বিএনপির কার্যালয়ে বক্তব্য দেওয়া মিয়ান আরেফি জো বাইডেনের উপদেষ্টা নয়

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির মহাসমাবেশের পর সন্ধ্যায় কার্যালয়ের ভেতরে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা মিয়ান আরাফি শীর্ষক একটি দাবি কতিপয় গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে। 

 মিয়ান আরেফি

উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন কালবেলা, মানবজমিন, ইনকিলাব, জাগোনিউজ২৪, বাংলা ইনসাইডার, বাংলাদেশ টাইমস (ফেসবুক)। 

একই দাবিতে গণমাধ্যমের ফেসবুকের ফেসবুক পোস্টসহ আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপির কার্যালয়ে বক্তব্য দেওয়া মিয়ান আরেফি মার্কিন সরকার সংশ্লিষ্ট কেউ নয় এবং ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্যও নয় বরং প্রবাসী এই মার্কিন নাগরিক নিজের সাথে মার্কিন সরকারের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে দাবি করার পর তা গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দুইটি দাবির কোনোটিই সত্য বলে প্রমাণ মেলেনি। 

প্রাথমিক অনুসন্ধানে কী জানা গেছে?

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে দেশীয় গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবরগুলো পড়ে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। গণমাধ্যমগুলো দাবি করেছে, ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন বাইডেনের কথিত এই উপদেষ্টাকে বিএনপি কার্যালয়ে নিয়ে যান।

বিষয়টি জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের কর্মকর্তা শায়রুল কবির খানের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে জানতে পারে, এই বিষয়ে বিএনপি কিছু জানে না। বিএনপিকে দূতাবাস থেকে তার ব্যাপারে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

পরবর্তীতে দলটির ফেসবুক পেজেও এ সংক্রান্ত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি (আর্কাইভ) প্রকাশের মাধ্যমে একই তথ্য দেওয়া হয়।  

Screenshot: Facebook 

এই ঘটনায় গত ২৯ অক্টোবর জাতীয় দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইশরাকের বক্তব্যও খুঁজে পাওয়া যায়। ইশরাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, সংঘর্ষের পর অনেক নেতাকর্মী আহত হয়। হাসপাতালে আমি তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করি এবং অন্যদেরও খোঁজখবর নিই। পরে আরও কিছু নেতা-কর্মী আহতাবস্থায় বিএনপি কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছে শুনে তাদের খোঁজখবর নিতে সেখানে যাই। তার পরপরই সাবেক সেনা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল হাসান সারওয়ার্দী দুজন ব্যক্তিকে নিয়ে আসেন।

তিনি দাবি করেন, হাসান সারওয়ার্দীর সঙ্গে আসা একজন নিজেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা বলে পরিচয় দেন। আহতদের সঙ্গে কথাও বলতে চান। আহতরা সে সময় কার্যালয়ের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন কক্ষেই অবস্থান করছিলেন। তাই তাদের সঙ্গে কথা বলার পর সেখানে থাকা সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। এ সময় তাদের সঙ্গে আমাকেও বসতে বললে সে পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে আমিও অংশ নেই। এর বাইরে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে আমি আর তেমন কিছু জানি না।

এছাড়া, সেদিন নয়া পল্টনের কার্যালয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাথেও জনাব আরাফিকে কথা বলতে দেখা (আর্কাইভ) যায়। 

Screenshot: Facebook

২৮ অক্টোবর রাতে জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সংবাদে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলর স্টিফেন ইভেলি (Stephen Ibelli) এর বরাতে বলা হয়, নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশ ও সংঘাত ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস প্রতিনিধিদল ওই এলাকা পরিদর্শন করেছে বলে যে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল তা পুরোপুরি অসত্য।

স্টিফেন ইভেলি বলছেন, “ওই ভদ্রলোক যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে কথা বলেন না। তিনি একজন বেসরকারি ব্যক্তি।”

Screenshot: Kaler Kantho 

সংবাদ সম্মেলনে কী বলেছিলেন মিয়া আরাফি? 

