সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দুইটি ছবি প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “ছাত্রশিবিরের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে দুই উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসুকে উদোম করে দিয়েছে ছাত্রদল। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক ……”।
প্রচারিত ছবি দুইটির একটিতে দেখা যায় খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন মেঘমল্লার বসু্ এবং পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। আরেকটি ছবিতে দেখা যায় মেঘমল্লারকে পেছন থেকে কালো টি-শার্ট পরা একজন হামলা করছেন এবং আশেপাশে আরো কয়েকজন আছেন।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মেঘমল্লার বসুর ছবি দুইটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় এবং তার ওপর ছাত্রদল হামলা করেনি বরং, ২০২৩ সালের ও ২০২৪ সালে ছাত্রলীগ কর্তৃক পৃথক দুইটি হামলার ঘটনাকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত মেঘমল্লারের খালি গায়ে দাঁড়ানো প্রথম ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেলের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বরে প্রচারিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। উক্ত পোস্টে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ছবিসহ মোট তিনটি ছবির সংযুক্তি পাওয়া যায় যার মধ্যে একটি ছবির সাথে প্রচারিত ছবিটির সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

সংযুক্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটিতে বলা হয়,, “গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের নেতা-কর্মীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার নিন্দা ও বিচারের দাবি
আজ ১২ ই ডিসেম্বর ২০২৩, সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ মিছিল শেষে সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হন। এসময় গত পহেলা ডিসেম্বর ছাত্রলীগ কতৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে সরকার দলীয় প্রচারণা মূলক ব্যানার স্থাপন করে ভাষ্কর্যটি সম্পূর্ণ ঢেকে দেয়ার প্রতিবাদে তারা সেই ব্যানার সরিয়ে রাজু ভাস্কর্যকে তার স্বরূপে ফিরিয়ে আনতে চায়। এইসময় ছাত্রলীগ তাদের উপর অতর্কিত হামলা করে। হামলায় আহত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি মেঘমল্লার বসু, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের দপ্তর সম্পাদক নিনাদ হান সহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী।….”
উক্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটিতে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের তৎকালীন আহ্বায়ক হিসেবে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তৎকালীন সদস্য সচিব হিসেবে মো. আবু বাকের মজুমদার স্বাক্ষর করেন। অর্থাৎ, এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় বরং ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বরের এবং উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলাম গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সংগঠনটির সাথে সম্পৃক্ত থাকার প্রেক্ষিতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া, হামলাকারীরা ছাত্রদল কর্মী নয় বরং ছাত্রলীগ কর্মী। উক্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ফেসবুক পেজেও ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বরে প্রচার হতে দেখা যায়।
এছাড়া, ‘মোরসালিনা আনিকা’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বরে মেঘমল্লার বসুর খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনুরূপ আরেকটি ছবি পোস্ট করা হয় এবং ক্যাপশনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদের বিবৃতি প্রচার করা হয় যেখানে হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করা হয়।
পাশাপাশি, এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে মূলধারার সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বরে “ছাত্রলীগের হামলায় ঢাবি ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতিসহ আহত ১০” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগের হামলায় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের অন্তত ১০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। আজ মঙ্গলবার [২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর] সন্ধ্যায় ঢাবি টিএসসি সংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের কাছে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের মধ্যে ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু, কোষাধ্যক্ষ নিজামউদ্দিন ও মাহাথির খানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।”
অর্থাৎ, এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় বরং ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বরের এবং হামলাকারীরা ছাত্রদল কর্মী নয় বরং ছাত্রলীগ কর্মী ছিল।
অতঃপর, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত মেঘমল্লারকে আক্রমণের দ্বিতীয় ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে অনলাইন সংবাদমাধ্যম জাগোনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে “ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবি ছাত্রলীগ নেতা ইমন গ্রেফতার” শীর্ষক শিরোনামে ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বরে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনে আলোচিত ছবিটির সংযুক্তি পাওয়া যায়।

উক্ত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখার নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক ইমন খান জীবনকে (২৮) গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। [ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান] জানান, ২৪ নভেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ছাত্রলীগ নেতা ইমন খান জীবনকে গ্রেফতার করা হয়। গত ১৫ জুলাই বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে ঢাবির শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করার জন্য বের হয়। এসময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় নিষিদ্ধ সংঘঠন ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।”
এছাড়া, এ বিষয়ে নিউজ বাংলা২৪ নামক সংবাদমাধ্যমে “ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমন গ্রেপ্তার” শীর্ষক শিরোনামে ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বরে প্রকাশিত আরেকটি সংবাদ প্রতিবেদনেও আলোচিত ছবিটির সংযুক্তি পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, “[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়] ক্যাম্পাসে ১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে দফায় দফায় হামলার মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক ইমন খান জীবনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।” এ থেকে জানা যায় যে প্রচারিত দ্বিতীয় ছবিটি ২০২৪ সালের ১৫ জুলাইয়ের এবং হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতা।
সুতরাং, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে মেঘমল্লার বসুর ওপর ছাত্রলীগের হামলার দুইটি ছবি সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রদলের হামলার ছবি দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Arif Sohel – Facebook Post
- Morsalina Anika – Facebook Post