থীর একটি গ্রুপ ফটো প্রকাশ করা হয়েছে।
একাত্তর টিভির ফেসবুক পেজে প্রচারিত ভিডিও প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রলয় গ্যাংয়ের দাবিতে একাত্তর টিভির প্রতিবেদনে ব্যবহৃত একটি ছবিতে যাদেরকে দেখানো হয়েছে তারা কেউ উক্ত গ্যাংয়ের সদস্য নয় বরং ছবিতে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তত ৪ জন বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন এবং সকলেই ঢাবির অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। অন্যদিকে প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
ছবিটির সত্যতা যাচাইয়ে ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসিমউদদীন হল শাখা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক আরিফ পাটোয়ারীর ফেসবুক একাউন্টে গত ২৬ মার্চ ‘উদ্যান গ্যাং এবং আমাদের গ্যাং‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি স্ট্যাটাস খুঁজে পাওয়া যায়।

স্ট্যাটাসটিতে আরিফ পাটোয়ারী লিখেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যত অপরাধ সংগঠিত হয় তার প্রায় ৯০% ঘটনা উদ্যান কেন্দ্রিক। প্রায় প্রত্যেক ইয়ার ভিত্তিক বা একসাথে উদ্যান কেন্দ্রিক গ্রুপ আছে।
…অনার্স প্রায় শেষের দিকে এখনো সন্ধ্যার পর উদ্যানে যাওয়া হয় নাই! (বই মেলা ব্যতীত)। বলতে পারেন এটা আমার ব্যার্থতা! এখন যে “প্রলয় গ্যাং”, “ব্লু নাইট” এসব গ্যাং দেখছেন এদের ন্যায় আমাদেরও একটা গ্যাং ছিল নাম ছিল ‘Special Gang DU’ যদিও সদস্য এতো বেশি ছিল না।…
আরিফ পাটোয়ারী এই Special gang সম্পর্কে আরও লিখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের এখনো অনার্স শেষ হয় নাই কিন্তু আমাদের Special gang এর সবাই ক্যাম্পাসে সুপরিচিত এবং এই বয়সেই সবাই তার অবস্থানে মোটামুটি সফল। প্রায় কারো ফ্যামিলি থেকে টাকা আনা লাগে না বরং বাড়িতে টাকা পাঠায়। এই সফলতাই আমাদের আড্ডার আলোচ্য বিষয় ছিল।”
Special gang এর সদস্যদের পরিচয় সম্পর্কে আরিফ পাটোয়ারী লিখেন, “‘Amjad Hossen Hridoy , বর্তমানে “ঢাকা পোস্ট” পত্রিকার বর্ষসেরা রির্পোটার। নুরুল ইসলাম নূর, কবি ও লেখক। তাওসিফুল ইসলাম Daily observe এর সুদক্ষ সাংবাদিক, প্রক্টর অফিসের চাঁদাবাজির মুখোশ উম্মচনকারী। Rakib Uddin দেশের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টারের ইংলিশ টিচার। Md Ashikur Rahman Mondol সেইও একটা বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টারের টিচার। বন্ধু Siddik Faruk, ক্যাম্পাসের সবচেয়ে পাওয়ারফুল সাংবাদিক আজকের পত্রিকার জনপ্রিয় রির্পোটার। Khaled Mahmud যদিও একটু পরে আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে সেও ইতিহাস সাক্ষী ‘দৈনিক সংবাদ’ এর রির্পোটার। আমিও তখন সাংবাদিকতা করতাম কিন্তু সাংবাদিকতার চেয়ে ব্যবসা শিখাটা আমার কাছে ভালো মনে হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, ছোটখাটো একটা অনলাইন বিজনেস দাড় করিয়েছি যেটার আয় দিয়ে নিজের খরচ চলে। আর রাজনীতি করে যাচ্ছি। আমাদের সেই গ্যাং এখনো আছে কিন্তু সবার ব্যস্তার কারণে আগের মত একটিভ না। এখনো আমাদের আড্ডা হয় কিন্তু সেটা টিএসসি আর ফুলার রোডে না কবি জসীম উদ্দীন হলের গার্ডেনে। আলোচনার বিষয় সেই আগের গুলোই সাথে যুক্ত হয়েছে বিয়ের ব্যাপারটা!…”
স্ট্যাটাসটিতে আরিফ পাটোয়ারী দুইটি ছবিও ব্যবহার করেন৷ এই দুইটি ছবির মধ্যে একটি ছবির সঙ্গে একাত্তর টিভিতে প্রচারিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রলয় গ্যাং’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ব্যবহৃত ছবির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

