মেসি ম্যাচ সেরা পুরস্কার ম্যাক অ্যালিস্টারকে দিয়ে দেননি

সম্প্রতি “আর্জেন্টিনা বনাম পোল্যান্ড  ম্যাচে ফিফা মেসিকে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ঘোষণা করেছিলো। কিন্তু মেসি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ গ্রহণ না করে ম্যাক এলিস্টার কে পাঠায়।” শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ইউটিউবে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

উক্ত বিষয়ে মূলধার গণমাধ্যম মানবজমিন, নয়া দিগন্ত, বিডি২৪রিপোর্টে প্রতিবেদন প্রচার করা হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আর্জেন্টিনা বনাম পোল্যান্ড ম্যাচে মেসি নিজের ম্যাচ সেরার পুরস্কার ম্যাক অ্যালিস্টারকে দিয়ে দেননি বরং ম্যাক অ্যালিস্টারই ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গুজবের সূত্রপাত

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ০১ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনা বনাম পোল্যান্ড ম্যাচের পর ভোর ৫টা ৫৪ মিনিটে ‘FIFA World Cup Stats’ নামের একটি ভেরিফাইড টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বপ্রথম এই বিষয়টি প্রচার করা হয়। পরবর্তীতে অনুবাদ ও কপি-পেস্টের মাধ্যমে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে, উক্ত টুইটার অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় এটি আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থার (ফিফা) অফিশিয়াল কোনো অ্যাকাউন্ট নয়। অ্যাকাউন্টির বায়ো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ফিলিপ লাউয়ার আলিমো নামের এক ব্যক্তির ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট লিংকড করা রয়েছে। আলোচিত এই টুইটার অ্যাকাউন্টের ইউজারনেম এবং বায়োতে থাকা ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টের ইউজারনেম লক্ষ্য করে দেখা যায় ইউজারনেম দুইটি প্রায় একই। যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় টুইটার এবং ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট দুইটি একই ব্যক্তির।

পরবর্তীতে, ফিলিপ লাউয়ার আলিমো নামের উক্ত ব্যক্তির ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুঁজে পাওয়া যায়। অ্যাকাউন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হওয়া উক্ত ব্যক্তিটি একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং তিনি ক্যালিন (Callin) নামের একটি পডকাস্টিং ওয়েবসাইটে ফুটবল বিষয়ক পডকাস্ট করেন।

তাছাড়া অনুসন্ধানের মাধ্যমে, ওয়েব্যাক মেশিনে উক্ত টুইটার অ্যাকাউন্টের বেশ কিছু আর্কাইভ পাওয়া যায়। ২০২১ সালের ০১ আগস্টের একটি আর্কাইভে দেখা যায় সেসময় উক্ত টুইটার অ্যাকাউন্টের নাম ছিলো #Tokyo2020 এবং ২০২২ সালের ১৫ জুনের একটি আর্কাইভে দেখা যায় সেসময় নাম ছিলো #ChampionsLeague। যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় বিভিন্ন বড় ইভেন্টকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত এই টুইটার অ্যাকাউন্টের নাম পরিবর্তন করা হয়েছিলো এবং সেসময়েও এই টুইটার প্রোফাইলটি ভেরিফাইড ছিলো।

Screenshot Source: archive.org

Screenshot Source: archive.org

সুতরাং, “পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে মেসি ম্যাচের সেরা হয়েও সতীর্থর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন” শীর্ষক দাবিটি সর্বপ্রথম যে টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচার করা হয়েছিলো সেটি ফিফার অফিশিয়াল কোনো অ্যাকাউন্ট নয় বরং ফিফার নামে তৈরি একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট।

ম্যাচ সেরার পোস্টারে মেসির ছবি কেন?

