বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “মেডিকেলের গোপন তথ্য” শীর্ষক শিরোনামে আইসিইউ-তে মৃত রোগীকে গরুকে ইনজেকশন দেওয়ার সিরিঞ্জ পুশ করে জীবিত দেখানো হয় শীর্ষক দাবিতে (বিভিন্ন ধরণের ছবিযুক্ত) আলোচিত দাবিটির সাথে নানা ধরণের ছবি প্রচার হয়ে আসছে। পাশাপাশি দাবিটি সম্বলিত একটি ডিজিটাল ব্যানারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি (২০২৩ সালে) ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট (পুরোনো পোস্ট নতুন করে শেয়ার সহ) দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে,এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ,এখানে এবং এখানে।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট (আর্কাইভ) দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
২০২১ সালে প্রচারিত পোস্ট (আর্কাইভ) দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।

২০২০ সালে প্রচারিত পোস্ট (আর্কাইভ) দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
২০১৯ সালে প্রচারিত পোস্ট (আর্কাইভ) দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
২০১৮ সালে প্রচারিত পোস্ট (আর্কাইভ) দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।
২০১৭ সালে প্রচারিত পোস্ট (আর্কাইভ) দেখুন এখানে, এখানে, এখানে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবিটি প্রচারের পরিসংখ্যান
ফেসবুকের মনিটরিং টুল “ক্রাউডট্যাঙ্গেল” অনুযায়ী এই দাবিটি (এই শিরোনামে) অন্তত ৮২৫ বার পোস্ট করা হয়েছে। যেই পোস্টগুলোতে ৩,১৮,৮৫৩ ইন্টার্যাকশন হয়েছে।

এর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রচার হওয়া পোস্টটি (আর্কাইভ) ১৭ হাজার মানুষ লাইক করেছে। একইসাথে এই পোস্টটি-ই সর্বোচ্চ মতামত (কমেন্ট) 2.8K এবং সর্বোচ্চ শেয়ার 3.3K পেয়েছে। এছাড়াও কমপক্ষে ৪৫ টি পোস্ট হাজারের বেশি লাইক পেয়েছে। [এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত]
বিঃদ্রঃ ক্রাউডট্যাঙ্গেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব পেজ বা গ্রুপ (পাবলিক) থেকে কন্টেন্ট দেখায় না। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক লাইক কিংবা মেম্বার থাকলে তবেই সেই পেজ বা গ্রুপ ক্রাউডট্যাঙ্গেল-এ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালিকাভুক্ত হয়। এছাড়াও প্রোফাইলের পোস্ট-ও ক্রাউডট্যাঙ্গেল দেখায় না।

ক্রাউডট্যাঙ্গেল ব্যতীত 56K লাইকের ভিডিওসহ পোস্ট-ও পাওয়া যায়। ভিডিওটি ভয়েস ওভারসহ (দাবিটি) আইসিইউ ও এ জাতীয় কিছু ছবির সমন্বয়ে ব্যাক্তি উদ্যোগে তৈরি করা।

ইন্টারনেটে যেভাবে গুজবটির সূত্রপাত
অনুসন্ধানে বাংলা ভাষায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “মেডিকেলের গোপন তথ্য !!!” শীর্ষক শিরোনামের দাবির ক্ষেত্রে “Rahmat Hatiya” নামক একটি প্রোফাইল থেকে ২১ জানুয়ারি ২০১৭ বিকেল ৫টা ৯মিনিটে দাবিটির প্রথম পোস্টটি (আর্কাইভ) পাওয়া যায়। এই পোস্টটি শেয়ারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এর প্রায় আড়াইঘন্টা পরে “Kalim Nashir” নামক এর একটি প্রোফাইল থেকে ২১ জানুয়ারি ২০১৭ বিকেল ৭টা ৪৪মিনিটে একই শিরোনামের পোস্টটি (আর্কাইভ) আপ্লোড করা হয়। এই পোস্টটিও শেয়ারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে একই মাসের (২০১৭ সালের জানুয়ারি) ২২, ২৪, ২৫, ২৬ তারিখ সহ প্রায় প্রতিদিন পোস্ট হতে থাকে। এভাবেই পোস্টটি (ভুল তথ্য) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৭ সালের ২৪ তারিখে ডাক্তার তানিয়া সুলতানা নামক একটি পেজ থেকে-ও পোস্টটি প্রচার করা হয়েছে। এই পোস্টটি থেকেই দাবিটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও পোস্টটির আর্কাইভ রাখা সম্ভব হয়নি।

২৫ জানুয়ারিতেও পোস্ট করা হয়েছিল। সেই পোস্টটিও এখন আর পাওয়া যায়না। তবে পোস্টটির স্ক্রিনশটসহ অন্য এক ব্যবহারকারীর একটা কন্টেন্ট পাওয়া যায়।

