কাতারে চলছে ফিফা বিশ্বকাপ-২০২২। এই বিশ্বকাপকে ঘিরে নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনা চলছে বিশ্বব্যাপী।এই বিশ্ব ফুটবল টুর্নামেন্টের সাথে সম্পর্কিত প্রস্তুতিতে অভিবাসী শ্রমিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনেক মানুষের মৃত্যুর কথা জানা যায়। মানবাধিকার কর্মী, রাজনীতিবিদ, ভক্ত এবং গণমাধ্যম ৬,৫০০ মানুষের মৃত্যুর কথা বলছে। এমনকি কেউ কেউ সংখ্যাটা ১৫,০০০ বলেও অভিযোগ করেন। কিন্তু সংখ্যা কি সঠিক? প্রকৃত সংখ্যাটা কত?

যেভাবে কাতারে গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ
দেশীয় গণমাধ্যম দৈনিক “কালবেলা”-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাপান-কোরিয়ার যৌথ আয়োজনের পর কাতার বিশ্বকাপ এশিয়ার মাটিতে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ এবং এশিয়ায় একক দেশ হিসেবে প্রথম। ভোটাভোটির পর তেলসমৃদ্ধ দেশটি বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার আনুষ্ঠানিক টিকিট পায় ২০১০ সালের ২ ডিসেম্বর।

কাতারে বিশ্বকাপ নিয়ে যেসব বিতর্ক
২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফিফা জেনারেল সেক্রেটারির ই-মেইল ফাঁস হওয়ার পর অভিযোগ ওঠে, কাতার অর্থের বিনিময়ে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হয়েছে। এছাড়াও বিশ্বকাপের সময় পরিবর্তন নিয়েও হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। দেশীয় গণমাধ্যম সময় টেলিভশনের অনলাইন সংস্করণের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কগুলো হলোঃ
- ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে আয়োজক নির্বাচিত হওয়া
- বিশ্বকাপের নির্ধারিত সময়ে পরিবর্তন আনা
- সংস্থা এবং তারকাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ
- নারী অধিকার ও সমকামিতা নিয়ে সমালোচনা
- সন্ত্রাসী হামলার সম্ভাবনা
- বিশ্বকাপের প্রস্তুতির অবকাঠামো নির্মাণ শ্রমিকদের মৃত্যু

ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে আয়োজক নির্বাচিত হওয়া
৫ মে ২০১১ দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হন ফিফার সহ-হসভাপতি জ্যাক ওয়ার্নার। ফিফা জেনারেল সেক্রেটারির ই-মেইল ফাঁস হওয়ার পর অভিযোগ ওঠে, কাতার অর্থের বিনিময়ে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হয়েছে। এফবিআই কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার পরই ২০২০ সালে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য জানায়। তাতে অভিযোগ করা হয়, ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক স্বত্ব পেয়েছে ধনী দেশ কাতার। অভিযোগ পত্রে বলা হয়, আয়োজক নির্ধারণে ফিফার নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সাবেক সদস্য ঘুষের প্রস্তাব পান। সেই প্রস্তাব তারা গ্রহণ করে কাতারের পক্ষে ভোট দেন। যদিও এমন অভিযোগ বরাবরই উড়িয়ে দিয়েছে কাতার।
এছাড়াও, ১৭ মার্চ ২০১৪ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে দাবি করে, এক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার গ্রহণ করেছিলেন ফিফার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়ার্নার ও তার পরিবার।

বিশ্বকাপের নির্ধারিত সময়ে পরিবর্তন আনা
প্রচন্ড তাপমাত্রা থাকার সম্ভাবনা বিবেচনায় ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বকাপের একপ্রকার নির্ধারিত জুন-জুলাইয়ের পরিবর্তে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আসর শুরু নভেম্বর-ডিসেম্বরে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা। বিশ্বকাপের সময়ে পরিবর্তন করার কারণে খেলোয়াড়দের ইনজুরির হার বাড়ছে। এছাড়া ক্লাব ফুটবলের ব্যস্ততা শেষেই সরাসরি কাতারে বিশ্বকাপ খেলতে নেমে যেতে হচ্ছে ফুটবলারদের। আর তাই বিশ্বকাপ চলাকালেও ইনজুরির ঝুঁকি থাকছেই। সেটা নিয়েই হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা।