২৮ অক্টোবর রাতে ফেসবুকের একটি পোস্টে (আর্কাইভ) বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জনাব আরাফির দেওয়া বক্তব্যের ১৩ মিনিটের একটি ক্লিপ খুঁজে পাওয়া যায়।

আরাফি জানান, “আমি গতকালের আগের দিন (২৬ অক্টোবর) ওয়াশিংটন থেকে এসেছি। আমি ঘুমানোর সময় পাইনি। আমি এখানে ইভেন্টটা কেমন হচ্ছে তা দেখার জন্য শুধু এসেছি। যা ঘটেছে আমরা এমন কিছু আশা করি নি। এটা লজ্জাজনক সকলের জন্য, বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারের জন্য।” 

আরাফি বলেন, “আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেন সারওয়ার্দীকে। তিনি সবকিছু আয়োজন করতে এবং বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম এবং অন্য মুসলিম এবং গণতন্ত্রমনা দলগুলোকে একসাথে করতে কঠোর পরিশ্রম করছেন।”

জনাব আরাফি দাবি করেন, “বাংলাদেশে কোনো গণতন্ত্র নেই। বাংলাদেশে কোনো কথা বলার স্বাধীনতা নেই। আমি এ বিষয়ে পুরোপুরি অবগত আছি।”

আরাফি তার দীর্ঘ বক্তব্যে দাবি করেন, “আমি বাংলাদেশে গত প্রায় ৪৫ বছর পর গত বছর দেশে এসেছিলাম। আমি আবিষ্কার করলাম, সব কিছুই ভুল চলছে। আমি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়েছি। আমি স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে ২০২২ সালের ০২ ডিসেম্বর মিটিং করেছি। সেখানে ফরেন অফিসার মিস কেলা উপস্থিত ছিলেন। তিনি এখন ঢাকায় আছেন। তারা যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে কাজ করেন। সবকিছু মনিটরিং করছেন। আমি তাকে বলেছি, সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষ খাবার কিনে খেতে পারছে না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ সকালের নাস্তা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তারা লাঞ্চ-ডিনারের খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সেখানে কোনো মাছ, মুরগী, গরু, খাসি বা অন্যকিছু থাকে না। থাকে শুধু ভর্তা ভাজি ডাল এবং ভাত। ইউএস ডিপার্টমেন্ট এসব বিষয়ে অবগত আছে। আমি তাদের বিস্তারিত বলেছি।”

নিজেকে বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশেই জন্মগ্রহণ করেছেন দাবি করে আরাফি বলেছেন, তার পুরো পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছে। প্রায় ৫০ বছর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। তার দাদা-দাদি/নানা-নানি উল্লাপাড়ায় থাকেন।

আরাফির দাবি, তিনি যখন বাংলাদেশে আসেন তখন বাংলা ভাষায় খুব একটা কথা বলতে পারতেন না। 

আওয়ামী লীগের লোকেদের অনেক কালো টাকা আছে দাবি করে তিনি বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে এদের।  

গানশটের বিষয়ে উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে তিনি এ বিষয়ে জানিয়ে মেসেজ করেছেন। তিনি এই বার্তা স্টেট ডিপার্টমেন্টকে, সেক্রেটারি অ্যান্থমী ব্লিঙ্কেন, এখানকার রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস এবং তিন ফরেন অ্যাফেয়ার্স অফিসার মিস কেলা, মিস ম্যাথিউ ও মিস্টার চেটবিয়াকে পাঠিয়েছেন বলেও দাবি করেন। 

কিন্তু এখন আমেরিকায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন জানিয়ে তিনি দাবি করেন, আমি জরুরি ভিত্তিতে মেসেজগুলো দিয়েছি এবং আমি নিশ্চিত যে তারা দ্রুতই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। আমি পুলিশ ফোর্স, আনসার ফোর্সকে স্যাংশন দিতে আহ্বান জানিয়েছি এবং এটা হতেই হবে। 

আরাফি দাবি করেছেন, তিনিই সেই লোক যে র‌্যাবের উপরও স্যাংশন দিয়েছিল। 

Screenshot: Facebook

তিনি বলছেন, “এখন পুলিশ, হোম মিনিস্টার, ফরেন মিনিস্টার এবং ল মিনিস্টারকেও স্যাংশন দিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। কারণ সময় নেই৷ সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে এটা করতে হবে।” 

আরাফি তার বক্তব্যে দাবি করেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়।”

তার দাবি, “আমি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক কমিটির সদস্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা। জো বাইডেনের সাথে ১০-১৫ বার দিনে মেসেজ আদান প্রদান হয়। তিনি বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকায় ১/২ টি মেসেজের জবাব দেন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানে, আমি এখানে।” 

কে এই আরাফি? 

