রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেননি 

সম্প্রতি, পুনরায় নির্বাচনের ঘোষণা দিলো রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনেই জাতীয় নির্বাচন– শীর্ষক শিরোনামে এবং বিএনপির পক্ষ নিলো রাষ্ট্রপতি, রাতেই হাসিনাকে গ্রফতারের নির্দেশ– শীর্ষক থাম্বনেইলে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। 

ভিডিওটিতে দাবি করা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পুনরায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। 

গ্রেফতারের নির্দেশ

ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পুনরায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেননি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের নির্দেশও দেননি বরং ভিন্ন কয়েকটি ভিডিও ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে চটকদার থাম্বনেইলে এবং শিরোনামে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। আলোচিত ভিডিওটি’র শিরোনাম এবং থাম্বনেইলে উল্লেখিত দাবিগুলোর সাথে ভিডিওটি’র বিস্তারিত অংশের মিল পাওয়া যায়নি। 

একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হলে তা গণমাধ্যমে সংবাদ হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু, ভিডিওতে প্রচারিত আলোচিত দাবিগুলো নিয়ে প্রাসঙ্গিক একাধিক কি ওয়ার্ড সার্চ করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উক্ত দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। 

অনুসন্ধানের এপর্যায়ে আলোচিত ভিডিওটিতে প্রচারিত ভিডিও ক্লিপগুলোর বিষয়ে পৃথকভাবে অনুসন্ধান চালায় রিউমর স্ক্যানার টিম।

ভিডিও যাচাই-১

শুরুতে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহমুদ উদ্দিন খোকনকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। তার বক্তব্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে অনলাইন গণমাধ্যম Barta Bazar এর ইউটিউবে গত ৫ ফেব্রুয়ারি “সরকার বাতাসে ভাসছে, যেকোনো সময় ধসে পড়বে”- শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনটির শুরুর একটি অংশের সাথে আলোচিত ভিডিওটিতে থাকা ফুটেজের হুবহু মিল রয়েছে। 

Video Comparison: Rumor Scanner 

সংবাদ প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সম্প্রতি বেসরকারি একটি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, এখন সরকার হাওয়ায় ভাসছে। জনগণ নেই, ফাউন্ডেশন নেই। যেকোনো সময় ধসে পড়বে। সেই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বার্তা বাজার একটি ডেস্ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

তবে প্রতিবেদনটিতে আলোচিত দাবিগুলো সংক্রান্ত কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।  

ভিডিও যাচাই-২

এই অংশে গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুরকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। বক্তব্যের সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে দৈনিক ইত্তেফাক এর ইউটিউব চ্যানেলে গত বছরের ১৩ মে “চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি ৩ মাসের মধ্যে সরকারের পতন হবে: নুরুল হক নূর”- শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারের ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। 

উক্ত ভিডিওটির একটি অংশই আলোচিত ভিডিওটিতে যুক্ত করা হয়েছে।

Video Comparison: Rumor Scanner 

ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুরের গত বছরের মে মাসে দেওয়া একটি বক্তব্যের ভিডিও এটি। এছাড়া, বক্তব্যে নুরুল হক নুর আলোচিত দাবি সংক্রান্ত কোনো কথাও বলেননি। 

অর্থাৎ এই ভিডিও নির্বাচনের আগে হওয়ায় আলোচিত দাবির সাথে এই ভিডিওটির কোনো সম্পর্ক নেই।

ভিডিও যাচাই-৩

এই অংশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঐক্যবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে একসাথে নিয়ে এসে, সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে একসাথে নিয়ে এসে আজকে আমাদেরকে রুখে দাঁড়াতে হবে।… এই সরকারকে সরিয়ে জনগণের সত্যিকার অর্থে সরকার পার্লামেন্টে… 

এই বক্তব্যে আলোচিত দাবি সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

ভিডিও যাচাই-৪

এই অংশে একজন সংবাদ পাঠিকাকে সংবাদ পাঠ করতে শোনা যায়। পঠিত সংবাদের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে Maasranga Tv এর ইউটিউব চ্যানেলে গত বছরের ১২ জুলাই “সরকার পতনের এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দিতে সমাবেশ শুরু করেছে বিএনপি”- শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনটির শুরুর একটি অংশের সাথে আলোচিত ভিডিওটিতে থাকা ফুটেজের হুবহু মিল রয়েছে। 

Video Comparison: Rumor Scanner 

সংবাদ প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, গত বছরের ১২ জুলাই সরকার পতনের একদফা দাবি নিয়ে রাজধানীতে আন্দোলনে নামে বিএনপি। সেই প্রেক্ষিতে করা সংবাদ প্রতিবেদন এটি। 

প্রতিবেদনটিতে আলোচিত দাবিগুলো সংক্রান্ত কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

ভিডিও যাচাই-৫

এই অংশেও একজন সংবাদ পাঠিকাকে সংবাদ পাঠ করতে শোনা যায়। পঠিত সংবাদের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে ATN Bangla এর ইউটিউব চ্যানেলে গত ৬ ফেব্রুয়ারি “বাংলাদেশের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নতুন করে যা জানালো যুক্তরাষ্ট্র” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়।

Video Comparison: Rumor Scanner 

উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, গত ৫ জানুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল জানান, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে দেশটির জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি বলে উদ্বেগ রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনকে ক্ষুণ্ন করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ঘোষিত মার্কিন ভিসা নীতি বাস্তবায়নের সর্বশেষ অবস্থা কী? জবাবে বেদান্ত প্যাটেল জানান, এ-সংক্রান্ত যে নীতি ঘোষণা করা হয়েছে তার হালনাগাদ বা পরিবর্তনের বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য তার কাছে নেই। শুধু নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে এ ধরনের নীতি পরিবর্তন হয়ে যায় না। তবে এ বিষয়ে কিছু বলার মতো হালনাগাদ কোনো তথ্য তার কাছে নেই।

এ পর্যায়ে প্রশ্নকারী সাংবাদিক জানতে চান, যে ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছিল তা কি এখনো বহাল আছে? জবাবে বেদান্ত প্যাটেল বলেন, ‘হ্যাঁ। নীতিতে কোনো রদবদল নেই।’ 

এই প্রতিবেদনেও আলোচিত দাবিগুলো সংক্রান্ত কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

মূলত, গত ০৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত ২৯৮ আসনের ফলাফলে ২২২ টি আসন লাভ করে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। গত ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এরই মধ্যে ৬ ফেব্রুয়ারি Sabai Sikhi নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে পুনরায় নির্বাচনের ঘোষণা দিলো রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধিনেই জাতীয় নির্বাচন– শীর্ষক শিরোনামে এবং বিএনপির পক্ষ নিলো রাষ্ট্রপতি, রাতেই হাসিনাকে গ্রফতারের নির্দেশ– শীর্ষক থাম্বনেইল ব্যবহার করে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিগুলো সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন ঘটনার সংবাদ প্রতিবেদন এবং পুরোনো কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করে তাতে চটকদার শিরোনাম ও থাম্বনেইল বসিয়ে আলোচিত ভিডিওটি প্রচার করা হয়েছে।

সুতরাং, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পুনরায় জাতীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার নির্দেশ দিয়েছেন দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img