সংস্থা এবং তারকাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ
কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেক সাবেক তারকা ফুটবলাররা। তাদের একজন ২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী জার্মানির অধিনায়ক ফিলিপ লাম। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে কাতারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেশটিতে না যাওয়ার কথা জানিয়েছেন এই ফুটবলার।
কাতারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে গুটিকয়েক দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সমালোচনা করে, নেদারল্যান্ডস ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (কেএনভিবি) তাদের মধ্যে একটি। কেএনভিবি কখনই কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে ছিল না এবং সেখানে অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা অনুমোদন করে না। ডাচ কোচ লুইস ফন গাল কাতারের বিপক্ষে সমালোচনা করেছেন।

নারী অধিকার ও সমকামিতা নিয়ে সমালোচনা
কাতার জানিয়েছে, যে কোনো মানুষ, তিনি যে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, যৌন পরিচয় বা জাতীয়তারই হোন না কেন, তাকে বিশ্বকাপে স্বাগত জানানো হবে। আবার একই সঙ্গে এটাও বলেছে যে, প্রকাশ্য স্থানে প্রেমের প্রকাশ ঘটানো আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয় এবং স্থানীয় রীতি-নীতি মেনে চলতে সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কাতার যেভাবে সমকামী নারী-পুরুষ, উভকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের অধিকার দমন করে, সেটি বারবার উঠে আসছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। এছাড়াও কাতারে নারীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েও হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা।

সন্ত্রাসী হামলার সম্ভাবনা
কাতার বিশ্বকাপ ঘিরে সন্ত্রাসী হামলার সম্ভাবনার চাঞ্চল্যকর এক তথ্য সামনে এনেছে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম লা রাজন। তাদের দাবি, কাতার বিশ্বকাপ ঘিরে সন্ত্রাসী হামলার ছক কষছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুসারীরা। টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলার এই পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে দাবি সংবাদমাধ্যমটির।

বিশ্বকাপের প্রস্তুতির অবকাঠামো নির্মাণ শ্রমিকদের মৃত্যু
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান দাবি করে বলেছে, বিশ্বকাপের বিভিন্ন প্রকল্পে গত এক দশকে প্রাণ হারিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েক হাজার শ্রমিক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এক অতি-সমালোচিত লেবার পলিসি হলো কাফালা সিস্টেম। মরুভূমির প্রচণ্ড গরমে, নামমাত্র পারিশ্রমিকে চাহিদামতো কাজ করিয়ে নেয়ার এ এক অমানবিক প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কাতার কাফালা সিস্টেম কাগজে-কলমে তুলে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু আদতে পরিস্থিতি কিছুই পাল্টায়নি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এ নিয়ে বারবার অভিযোগ তুলেছে। কদিন আগে সংস্থাটি বিশ্বকাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কমপক্ষে ৪৪০ মিলিয়ন ডলার দিতে ফিফার কাছে খোলা চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে গত এক যুগে কয়েক হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর তদন্ত করতে কাতার কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছে অ্যামনেস্টি।

কাতারে বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা
কাতারে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ইত্যাদি দেশ থেকে শ্রমিক নেয়া হয়েছে। ভারতীয়, নেপালি এবং বাংলাদেশিদের মধ্যে মৃত্যুর উল্লেখযোগ্য কারণ হল সড়ক দুর্ঘটনা (১২%), কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা (৭%) এবং আত্মহত্যা (৭%)। কাতারে পাকিস্তানের দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৮২৪ জন পাকিস্তানি শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছে। দ্য গার্ডিয়ানের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১১-২০২০ সময়ে কাতারে বাংলাদেশি অভিবাসী মারা গেছেন ১,০১৮ জন।

দাবিগুলো নেয়া হয়েছে যে দুটি প্রতিবেদন থেকে
- ব্রিটিশ দৈনিক “দ্য গার্ডিয়ান” ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে ৬,৫০০ বিদেশী কর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন (২০১১-২০২০)।
- ২০২১ সালের আগস্টে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে ১৫,০২১ বিদেশী কর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন (২০১০-২০১৯)।
এছাড়াও বিভিন্ন নির্দিষ্ট সময় বা বছর অনুযায়ী কিছু ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়। দেখুন এখানে এবং এখানে।

