সিরাজগঞ্জে হিন্দু পরিবারের তিন সদস্যকে খুনের ঘটনার সাথে সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক নেই

গত ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সিরাজগঞ্জ জেলার তারাশ উপজেলায় এক হিন্দু পরিবারের তিন সদস্যকে গলা কেটে নৃশংস ভাবে হত্যার পেছনে সাম্প্রতিক কারণ জড়িত দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জে হিন্দু

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে এক্সের (সাবেক টুইটার) কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে, সিরাজগঞ্জে হিন্দু পরিবারের তিন সদস্যকে খুনের ঘটনার সাথে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোনো সম্পর্ক নেই। উক্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোনো মুসলিম ব্যক্তির সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেনি। বরং হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে পুলিশ রাজীব কুমার ভৌমিক নামের এক হিন্দুধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে যিনি জিজ্ঞেসাবাদে হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ত থাকার বিষয় স্বীকার করেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। রাজীব কুমার ভৌমিক নিহত ব্যক্তিদের একজন নিকটাত্মীয় বলেও জানা গেছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে জাতীয় দৈনিক Daily Obserber ওয়েবসাইটে গত ৩১ জানুয়ারি “Entire family is finished by nephew” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Daily Observer

সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডলের বরাতে উক্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, রাজীব কুমার ভৌমিকের মামা বিকাশ চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে সুদসহ ২৬ লাখ টাকা দিলেও বিকাশ তার কাছ থেকে সুদসহ আরও ৩৫ লাখ টাকা চান।

গত ২২ শে জানুয়ারী বিকাশ তার ভাগ্নে রাজীবকে এক সপ্তাহের মধ্যে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতে চাপ দেন এবং রাজীব টাকা জোগাড় করতে ব্যর্থ হওয়ায় চাচা বিকাশ মোবাইল ফোনে তার বোন ও ভাগ্নে রাজীবকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। টাকা জোগাড় করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজীব তার মামাসহ পুরো পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২৭ জানুয়ারি বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রাজীব তার মামাকে ফোন করে টাকা দেওয়ার কথা বলেন। তবে বিকাশ সরকার তাড়াশ উপজেলার বাহিরে থাকায় তিনি রাজীবকে তার মামি স্বর্ণার কাছে টাকা রেখে দিতে বলেন।

মামির অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাজীব তার মামার বাড়িতে চলে আসেন এবং কৌশলে তুশির মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করেন। তুশি অজ্ঞান হয়ে পড়লে রাজীব ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার গলা কেটে হত্যা করেন।

তারপর তার খালা কফি নিয়ে ফিরলে রাজীব তাকেও একইভাবে মেরে ফেলেন। পরবর্তীতে রাজীব তার মামা বিকাশকে ডেকে আনেন এবং তিনি ঢুকলে রাজীব তাকে একইভাবে হত্যা করেন। তারপর একটি কক্ষে লাশগুলো রেখে রাজীব তালা লাগিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান।

জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটে গত ৩১ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পুলিশ নিহত বিকাশ সরকারের মুঠোফোনের কল লিস্ট ধরে হত্যাকাণ্ডের আগে ভাগ্নে রাজীবের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলার বিষয়টি লক্ষ করে। এই সূত্র ধরে পুলিশ রাজীব ও ভিক্টিমের আরও কয়েকজন আত্মীয়কে ২৮ জানুয়ারি তাড়াশ থানায় ডেকে নেয় পুলিশ। রাজীবের কথাবার্তা সন্দেহজনক মনে হওয়ায় পুলিশ তাকে আটক করে রাতে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব তার মামা, মামি ও মামাতো বোনকে একসঙ্গে হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে রাজিবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত লোহার রড একটি পুকুর থেকে এবং রক্তমাখা হাসুয়া তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া, মূলধারার আরেক সংবাদমাধ্যম  ‘চ্যানেল২৪’ এর ইউটিউব চ্যানেলে “সিরাজগঞ্জে ট্রিপল মার্ডারের রহস্য উন্মোচন, খুনি ভাগ্নে রাজিব” শীর্ষক শিরোনামে পুলিশের প্রেস ব্রিফিং থেকেও একই তথ্য জানা যায়।

মূলত, গত ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় এক হিন্দু পরিবারের তিন সদস্যকে (বিকাশ সরকার, বিকাশ সরকারের সহধর্মিণী স্বর্ণা রানী সরকার এবং তাদের একমাত্র সন্তান পারমিতা সরকার ওরফে তুষি) গলাকেটে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মুসলমানরা অর্থাৎ সাম্প্রতিক সহিংসতার সম্পর্ক রয়েছে দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধান জানা যায়, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় সন্তানসহ দম্পতি খুনের উক্ত ঘটনায় নিহতের আত্মীয় রাজীব কুমার ভৌমিক নামের এক হিন্দু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন রাজিব এবং আর্থিক বিরোধের কারণে এই খুন করেছেন বলে জানিয়েছেন। রাজিবের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। তাছাড়া এ ঘটনায় এখন অবধি কোনো মুসলিম জড়িত থাকার তথ্য মেলেনি। 

প্রসঙ্গত, পূর্বে একই দাবির বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, সিরাজগঞ্জে এক হিন্দু পরিবারের তিন সদস্যকে গলাকেটে হত্যার ঘটনায় মুসলমানরা জড়িত দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img