বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ডেডলাইন দেয়নি

সম্প্রতি, ‘আওয়ামী লীগ সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ডেডলাইন জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র’ শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। 

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন- এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

টিকটকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন- এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে  যুক্তরাষ্ট্র কোনো মন্তব্য করেনি বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অবস্থান নেই বলে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।

অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। গত ১৯ আগস্ট shershanews24.com নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে আলোচিত ভিডিওটি প্রচার করা হয়। 

এতে দাবি করা হয়-

‘আওয়ামী লীগ সরকারকে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ডেডলাইন জানিয়ে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে গত দুই টার্মে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়া এবং এবারও সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার আশঙ্কা থেকে এবাবের নির্বাচন সুষ্ঠু করতে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এর জন্য যা যা করা দরকার যুক্তরাষ্ট্র তা অবশ্যই করবে। যত কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা তারা নেবে।’

ভিডিওটিতে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ সেপ্টেম্বরের পর চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেবে বলেও জানানো হয়। তবে সেখানে এসব তথ্যের সূত্র হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো সোর্স উল্লেখ না করে সংশ্লিষ্ট কুটনৈতিক সূত্রের কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া উক্ত ভিডিওতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটাস হাসের সাথে আওয়ালীগ সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দুইটি বৈঠকের কথা উল্লেখ করা হয়। একটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সাথে। অন্যটি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে মূলধারার গণমাধ্যম ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা সংস্করণে গত ০৩ আগস্ট ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অবস্থান নেই—আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর বললেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৩ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে। যার মাধ্যমেই বাংলাদেশের জনগণ তাদের পরবর্তী সরকার নির্বাচন করবে।

এছাড়া, মূলধারার গণমাধ্যম বিডিনিউজ ২৪ এর ওয়েবসাইটে গত ০৩ আগস্ট ‘নির্বাচন কীভাবে সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়: পিটার হাস’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন দলীয় সরকার না তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হবে, প্রধান দুই দলের এই বিরোধের জায়গায় নিজেকে জড়াতে রাজি নন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, “এটা রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়। আমাদের আগ্রহ শুধু সহিংসতামুক্ত, অবাধ, সুষ্ঠু, নির্বাচন।”

মতবিনিময় শেষে পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেন, “আওয়ামী লীগের সঙ্গে এ বৈঠক, বাংলাদেশে সব দলের সঙ্গে যে সিরিজ বৈঠক করেছি তারই অংশ। আমি অন্য রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় করেছি, এটা আমি করেছি আমেরিকান রাষ্ট্রদূত হিসেবে। “প্রতিটি মিটিংয়ে আমি একই বার্তার পুনরাবৃত্তি করেছি। এটা আমেরিকার পলিসি- আমরা অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সমর্থন করি। কারো দ্বারা কোনো সহিংসতা চাই না।”

তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, অবাধ-সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে প্রত্যেকের ভূমিকা পালন করার আছে। সরকারের ভূমিকা আছে, গণমাধ্যমে ভূমিকা আছে, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, নিরাপত্তা বাহিনী; অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রত্যেকেরই ভূমিকা পালন করার আছে। 

“আমি আবারও বলছি, যুক্তরাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট দলছীলকে সমর্থন করে না। আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করি, যে পদ্ধতিতে বাংলাদেশের জনগণ তাদের পরবর্তী সরকার বেছে নেবে।”

পরবর্তীতে সালমান এফ রহমানের সাথে বৈঠকের বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে মূলধারার সংবাদমাধ্যম মানবজমিন এর ওয়েবসাইটে গত ১০ আগস্ট ‘সালমান এফ রহমানের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ০৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। ৯ আগস্ট সালমান এফ রহমানের বাসায় যান পিটার হাস। প্রায় দুই ঘণ্টা তিনি সেখানে অবস্থান করেন। তবে বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানা যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া উক্ত বৈঠকের বিষয়ে দেশীয় মূলধারার অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য জানা যায়। এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন বাংলা ট্রিবিউন, যুগান্তর, ঢাকা পোস্ট

এছাড়াও, গত ২০ আগস্ট মূলধারার ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম একাত্তর টিভির ইউটিউব চ্যানেলে ‘যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা ইইউ কেউই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কথা বলেনি’ শীর্ষক শিরোনামে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নিয়ে প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

সেখানে ওবায়দুল কাদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেউই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচন কমিশন নিয়ে কথা বলেনি।

পাশাপাশি ‘আওয়ামী লীগ সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ডেডলাইন জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র’ শীর্ষক দাবিতে ভিডিওটি প্রচারের আগেপরে বা সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধির এমন কোনো মন্তব্য গণমাধ্যম বা সংশ্লিষ্ট অন্যকোনো সূত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

অর্থাৎ, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোনো ডেডলাইন দেয়নি।

মূলত, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে আলোচিত বিষয়টির কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণের বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করেনি।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ মে এক টুইট বার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন। টুইট বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালে বাংলাদেশে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা আর পূর্ণবহাল করা হয়নি।

সুতরাং, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সরকারকে ডেডলাইন দিয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

spot_img