দাবি (ক)
- কাতারে বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে ৬,৫০০ জন বিদেশী শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছে
- কাতারে বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে ১৫,০২১ জন বিদেশী শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছে
অনুসন্ধান (ক)
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত পরিসংখ্যানটি (১৫,০২১) কাতারি অথোরিটির অফিশিয়াল সরকারী পরিসংখ্যান থেকে নেয়া হয়েছে। তবে কাতারি অথরিটির এই পরিসংখ্যানটি ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে দেশটিতে মারা যাওয়া অভিবাসীদের মোট সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে (বিশ্বকাপের প্রস্তুতি সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সহ)। এটা শুধুমাত্র বিশ্বকাপের প্রস্তুতিগত অবকাঠামো নির্মাণ শ্রমিকদের পরিসংখ্যান নয়।
এই পরিসংখ্যানে বিশ্বকাপের প্রস্তুতিগত অবকাঠামো নির্মাণ শ্রমিকদের সংখ্যার পাশাপাশি বিদেশী শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, নিরাপত্তা কর্মী, উদ্যান দেখভালের কর্মী এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীসহ সবধরণের পেশার প্রবাসী অভিবাসী লোকের তথ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে। এছাড়াও, পরিসংখ্যানে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর পাশাপাশি প্রবাসী শ্রমিকদের স্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যাও ধরা হয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনটির ক্ষেত্রে সাংবাদিক পিট প্যাটিসন এবং তার দল বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার সরকারী দপ্তর থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৬,৭৫১ (নির্দিষ্ট সংখ্যা) দাবি করেছে। এই সংখ্যাটাও, বিশ্বকাপের প্রস্তুতি সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সহ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির বাইরের অন্যান্য কাজের শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশাদারদের সমন্বিত তথ্য।
অর্থাৎ, ১০ বছরে কাতারে সব ধরনের কাজের শ্রমিক ও কর্মীর মৃত্যুর মোট সমন্বিত তথ্য “দ্য গার্ডিয়ান” এর ৬,৫০০ বিদেশী মৃত্যুর খবর এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত ১৫,০২১ বিদেশী মৃত্যুর খবরকে শুধুমাত্র বিশ্বকাপ সম্পর্কিত নির্মাণ শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে; যা মিথ্যা।

দেশীয় গণমাধ্যমে কাতারের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য
দেশীয় গণমাধ্যমে কাতারে প্রবাসী অভিবাসীদের মৃত্যু নিয়ে দ্য গার্ডিয়ানের প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সমকাল,
পাশপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা-এর (বাংলা সংস্করণ), ভারতের গণমাধ্যম, হিন্দুস্তান টাইমস (বাংলা সংস্করণ) বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এছাড়াও, দেশীয় গণমাধ্যমে কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশি অভিবাসীদের মৃত্যু নিয়ে দ্য গার্ডিয়ানের প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক যুগান্তর, সময় টেলিভিশন (২০২২), সময় টেলিভশন (২০২১), চ্যানেল২৪, আরটিভি, দৈনিক ইত্তেফাক, বণিক বার্তা, বাংলাদেশ প্রতিদিন, বাংলানিউজ২৪, দৃক নিউজ, পূর্বপশ্চিমবিডি, বাংলামেইল।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদনটি নিজেদের ক্লিপিং সাইটে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। দৈনিক প্রথম আলোতে কলাম (মতামত) বিভাগে একজন লেখক বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে ১৫ হাজার মৃত্যু্র কথা উল্লেখ করেছেন।
কাতার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
কাতার কর্তৃপক্ষ কোনো পরিসংখ্যান অস্বীকার করেনি। দ্য গার্ডিয়ান থেকে জানতে চাইলে দেশটির সরকারী যোগাযোগ অফিস বলেছে: “যদিও প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখজন। তবে এই কাজের ক্ষেত্রে, কাজের পরিধি ও নিয়োজিত জনসংখ্যা অনুযায়ী মৃত্যুর হার সীমার মধ্যেই রয়েছে। (উল্লেখ্য যে, কাজের ঝুঁকি বিবেচনায় একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে)
দাবি (খ)
- কাজের পরিধি ও নিয়োজিত জনসংখ্যা অনুযায়ী মৃত্যুর হার সীমার মধ্যেই রয়েছে
অনুসন্ধান (খ)
কাতার সরকারের মতে, প্রতি বছর ২ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ১৫,০০০ জন মারা যাওয়া একটি স্বাভাবিক গড় মৃত্যুর হার।
প্রথমত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে; কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের সাধারণ মৃত্যুর হার তাদের নিজ দেশের (যে দেশগুলো থেকে তারা এসেছে সেখানকার) তুলনায় কম। এমনকি কাতারের নাগরিকদের মধ্যে মৃত্যুর হারও কাতারের অভিবাসী শ্রমিকদের চেয়ে বেশি।
যাইহোক, কাতারে অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের নিজ দেশে বা কাতারে সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি নয়, তাই এই ধরনের পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিকর।
সুতরাং, কাতারে কাজের পরিধি ও নিয়োজিত জনসংখ্যা অনুযায়ী মৃত্যুর হার সীমার মধ্যেই রয়েছে দাবিটি বিভ্রান্তিকর।