আরাফির বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার দেওয়া পরিচয়ের পক্ষে প্রমাণ না মেলায় আমরা বিষয়টি নিয়ে স্বাধীন অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিই। 

হোয়াইট হাউজের ওয়েবসাইটে বাইডেনের কতিপয় উপদেষ্টাদের নাম ধরে সার্চ করে তাদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেলেও (, ) মিয়ান আরেফির নাম ধরে সার্চ করে কোনো তথ্য মেলেনি। 

Screenshot: White House 

মিয়ান আরাফি নামটির ইংরেজি বিভিন্ন অক্ষরের বানান দিয়ে কি ওয়ার্ড সার্চ করে লিংকডইনে Mian Arefy নামে একটি অ্যাকাউন্ট (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়। অ্যাকাউন্টের প্রোফাইলের ছবির সাথে আলোচিত ব্যক্তির মিল লক্ষ্য করা গেছে।

Screenshot: Linkedin

লিংকডইন অ্যাকাউন্টের নাম অনুযায়ী বাংলায় তার নাম অনেকটা মিয়া আরেফি বলেই প্রতীয়মান হয়। অ্যাকাউন্টে তার জন্ম তারিখ ০৯ আগস্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের ডামাসকাসে থাকেন বলেও জানা যাচ্ছে অ্যাকাউন্ট থেকে। 

অ্যাকাউন্টের About সেকশনে নিজেকে ম্যানেজমেন্ট প্রোফেশনাল হিসেবে দাবি করে এই ফিল্ডে বিশ বছরেরও বেশি সফল অভিজ্ঞতা থাকার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। একই সেকশনে নিজের কাজের একাধিক ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করলেও তিনি যে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বলে দাবি করেন তা উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

Screenshot: Linkedin

জনাব আরেফির এই অ্যাকাউন্টে সর্বশেষ এক্টিভিটি ছিল আট মাস পূর্বে। সে সময় ওয়ালমার্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যাথরিন ম্যাক্লে এর একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলেন তিনি। ওয়ালমার্টের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান Sam’s club বিষয়ক পোস্টটিতে তাকে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজমেন্টের সমালোচনা করতে দেখা যায়। 

মিয়ান আরেফি লিংকডইনে তার পেশাজীবনের বিষয়ে বিষদ উল্লেখ রেখেছেন। তার অ্যাকাউন্ট থেকে জানা যাচ্ছে, তিনি ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কে Duane Reade Drugs নামের একটি প্রতিষ্ঠানে স্টোর ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। সাড়ে তিন বছর সেখানে কাজ করার পর পরবর্তী প্রায় ১২ বছর সমজাতীয় পদে কাজ করেছেন যথাক্রমে Pathmark Drug Stores, F&M Distributors এবং CVS Caremark Corporation এ। ২০০০ সাল থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও ছয়টি একই ধরণের প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন তিনি। ২০১৬ সালে তিনি স্টোর টিমের লিড পদে যোগ দেন Big Lots Stores নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। বর্তমান অবধি তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সাথেই যুক্ত আছেন বলে উল্লেখ করেছেন। 

বিগ লটস যুক্তরাষ্ট্রের রিটেইল চেইন শপ। প্রতিষ্ঠানটির চিফ হিউমান রিসোর্স অফিসার মাইক স্কোলোনস্কাই সহ একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। 

কি ওয়ার্ড সার্চ করে জনাব মিয়ান আরেফির অন্তত তিনটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

Screenshot: Facebook

এর মধ্যে একটি অ্যাকাউন্ট (আর্কাইভ) লক অবস্থায় থাকায় বিস্তারিত তথ্য জানা না গেলেও About সেকশনে উল্লেখ রয়েছে, তিনি বাংলাদেশের পাবনা জিলা স্কুল এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া, একই সেকশনে নিজেকে তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক কমিটির সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু উক্ত সেকশনে বাইডেনের উপদেষ্টা শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

