পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া তিন বিলিয়ন নয়

সম্প্রতি ‘বাংলাদেশে কয়লা আমদানী কারক প্রতিষ্ঠান সিএমসি’কে স্যাংশন দিয়েছে চীন বকেয়া ৩ বিলিয়ন ডলার’ শীর্ষক দুইটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়,  পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আমদানি বাবদ ৩ বিলিয়ন ডলার বকেয়া থাকার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এই বকেয়ার পরিমাণ ২৯৩ মিলিয়ন ডলার বা ২৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার। 

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আমদানি বাবদ বকেয়া বিলের পরিমাণ 

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে মূলধারার জাতীয় দৈনিক বণিক বার্তায় গত ১ মে ‘কয়লা সংকটে বন্ধের উপক্রম পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Banik Barta

প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলমকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, কয়লা আমদানির বিল বকেয়ার কারণে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আর কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে না। বকেয়া এই বিলের পরিমাণ ২৯৩ মিলিয়ন ডলার।

Screenshot: Banik Barta

প্রতিবেদনটি সূত্রে আরও জানা যায়, ২৯৩ মিলিয়ন ডলারের এই বকেয়া মূলত চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১০ মাসের। আন্তঃব্যাংক ডলার রেট (১ ডলার সমান ১০৭) হিসেবে বাংলাদেশী টাকায় যা ৩ হাজার ১৩৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। দেশে ডলার সংকটের কারণে এ অর্থ একসঙ্গে পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)।

পাশাপাশি সংবাদ ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভিতে গত ২ মে ‘অশনি সংকেত; কয়লা সংকটে বন্ধ হতে পারে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রও‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের ১ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলমের একটি টেলিফোন সাক্ষাৎকার খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Jamuna TV

 সাক্ষাৎকারটিতে খোরশেদুল আলম বলেন, ‘২৯৩ মিলিয়ন ওভারডিউ পেমেন্ট। মিনিমাম ৫০ মিলিয়ন ডলার যদি এপ্রিলে পেমেন্ট না পায়, তাহলে মে মাসের কয়লা দিতে পারবে না।’

অর্থাৎ কয়লা আমদানি বাবদ বকেয়া টাকার পরিমাণ ২৯৩ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কমপক্ষে ৫০ মিলিয়ন ডলার এপ্রিলের মধ্যে শোধ করা না হলে মে মাসে কয়লা আমদানিকারক আর কয়লা দিবে না।

উপরিউক্ত প্রতিবেদন দুইটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কয়লা আমদানি বাবদ বকেয়ার পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলার নয়। প্রকৃতপক্ষে এই বকেয়ার পরিমাণ ২৯৩ মিলিয়ন ডলার।

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান সিএমসিকে চীনের নিষেধাজ্ঞা 

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি সত্য। 

এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তায় পহেলা মে প্রকাশিত ‘কয়লা সংকটে বন্ধের উপক্রম পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র‘ শীর্ষক একই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)কে কয়লা সরবরাহ করে বকেয়া পাওনা পরিশোধ না করায় চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কয়লা আমদানির নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

Screenshot: Banik Barta 

পাশাপাশি মূলধারার আরেকটি দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশে একইদিনে প্রকাশিত ‘দেশের বিদ্যুৎ খাত ফের ডলার সংকটে‘ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বকেয়া পরিশোধ না করায় চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিএমসিকে।

Screenshot: Pratidiner Bangladesh 

এছাড়া যমুনা টিভিতে গত ২ মে ‘অশনি সংকেত; কয়লা সংকটে বন্ধ হতে পারে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রও‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। 

উল্লেখ্য, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিএমসির যৌথ মালিকানায় পরিচালিত একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কয়লা আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং সেই কোম্পানিকে কয়লার দাম পরিশোধ করে সিএমসি। 

Screenshot: BBC Bangla 

তবে বর্তমানে  ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ সিএমসিকে অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। আর এর ফলে ইন্দোনেশিয়ান কোম্পানিকে সিএমসি কর্তৃক বকেয়া পরিশোধ না করতে চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ সিএমসির ওপর কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে৷ অর্থাৎ বাংলাদেশে কয়লা আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান সিএমসিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়টি সত্য। 

মূলত, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ মালিকানায় পরিচালিত হয়ে থাকে। এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যে কয়লা আমদানি করা হয়, সেটি মূল্য পরিশোধ করে থাকে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিএমসি। তবে বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে সিএমসি আমদানিকৃত কয়লার মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১০ মাসে কয়লা আমদানি বিল বাবদ বকেয়া দাঁড়ায় ২৯৩ কোটি টাকা। অপরদিকে এই বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় সিএমসিকে কয়লা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টির সঙ্গেই কয়লা আমদানি বিল বাবদ বকেয়ার পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলার দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। 

সুতরাং, ৩ বিলিয়ন ডলার বকেয়া থাকায় বাংলাদেশে কয়লা আমদানিকারক সিএমসিকে চীন কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি আংশিক মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img