দাবি (গ)
- বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম নির্মাণের জায়গায় মাত্র তিনজন কাজের কারণে মৃত্যু হয়েছে
ফিফা এবং কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি উভয়ই জোর দিয়ে বলে যে বিশ্বকাপ নির্মাণ সাইটে তাদের কাজের সরাসরি ফলাফল হিসাবে মাত্র তিনজন মারা গেছে। ফিফা এবং কাতারের “কাজের সাথে সম্পর্কিত মৃত্যু” এর অফিসিয়াল সংজ্ঞা হলো “সাতটি একেবারে নতুন স্টেডিয়ামের নির্মাণ সাইটে ঘটে যাওয়া মৃত্যুকে বোঝায় (প্রশিক্ষণ সুবিধাগুলিসহ)। তিনজনের মধ্যে আল ওয়াকরাহের আল জানুব স্টেডিয়ামে দুই নেপালি পুরুষ এবং আল রাইয়ানের খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে একজন ব্রিটিশ এর মৃত্যু হয়েছে।
অনুসন্ধান (গ)
নির্মাণ কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত এমন মৃত্যুর সংজ্ঞাকে প্রসারিত করে, কর্মকর্তারা আরও ৩৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বীকার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, দুই ভারতীয় এবং একজন মিশরীয় যারা কাজ থেকে তাদের বাসস্থানে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে (নভেম্বর ২০১৯)।
অর্থাৎ, “বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম নির্মাণের জায়গায় মাত্র তিনজন কাজের কারণে মৃত্যু হয়েছে” দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
কারণ
শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এরকম একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন আইএলও বলছে, কাতার সরকার মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে বলছে। সংস্থাটি বলছে কাতার সরকার এই হিসেবের মধ্যে যারা হার্ট অ্যাটাক এবং শ্বাসপ্রশ্বাস সংক্রান্ত সমস্যার কারণে মারা গেছে তাদেরকে “কাজ করতে গিয়ে” মৃত্যু হিসেবে ধরা হয়নি, যদিও প্রচণ্ড গরমে উচ্চ তাপমাত্রায় ভারী কাজ করার কারণে হিটস্ট্রোকে এসব মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
আইএলও নিজেই বিশ্বকাপের সঙ্গে সম্পর্কিত এসব দুর্ঘটনার একটি হিসেব তৈরি করেছে। কাতারে সরকার-পরিচালিত হাসপাতাল এবং অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই হিসেবটি তৈরি করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে শুধুমাত্র ২০২১ সালেই ৫০ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এবং আরো ৫০০ জনের বেশি শ্রমিক গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। তারা বলছে যে, এছাড়াও আরো ৩৭,৬০০ শ্রমিক আহত হয়েছে।
এই ধরনের পরিসংখ্যানগুলোতে সেসকল অভিবাসী শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়না যারা তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার পরে মারা গেছে বা যায়। উদাহরণস্বরূপ, নেপালে গত ১০ বছরে ২০-৫০ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে কিডনি ব্যর্থতার মারাত্মক সমস্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে – যাদের মধ্যে অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের কাজ থেকে ফিরে এসেছেন।
নেপালের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, উপসাগরীয় আবহাওয়ায় কঠোর পরিশ্রম, কম পরিমাণ এবং নিম্নমানের পানীয় জলের কারণে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও, কাতারের অভিবাসী শ্রমিকদের চাকরি যাই হোক না কেন তারা সাধারণত সুস্থ মানুষ হিসেবেই কাতারে যায়। কারণ কাতারের ভিসা পেতে, এইডস/এইচআইভি, সিফিলিস বা যক্ষ্মা, হেপাটাইটিস বি-এর মতো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত কিনা সেসকল চিকিৎসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।