Screenshot: Facebook

জনাব আরেফির অ্যাকাউন্টে উল্লেখ থাকা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক কমিটির সদস্য শীর্ষক তথ্যটির বিষয়ে অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রের Democratic National Committee এর ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির একটি ক্যাম্পেইন ভিত্তিক উদ্যোগ, যার মাধ্যমে এটির সদস্যরা জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচনী প্রচারণায় ডেমোক্রেটদের পক্ষে কাজ করে থাকে। ওয়েবসাইটের লিডারশীপ সেকশনে এই কমিটির সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তিদের তালিকা রয়েছে, সেখানে এবং উক্ত ওয়েবসাইটসহ অনলাইনে একাধিক পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করে মিয়ান আরেফির সাথে এই কমিটির সংশ্লিষ্টতা মেলেনি। 

আরেফির আরো দুইটি অ্যাকাউন্টের (, ) কোনোটিতেই তার কথিত দুই পরিচয়ের (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক কমিটির সদস্য, জো বাইডেনের উপদেষ্টা) বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ নেই। 

মিয়া আরেফির ফেসবুক অ্যাক্টিভিটির সালভিত্তিক বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, গত ১৩ অক্টোবর American Bangla Channel নামে একটি পেজের টক শোতে তাকে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক কমিটির সদস্য বলে পরিচয় দেওয়া হয়। গত ২৬ জুন তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের একটি আনঅফিশিয়াল গ্রুপে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্ট করতে দেখা যায়। আবার, একই মাসে এক ব্যক্তি জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করার ঘোষণার বিষয়ে জানিয়ে করা পোস্টে আরেফিকে ট্যাগ করেন। সেখানে আরেফি কমেন্ট করে বলেন, “জয় বাংলা নয়, জয় বাংলাদেশ হবে। কারণ আমরা মুসলিম।”

২০২২ সালে আরেফি পাবনার একটি গ্রুপে করা পোস্টে নিজেকে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক কমিটির সদস্য পরিচয় দিয়ে জানান, তিনি তার শহর পাবনাকে মিস করছেন। 

একই বছর আবদুল বাতেন হিরু নামে এক ব্যক্তি অন্তত দুইটি পোস্ট (, ) করেন মিয়া আরেফিকে নিয়ে। 

একটি পোস্ট (আর্কাইভ) থেকে জানা যাচ্ছে, আরেফির বাবার নাম রওশন আলী। আরেফির বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার হাটিকুমরুল ইউনিয়নের মানিকদিয়ার গ্রামে। 

আরেক পোস্ট (আর্কাইভ) থেকে জানা যাচ্ছে, আরেফির ডাকনাম বেলাল। তারা দশ ভাই বোন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। 

এই পোস্টেই জনাব হিরু আরেফির নাম সম্বলিত Democratic National Committee এর একটি মেম্বারশিপ কার্ডের ছবি যুক্ত করেন। 

আরেফিকে ২০২১ সালের ০৫ এপ্রিল একটি ফেসবুক গ্রুপে হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের বিষয়ে একটি পোস্ট  করতে দেখা যায়। তিনি সেখানে লিখেছেন, “মামুনুল হককে ফাঁসাতে নিজের স্ত্রীকে ব্যবহার করেছে যুবলীগ নেতা রনি। মিডিয়াতে যে মেয়েটির পরিচয় দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেই মেয়েটি আসলে যুবলীগ নেতা রনির আসল বউ।”

একই গ্রুপে একই বছরের ০৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি দুর্ঘটনার বিষয়ে করা তার পোস্ট দেখুন এখানে।

আরেফির কথিত মেম্বারশিপ কার্ডের বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে 

জনাব হিরুর পোস্ট থেকে পাওয়া Official 2022 DNC Membership Card লেখা আলোচিত কার্ডটি থেকে জানা যাচ্ছে, মিয়ান আরেফি ২০২১ সাল থেকে মেম্বার রয়েছেন। কার্ডের পেছনে লেখা রয়েছে, এই কার্ডধারী ব্যক্তি নিজেকে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির কন্ট্রিবিউটিং মেম্বার বলে পরিচয় দিতে পারবেন। কার্ডের নাম্বার 33364435।

