সম্প্রতি, নতুন জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের বিষয়ে ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। এর মধ্যেই একটি ভিডিও ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে, কতিপয় নারী-পুরুষ প্যাঁক প্যাঁক শীর্ষক হাঁসের ডাকের শব্দগুচ্ছ উচ্চারণের মাধ্যমে হাঁসের চলার মতো করি ভঙ্গি করছেন। দাবি করা হচ্ছে, এটি বাংলাদেশ সরকারের নতুন শিক্ষা কারিকুলামের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের দৃশ্য।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকের কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
উল্লিখিত ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি ভিডিওগুলো প্রায় চার লাখ বার দেখা হয়েছে। ভাইরাল পোস্টগুলোর মন্তব্যঘর ঘুরে পোস্টটির দাবির প্রেক্ষিতে অধিকাংশ নেটিজেনকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্যাঁক প্যাঁক শীর্ষক আলোচিত ভিডিওটি দেশের নতুন শিক্ষা কারিকুলামের অধীন কোনো শিক্ষক প্রশিক্ষণের দৃশ্য নয় বরং ২০২২ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গণিত বইয়ের বিষয়গুলো সহজ ও আনন্দের সাথে শিক্ষার্থীদের শেখাতে গণিত অলিম্পিয়াডের আদলে শিখন কৌশলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভিডিওকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে ভাইরাল ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, একটি কক্ষে কিছু ব্যক্তি হাঁসের প্যাক প্যাক ডাল সদৃশ ভঙ্গিতে কসরত করছেন। কক্ষের দেয়ালে একটি ব্যানার দেখা যাচ্ছে, যাতে লেখা ৬ দিনব্যাপী গণিত অলিম্পিয়াড কৌশল ব্যবহার করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক (গণিত) প্রশিক্ষণ। স্থানের নাম উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, বদলগাছী, নওগাঁ লেখা রয়েছে। তবে ভিডিওটি কবের সে বিষয়ে ব্যানারটি থেকে স্পষ্ট ধারণা মেলেনি।
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে ২০২২ সালের ০৬ অক্টোবর ফেসবুকের একটি গ্রুপে Shapan Hossain নামে এক ব্যক্তির একটি পোস্ট (আর্কাইভ) নজরে আসে আমাদের। এই পোস্টেও প্রায় একই ব্যানার ছিল যাতে তারিখ স্পষ্টতই পড়া যাচ্ছে, ০৩ থেকে ১০ অক্টোবর এবং এখানেও সমজাতীয় আরও ছয়টি ভিডিও ছিল, ছিল চারটি ছবিও। তবে উক্ত ভিডিওটি এই পোস্টে ছিল না।
এই পোস্টের ক্যাপশন থেকে জানা যাচ্ছে, ৬ দিনব্যাপী গণিত অলিম্পিয়াড কৌশল ব্যবহার করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিষয় ভিত্তিক (গণিত) প্রশিক্ষণের ৩য় দিনের কার্যক্রমের দৃশ্য এগুলো৷ স্থান – উপজেলা রির্সোস সেন্টার, বদলগাছী, নওগাঁ।
আমরা জনাব স্বপনের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তবে ভিডিওটির বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারেননি তিনি।
রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, সে সময় দেশের একাধিক স্থানেও একই প্রশিক্ষণের ছবি পোস্ট করেছেন অনেকে। কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার এই প্রশিক্ষণের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
আমরা মূল ভিডিওটির খোঁজে আরও অনুসন্ধান করে একই বছরের (২০২২) ১১ মার্চ Gazipur City নামক একটি পেজে একই ভিডিও (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়৷
একইদিন একাধিক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত একই ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
কাছাকাছি সময়ে দেশের আরো কিছু স্থানে এই ধরণের প্রশিক্ষণের খবর পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে যশোরেও একই ধরণের প্রশিক্ষণের (হাসের প্যাক প্যাক সদৃশ প্রশিক্ষণ) পোস্ট (আর্কাইভ) খুঁজে পেয়েছি আমরা।
এই পোস্ট থেকে জানা যাচ্ছে, দশমিক ভগ্নাংশ চেনার জন্য এই পদ্ধতিতে শিশুদের শিখনে পারদর্শী করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল।
ভাইরাল ভিডিওটি ধারণের স্থান অর্থাৎ নওগাঁর বদলগাছিতে উক্ত প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন এমন দুইজন শিক্ষকের খোঁজ পেয়েছি আমরা। তৎকালীন বদলগাছির মিঠাপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক রতন কুমার সরকারের সাথে কথা বলেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি বলছিলেন, “এটা গত বছরের ঘটনা। নির্দিষ্ট তারিখ মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। তবে কোনো নতুন শিক্ষা কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত নয় এটি। এটা এখন আর হচ্ছেও না।”
তৎকালীন বদলগাছির কাটগাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মাহমুদুল হাসানের সাথে কথা বলার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। জনাব রতন আমাদেরকে বলেছেন, এই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে মাহমুদুলই ছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, চতুর্থ শ্রেণির ‘আনন্দে গণিত শিখি-কনটেন্ট ডেলিভারি বুক’-এ প্যাকঁ প্যাকেঁর এই শিখন কৌশলের বিষয়ে (৮৩ পৃষ্ঠায়) উল্লেখ রয়েছে। তবে এটি মূল পাঠ্যবইয়ের অংশ নয়৷ চতুর্থ শ্রেণির গণিত বইয়েও এই বিষয়টির উল্লেখ নেই। শিক্ষার্থীরা যাতে সহজে এবং আনন্দের সাথে গাণিতিক বিষয়গুলো আয়ত্ব করতে পারে তার জন্য গণিত অলিম্পিয়াডের কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাথমিক (প্রথম-পঞ্চম) শিক্ষার্থীদের গাণিতিক দক্ষতা উন্নয়নের জন্য এই কনটেন্ট ডেলিভারি বইগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে।
গণিত অলিম্পিয়াডের মাস্টার ট্রেনার এবং ফরিদপুরের সদরপুরের ৩৩নং ডিক্রীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ আহসান হাবীব ২০২২ সালের ১৬ মার্চ এ বিষয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট (আর্কাইভ) করেন।
তিনি লিখেছেন, প্যাঁক প্যাঁকের দৌড়াদৌড়ি নিয়ে ইদানীং ফেসবুকে কেউ কেউ ট্রল করছেন। আমি জানিনা বিষয়টি তাঁরা জেনে নাকি না জেনে, না বুঝে এমনটি করছেন। কেউ কেউ লিখেছেন প্রশিক্ষণের নামে প্রাথমিক শিক্ষকদের এতোটা নিচে নামানো ঠিক হয়নি। আর এটি দিয়ে শিক্ষার্থীরাই বা কী শিখবে?