কাতার কর্তৃপক্ষের অসঙ্গতি
দ্য গার্ডিয়ান এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণা অনুসারে, পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান ব্যবহার করে কাতারের ডাক্তাররা পূর্বে স্বীকৃত “স্বাভাবিক মৃত্যুর” প্রায় ৭০% মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছেন তীব্র কার্ডিও-শ্বাসযন্ত্রের ব্যর্থতাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হৃদযন্ত্র ক্রিয়া বন্ধ হওয়া (হার্ট অ্যাটাক) এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যর্থতা মৃত্যুর কারণ নয় বরং ফলাফল। হার্ট অ্যাটাক বা অন্যান্য অনিয়মের কারণে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। এছাড়াও শ্বাসযন্ত্রের ব্যর্থতা অ্যালার্জির রিয়্যাকশন (প্রতিক্রিয়া) বা বিষক্রিয়ার কারণে হতে পারে।
এমনকি জার্মান পাবলিক ব্রডকাস্টার ARD-এর ২০২২ সালের একটি ডকুমেন্টারি সিরিজ অনুযায়ী, কাতারের ডাক্তারদের কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রবাসী অভিবাসীদের ডেথ সার্টিফিকেট দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
২০১৪ সালের প্রথম দিকে, কাতারের সরকার কর্তৃক কমিশন করা একটি স্বাধীন প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে, গ্লোবাল ল’ ফার্ম “ডিএলএ পাইপার” চলমান নীতিমালার সমালোচনা করেছিল এবং একইসাথে দৃঢ়ভাবে সুপারিশ করেছিল যে দেশটির সরকার যেন “অপ্রত্যাশিত বা আকস্মিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে অটোপসি বা ময়নাতদন্তের অনুমতি দেয়।” ২০২১ সালের শেষের দিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর কারণগুলির পর্যাপ্ত নথিপত্রের অভাবেরও সমালোচনা করেছিল।
এছাড়াও, কর্তৃপক্ষ স্টেডিয়ামে কাজের শিফটের সময়ের বাইরে তাদের বাসস্থানে মারা যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের হাজার হাজার নথিভুক্ত মামলাগুলিকেও বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর জন্য পর্যাপ্ত কোনো ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়নি।
উল্লেখ্য, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ফেয়ারস্কয়ারের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলি নিয়মিতভাবে প্রবাসী শ্রমিক বা অভিবাসীদের মৃত্যুর ঘটনায় সাক্ষীদের সাথে কথা বলে, যাদের রিপোর্টগুলি থেকে বোঝা যায় যে হিট স্ট্রোক, ক্লান্তি বা এমনকি ছোটখাটো অসুস্থতা যা চিকিত্সা করা হয় না এমন অনেক বিষয় আকস্মিক মৃত্যুর মূলে রয়েছে (যেগুলো ব্যাখ্যা করা হয়না বলে স্বাভাবিক মৃত্যু ধরা হয়)৷

সুতরাং, কাতারে সব ধরনের কাজের শ্রমিক ও কর্মীর মৃত্যুর মোট সমন্বিত তথ্য “দ্য গার্ডিয়ান” এর ৬,৫০০ বিদেশী মৃত্যুর খবর এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত ১৫,০২১ বিদেশী মৃত্যুর খবরকে শুধুমাত্র বিশ্বকাপ সম্পর্কিত নির্মাণ শ্রমিক মৃত্যুর সংখ্যা হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি, কাতার কর্তৃপক্ষের দাবি কাজের পরিধি ও নিয়োজিত জনসংখ্যা অনুযায়ী মৃত্যুর হার সীমার মধ্যেই রয়েছে তবে এই তথ্যটিও বিভ্রান্তিকর। এছাড়াও, ফিফা এবং কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি দাবি করছে বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম নির্মাণের জায়গায় মাত্র তিনজন কাজের কারণে মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু এই দাবিটিও বিভ্রান্তিকর।
[আর্টিকেলটির সিংহভাগ তথ্য-উপাত্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের একটি ইংরেজি ফ্যাক্ট-চেক আর্টিকেল থেকে নেয়া হয়েছে]
তথ্যসূত্র
- DW.com- Fact check: How many people died for the Qatar World Cup?
- Somoynews.tv- কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে এত বিতর্ক কেন?
- Kalbela.com- বিশ্বকাপ কাতারে এলো যেভাবে | FIFA World Cup 2022