বিষয়টি নিয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম আরিফ পাটোয়ারীর স্ট্যাটাসে উল্লেখিত আরও তিন ব্যক্তি যথাক্রমে অনলাইন পোর্টাল ঢাকা পোস্টের ঢাবি প্রতিনিধি আমজাদ হোসেন হৃদয়, ইংরেজি দৈনিক ডেইলি অবজারভারের ঢাবি প্রতিনিধি তাওসিফুল ইসলাম ও ঢাকা ইউনিভার্সিটি লিটারেচার সোসাইটির সদস্য নুরুল ইসলাম নূরের ফেসবুক স্ট্যাটাস খুঁজে পায়।
যেখানে ঢাকা পোস্টের ঢাবি প্রতিনিধি আমজাদ হোসেন হৃদয় লিখেন, “কত বড় জঘন্য কাজ করল একাত্তর!!!! আমাদের বন্ধুদের ছবিকে কোনো যাচাই-বাছাই না করে প্রলয় গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে দিলো!! কী করা উচিত এদের বিরুদ্ধে?”

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি অবজারভারের ঢাবি প্রতিনিধি তাওসিফুল ইসলাম লিখেন, “একাত্তর টিভি প্রথম আলোর ছবি আর ক্যাপশন সামঞ্জস্য না হওয়ায় অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে। আর আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রলয় গ্যাং নিয়ে তাদের একটা রিপোর্টে আমি আছি এরকম গ্রুপ ছবি ব্যবহার করেছে যাচাই-বাছাই না করে। আরে ভাই, আমরাই প্রলয় গ্যাংয়ের মুখোশ উন্মোচন করেছি। আমরাই প্রক্টরিয়াল টিমের চাঁদাবাজি বের করেছি। একাত্তর টিভি এখন কি জবাব দিবে?”

ঢাকা ইউনিভার্সিটি লিটারেচার সোসাইটির সদস্য নুরুল ইসলাম নূর লিখেন, “একাত্তর টিভির সাংবাদিক কত বড় জঘন্য কাজ করল দেখেন, কোনো যাচাই-বাছাই না করে প্রলয় গ্যাংয়ের সাথে আমাদের এই গ্রুপ ছবিটা জড়িয়ে দিলো। এগুলো কি রকম সাংবাদিকতা?”

পাশাপাশি রিউমর স্ক্যানার টিম ডেইলি অবজারভারের ঢাবি প্রতিনিধি তাওসিফুল ইসলামের সাথেও যোগাযোগ করে৷
এ সময় তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “এই ছবিটা আমাদের প্রথম বর্ষের ছবি। এখানে আমরা দুইজন সাংবাদিক আছি৷ ঢাকা পোস্টের আমজাদ হোসেন হৃদয় ও আমি তাওসিফুল ইসলাম। ডানদিক থেকে প্রথম হচ্ছে আমজাদ, তিন নাম্বার হচ্ছি আমি। বাকিরা আমাদের অন্যান্য বিভাগের বন্ধু।”
তিনি বলেন, ‘আমাদের এক বন্ধু ফেসবুকে লিখেছিল উদ্যানের প্রলয় গ্যাং ও আমাদের গ্যাং কেমন ছিল সেটা নিয়ে। আমাদের সবাই একেকজন একেক জায়গায় কাজ করতেছি। কেউ সাংবাদিকতা করছে, কেউ ব্যবসায় করছে, কেউ শিক্ষক কোচিং সেন্টারের এ ধরনের একটা পোস্ট দিয়েছিল৷ পরবর্তীতে একাত্তর টিভি আমাদের এই ছবিটাই একাত্তর টিভি প্রলয় গ্যাংয়ের প্রতিবেদনে যাচাই-বাছাই না করেই ব্যবহার করে ফেলেছে এবং প্রলয় গ্যাংয়ের সাথে আমাদের সম্পৃক্ত করে ফেলেছে।’
অর্থাৎ আরিফ পাটোয়ারী যে ছবিটিকে তার বন্ধু-বান্ধবের সমন্বয়ে গঠিত স্পেশাল গ্যাং হিসেবে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন, সেই ছবিটিকেই একাত্তর টিভি প্রলয় গ্যাংয়ের ছবি হিসেবে তাদের প্রতিবেদনে ব্যবহার করেছে।
তবে একাত্তর টিভি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রলয় গ্যাং’ শিরোনামে তাদের ফেসবুক পেজে প্রচারিত ভিডিও প্রতিবেদন সরিয়ে নেয় এবং ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত প্রতিবেদনটির প্রাইভেসি প্রাইভেট করে।
ইউটিউবের ভিডিওটি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্কের এক নাম প্রলয় গ্যাং!‘ শীর্ষক শিরোনামে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও সংযুক্ত ছিল। ইউটিউবে প্রতিবেদনটির প্রাইভেসি প্রাইভেট করায় ওয়েবসাইটেও ভিডিওর প্রাইভেসিও ‘প্রাইভেট’ দেখা যাচ্ছে।