Image: Facebook 

এই কার্ডের বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম দেখেছে, ডেমোক্রেটিক পার্টিতে কেউ ডোনেশন (সর্বনিম্ন ১০ ডলার) দিলে পার্টির পক্ষ থেকে এই কার্ড সরবরাহ করা হয়। ২০২২ সালে এ সংক্রান্ত ক্যাম্পেইন লিংক দেখুন এখানে। 

Screenshot: ActBlue

২০২৩ সালে এ সংক্রান্ত ক্যাম্পেইন লিংক দেখুন এখানে। 

এই কার্ডধারী আমর হালদার নামে আরেক বাংলাদেশির ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে। 

Screenshot: Facebook 

অর্থাৎ, আরেফি ডোনেশনের মাধ্যমে Democratic National Committee এর একটি সম্মানসূচক কন্ট্রিবিউটিং মেম্বারশিপ কার্ড পেয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি নিজেকে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য বলে দাবি করছেন। 

তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী? 

২৮ অক্টোবর নয়া পল্টনের সংবাদ সম্মেলনে মিয়ান আরেফি “যুক্তরাষ্ট্র সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়” শীর্ষক যে দাবি করেছেন তার পক্ষে কোনো প্রমাণ মেলেনি। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একাধিক কর্মকর্তা বিভিন্ন সময়েই বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু এসব বক্তব্যে তারা বাংলাদেশের জনগণ বা যুক্তরাষ্ট্র সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেননি।

তবে ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে একই এবং সমজাতীয় দাবি ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে এ সংক্রান্ত একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। 

আরেফির বিষয়ে সর্বশেষ যা জানা যাচ্ছে 

মিয়ান আরেফির বিরুদ্ধে গত ২৯ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলায় আরেফি ছাড়াও আসামি করা হয়েছে একই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান সারওয়ার্দী এবং বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে। 

মামালার এজাহার থেকে জানা যাচ্ছে, অপরের রূপ ধারণ ও মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিশ্বাস ভঙ্গ করার অভিযোগ এনে এই তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

এর আগে একইদিন দুপুরে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আরেফিকে আটক করা হয়। গণমাধ্যমে পুলিশের একটি সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, ওই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্র পালিয়ে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। 

সেদিন রাতেই গণমাধ্যমে তার স্বীকারোক্তিমূলক একটি বক্তব্যের ভিডিও প্রচার করা হয়। প্রায় তিন মিনিট দৈর্ঘ্যের ভিডিওটিতে তাকে বলতে শোনা যায়, ডেমোক্রেট কমিটির লিডার এবং জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয় তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলতে। 

আরেফির দাবি, তিনি ভুল করেছেন এবং এটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। 

এ বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদের বক্তব্য দেখুন এখানে। 

ডিবি প্রধান জানিয়েছেন, তার নাম মিয়া জাহিদুল ইসলাম আরেফি। তার বাড়ি পাবনা। তিনি ২০২২ সালে বাংলাদেশে এসে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তিনি থাকতেন ঢাকায় বারিধারা ডিওইচএসে। সেখানে পরিচয় হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান সারওয়ার্দীর সাথে। এরপর তাদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়৷ তিনিই তাকে নয়া পল্টনে নিয়ে যান।

এদিকে ৩০ অক্টোবর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মিয়া আরেফীর জন্য কনস্যুলার অ্যাক্সেস চেয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। আরেফী মার্কিন নাগরিক হওয়ায় কনস্যুলার এক্সেস (যোগাযোগ বা আলাপের জন্য অনুমতি) চেয়েছে মার্কিন দূতাবাস।

মূলত, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়া পল্টনে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির মহাসমাবেশের পর সন্ধ্যায় সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা মিয়ান আরাফি পরিচয়ে এক ব্যক্তি বক্তব্য দেন। পরবর্তীতে উক্ত ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা দাবি করে কতিপয় গণমাধ্যমের খবরে প্রচার করা হয়। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, মিয়ান আরেফির সাথে মার্কিন সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই যা ঢাকার মার্কিন দূতাবাস নিশ্চিত করেছে। তিনি নিজেকে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তার কাছে Democratic National Committee এর একটি সম্মানসূচক কন্ট্রিবিউটিং মেম্বারশিপ কার্ড রয়েছে যা ডোনেশনের মাধ্যমে যে কেউই পেতে পারে। 

সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মিয়ান আরেফি নিজেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা এবং ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য বলে দাবি করছেন এবং তা গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img