শিক্ষার্থীদের গল্প আকারে সাধারণ ভগ্নাংশ ও দশমিক ভগ্নাংশের বিষয়ে শেখাতে এই কৌশলটি প্রয়োগ করা হয় জানিয়ে জনাব হাবিব বলছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণ ভগ্নাংশ থেকে দশমিক ভগ্নাংশের ধারণা পাবে। আর এভাবে প্যাঁক প্যাঁকের দৌড়াদৌড়ির মাধ্যমে শেখালে তারা খুব সহজেই বুঝবে, মজা পাবে, কখনও ভূলবে না, হৃদয়ে গ্রথিত হবে। আমার মনে হয় না আর কোন উপায়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দশমিক ভগ্নাংশের মতো এমন একটি জটিল বিষয় সহজ করে শেখানো যেতে পারে।
আহসান হাবিব তার পোস্টে জানিয়েছেন, গণিত অলিম্পিয়াড কৌশল প্রয়োগ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আনন্দে গণিত শেখানোর পদ্ধতিতে থাকা ‘প্যাক’ শব্দটি শিক্ষাক্ষেত্রে নতুনও নয়, হাস্যকরও নয়। এটি খুব মজার। কেননা, কাব-স্কাউটের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট স্টিফেনসন স্মিথ লর্ড ব্যাটন পাওয়েল অফ গিলওয়েল প্রায় ২০০ বছর আগে ‘প্যাক’ প্রবর্তন করে গেছেন। কাব- স্কাউটের সাপ্তাহিক মিটিংয়ের আগে ইউনিক লিডারগণ প্যাক, প্যাক শব্দ করে ষষ্ঠকদের একত্রিত করেন। ‘প্যাক’ ইংরেজি শব্দের অনেকগুলি বাংলা অর্থের মধ্যে একটি হচ্ছে – তাড়া করা বা একত্রিত করা। এটিতো শিক্ষকদের আনন্দ দেয়ার কোন বিষয় নয় বা Ice breaking এর জন্যও নয়। প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকগণকে শিক্ষার্থীদের মাঝে আইডিয়াটি উপস্থাপনের কৌশল ও ধাপসমূহ হাতে- কলমে অনুশীলন করানো হয় মাত্র।
এছাড়া, নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম ইস্যুতে গতকাল (০৩ ডিসেম্বর) জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে প্রকাশিত এক সতর্কীকরণ বিবৃতিতে বলা হয়, “কিছু লোক ব্যাঙের লাফ বা হাঁসের ডাক দিচ্ছে এমন ভিডিও আপলোড করে বলা হচ্ছে এটা নতুন শিক্ষাক্রমের শিক্ষক প্রশিক্ষণের অংশ যা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার।”
মূলত, সম্প্রতি নতুন শিক্ষা কারিকুলামের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের দৃশ্য শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে, কিছু ব্যক্তি হাঁসের ডাকের মতো প্যাঁক প্যাঁক উচ্চারণ করে হাসের মতো ভঙ্গি করছেন। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিডিওটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় এবং এই ভিডিওর দৃশ্যের সাথে নতুন শিক্ষা কারিকুলামের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেরও কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে, ২০২২ সালের শুরুতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মূল গণিত বইয়ের বিষয়গুলো সহজ ও আনন্দের সাথে শিক্ষার্থীদের শেখাতে গণিত অলিম্পিয়াডের আদলে এই শিখন কৌশলটি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল৷ তবে এটি এখন আর দেওয়া হচ্ছে না আর নতুন শিক্ষা কারিকুলামেও এই বিষয়টির উল্লেখ নেই।
সুতরাং, ২০২২ সালের একটি ভিডিও সম্প্রতি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে এটিকে নতুন শিক্ষা কারিকুলামের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের দৃশ্য শীর্ষক দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Shapan Hossain: Facebook Post
- Gazipur City: Facebook Video
- আনন্দে গণিত শিখি (চতুর্থ শ্রেণি): PDF Book
- Ahsan Habib: Facebook Post
- Rumor Scanner’s own investigation