আলোচিত টুইটার অ্যাকাউন্টের পোস্টে ‘Player of The Match’ শীর্ষক একটি পোস্টার সংযুক্ত রয়েছে, যেখানে মেসির ছবি দেখা যাচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে, ফিফার ওয়েবসাইটে হওয়া ম্যাচ সেরার ভোটিংয়ে মেসি  জয়ী হয়েছিলেন এবং মেসিকে ফিফা কর্তৃক ম্যাচ সেরা ঘোষণা করা হয়েছিলো। আর এই দাবির প্রমাণ হিসেবে ম্যাচ সেরার পোস্টারে মেসির ছবিটি দেখানো হচ্ছে।

এই দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে ০৩ ডিসেম্বর হওয়া ব্রাজিল বনাম ক্যামেরুন ম্যাচ চলাকালীন ফিফার ওয়েবসাইটের ভোটিং পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। ফিফার ওয়েবসাইট ম্যাচ সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রতিটি ম্যাচের ৬০ থেকে ৮৮ মিনিট সময় পর্যন্ত সেরা প্লেয়ার নির্বাচনের জন্য ভোট দেওয়া যায়। ভোটিং শুরু হলে মাঠে নেমেছে এমন খেলোয়াড়কে ভোট দেওয়া যায়।

অনুসন্ধানের স্বার্থে ভোটিং পদ্ধতি অবলম্বন করে রিউমর স্ক্যানার টিম। ম্যাচের ৭৪ মিনিট সময়ে ক্যামেরুনিয়ান লেফট ব্যাক কলিন্স ফাইকে ভোট দেওয়া হয়। ম্যাচের ৯৯ মিনিটে গিয়ে ভোটিং বন্ধ হয়ে যায়, তখনও কলিন্স ফাইকে স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিলো। ম্যাচের ফুল টাইম শেষ থেকে সেরা প্লেয়ার ঘোষণার আগ অবদি কলিন্স ফাইকে-ই স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিলো। তবে ম্যাচ সেরা ঘোষণার পরপরই স্ক্রিন থেকে কলিন্স ফাইক সরে ক্যামেরুনের গোলকিপার ডেভিস ইপাসি চলে আসে। লক্ষ্যনীয় যে, কলিন্স ফাইকে যতক্ষণ অবদি স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে ততক্ষণ তার ছবির নিচে  ‘Full Time’ লেখা দেখা যাচ্ছিলো, যখনই ডেভিস ইপাসিকে ম্যাচ সেরা ঘোষণা করা হয় তখন তার ছবির নিচে ‘Fan Voted Player of the Match’ শীর্ষক একটি লেখা চলে আসে।

ভোটিং পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায়, ছবিটি ফিফার ওয়েবসাইটে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হওয়ার নয় বরং ম্যাচ সেরা ঘোষণার পূর্বেই ফিফায় ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া একটি স্ক্রিনশট।

ম্যাচ সেরা

সুতরাং, ‘আর্জেন্টিনা বনাম পোল্যান্ড ম্যাচে ফিফার ওয়েবসাইটে হওয়া সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনের ভোটিংয়ে মেসি সেরা নির্বাচিত হিয়েছিলো’ শীর্ষক দাবিটি সত্য নয়।

এছাড়া, ফিফার ওয়েবসাইটে এখন অবদি হওয়া ম্যাচে সেরাদের একটি তালিকা রয়েছে। সেখান দেখা যাচ্ছে আর্জেন্টিনা বনাম পোল্যান্ড ম্যাচে অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার-ই ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন।

Screenshot Source: FIFA

ফুটবল বিশ্বকাপের অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত একটি টুইটেও একই বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।

তাছাড়া, ম্যাচ সেরার বক্তব্যে দিতে এলে অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারকে প্রশ্ন করা হয়, যদি এই পুরস্কারটি একজন সতীর্থকে দিতে পারেন, তাহলে সে কে হবে এবং কেনো? এর উত্তরে অ্যালিস্টার বলেন, “এটা কঠিন কিন্তু আমি সবসময় লিওকে (মেসি) দিবো, কারণ সে সবকিছু সহজ করে তোলে।”

মূলত, গত ০১ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনা বনাম পোল্যান্ড ম্যাচের পর ‘FIFA World Cup Stats’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ‘নিজের ম্যাচ সেরার পুরস্কার ম্যাক অ্যালিস্টারকে দিয়ে দিলেন মেসি’ শীর্ষক একটি তথ্য প্রচার করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত তথ্যটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত টুইটার অ্যাকাউন্টটি ফিফার নামে তৈরি একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট। এছাড়া, ফিফার ওয়েবসাইটে ম্যাচ সেরার ভোটে ম্যাক অ্যালিস্টার-ই নির্বাচিত হয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, চলমান কাতার ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে একাধিক গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, ‘পোল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের ম্যাচ সেরার পুরস্কার ম্যাক অ্যালিস্টারকে দিয়ে দিলেন মেসি’ শীর্ষক দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img