তবে ভিডিওটি সরিয়ে নিলেও এই সংক্রান্ত কোনো সংশোধনী তাদের প্রতিবেদনে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সংশোধনী বার্তা সম্পর্কিত কোনো ফেসবুক পোস্টও করেনি সংবাদমাধ্যমটি।
ভিডিওটি সরিয়ে নেওয়ার পর তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে। প্রতিবেদনটির আর্কাইভ দেখুন এখানে।
মূলত, গত ৩১ মার্চ বেসরকারি সংবাদ চ্যানেল একাত্তর টিভি ঢাবির প্রলয় গ্যাং নিয়ে তাদের ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পাশাপাশি একই বিষয়ে তাদের ওয়েবসাইটে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্কের এক নাম প্রলয় গ্যাং!’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত প্রতিবেদনে গণমাধ্যমটি প্রলয় গ্যাংয়ের ছবি দাবিতে কিছু শিক্ষার্থীর একটি দলীয় ছবি ব্যবহার করে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রলয় গ্যাংয়ের ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিতে থাকা শিক্ষার্থীরা কেউ প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্য নয় এবং তাদের সাথে প্রলয় গ্যাংয়ের কোনো সম্পৃক্ততাই নেই বরং এই শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতা সহ বিভিন্ন গঠনমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত।
প্রসঙ্গত, প্রলয় গ্যাং হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০২০-২১ সেশনের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর গড়ে তোলা একটি গ্যাং। গ্যাংটি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশুপার্কের ভেতরের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অফিসে আস্তানাও বানায়। তবে সম্প্রতি তাদের বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে ঢাবি কর্তৃপক্ষ একটি আন্ত:হল তদন্ত কমিটি গঠন করে। ইতোমধ্যে প্রলয় গ্যাংয়ের দুই সদস্যকে বহিষ্কার করেছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ।
সুতরাং, একাত্তর টিভি ঢাবির চতুর্থ বর্ষের একদল ভিন্ন শিক্ষার্থীর গ্রুপ ছবিকে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের দ্বারা তৈরি প্রলয় গ্যাংয়ের গ্রুপ ছবি দাবিতে প্রচার করেছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Arif Patwary Facebook Post: উদ্যান গ্যাং এবং আমাদের গ্যাং
- Amzad Hossen Hridoy Facebook Post: কত বড় জঘন্য কাজ করল একাত্তর!!!! আমাদের বন্ধুদের ছবিকে কোনো যাচাই-বাছাই না করে প্রলয় গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে দিলো!! কী করা উচিত এদের বিরুদ্ধে?
- Nurul Islam Nur Facebook Post: একাত্তর টিভির সাংবাদিক কত বড় জঘন্য কাজ করল দেখেন, কোনো যাচাই-বাছাই না করে প্রলয় গ্যাংয়ের সাথে আমাদের এই গ্রুপ ছবিটা জড়িয়ে দিলো।
- Tausiful Islam Facebook Post: একাত্তর টিভি প্রথম আলোর ছবি আর ক্যাপশন সামঞ্জস্য না হওয়ায় অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে।
- Statement from Tausiful Islam
- Ekattor TV: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্কের এক নাম প্রলয় গ্যাং
- Samakal: শিশুপার্কে ‘প্রলয় গ্যাংয়ের’ আস্তানা
- Ajker Patrika: নেতারা একসময় গুরুত্ব দেবে— এ আশায় তৈরি ‘প্রলয় গ্যাং’
- News Bangla 24: ‘প্রলয় গ্যাং’ সদস্য চিহ্নিত করতে আন্তঃহল তদন্ত কমিটি
- Daily Star: ‘প্রলয় গ্যাংয়ের’ ২ সদস্য ঢাবি থেকে বহিষ্কার