অবশ্য এই পেজ থেকে পরবর্তীতে একই শিরোনামে দাবিটি ঐ বছর আরও চারবার পোস্ট করা হয়েছে। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের পোস্টটি দেখুন এখানে।

মিথ্যা দাবিটি সত্য হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হতে যে সকল বিষয় বেশি ভূমিকা রেখেছে
বেশকিছু ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ (বিশেষ করে ভেরিফাইড নিউজ রিলেটেড পেজ) থেকে এই মিথ্যা দাবিটি প্রচার করা হয়েছে। যদিও এটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে পোস্টটি করার সময়ে পেজগুলো ভেরিফাইড ছিল কিনা? কিন্তু ভেরিফাইড হওয়ার পরে অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মাঝে পোস্টগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ভেরিফাইড হ্যান্ডেল থেকে করা এমন একটি পোস্ট (আর্কাইভ) দেখুন এখানে (নিউজের পেজ)।

পোস্টের সাথে চিকিৎসা রিলেটেড অবস্থা, প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের ছবি ব্যবহার করে। এর ফলে অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী-ই বিষয়টিকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করার সম্ভাবনা থাকে। এমন কিছু পোস্ট (আর্কাইভ) দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

ডাক্তারদের পেজ/প্রোফাইল থেকে পোস্টের কারণে (নামের সাথে ডাক্তার)। এ জাতীয় পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে। এছাড়াও একসাথে বেশকিছু এমন হ্যান্ডেল থেকে পোস্ট দেখা যাবে ক্রাউডট্যাঙ্গেল এর এই লিংক থেকে।

এমনকি “ডাক্তার তানিয়া সুলতানা” নামক হ্যান্ডেলটি থেকে চারটি ভিন্ন নারীর ছবি ব্যবহার করে ২০১৭ সালের এপ্রিলে, মে, জুন, আগস্ট মাসে একই পোস্টটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে (ডাক্তার হিসেবে একজন নারীর ছবিসহ)। এর মধ্যে মে মাসের পোস্টটি ক্রাউডট্যাঙ্গেল অনুযায়ী এই শিরোনামের পোস্টের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাপেক্ষা লাইক (11K) পেয়েছে এবং জুন মাসের পোস্টটি তৃতীয় সর্বোচ্চ 6.7K লাইক পেয়েছে। এই হ্যান্ডেলটি থেকে ২৪ জানুয়ারিও একই পোস্টটি করা হয়েছিল, যদিও সেটি এখন আর পাওয়া যাচ্ছেনা।

ডাক্তারদের ছবি ব্যবহার করে। এ জাতীয় পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। [ মেডিকেল সরঞ্জাম থাকা সহ মেডিকেল শিক্ষার্থী বা ব্যক্তি যাকে একজন ডাক্তার এর মত মনে হতে পারে সহ ]

মেডিকেল পরামর্শ বিষয়ক নাম যুক্ত ফেসবুক পেজ ব্যবহার করে। এ জাতীয় পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। [ ক্রাউটট্যাঙ্গেল অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি লাইক স্বাস্থ্য কথা নামের একটি পেজের পোস্ট-এ এসেছে ]

লাশের ছবি ব্যবহার করে। এ জাতীয় পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে

এছাড়াও আরো নানা ধরণের ছবিসহ আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে (কারণে)। এ জাতীয় পোস্ট দেখুন
এখানে, এখানে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হ্যান্ডেলের নামের সাথে ডাক্তার শব্দটি উল্লেখ থাকলে মানুষ সেই হ্যান্ডেলের কন্টেন্ট কি বেশি বিশ্বাস করে
অনুসন্ধানে ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি তারিখে ডাক্তার তানিয়া সুলতানা নামক একটি পেজ থেকে-ও পোস্টটি প্রচার করা হয়েছে। যদিও পোস্টটির আর্কাইভ রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি তিনি পরবর্তী দিন অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারিও একই দাবি পোস্ট করেছিলেন। সেই পোস্টটিও এখন আর পাওয়া যায়না। তবে পোস্টটির স্ক্রিনশটসহ অন্য এক ব্যবহারকারীর একটা কন্টেন্ট পাওয়া যায়।

অবশ্য এই পেজ থেকে পরবর্তীতে একই শিরোনামে দাবিটি ঐ বছর আরও চারবার পোস্ট করা হয়েছে। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের পোস্টটি দেখুন এখানে।

পরবর্তীতে, বিভিন্ন প্রোফাইল বা পেজ থেকে এজাতীয় যারা “ডাক্তার তানিয়া সুলতানা” এর নাম সহ যারা আলোচিত শিরোনামের (দাবি) পোস্ট করেছেন তারা প্রায় সকলেই দাবিটি “ডাক্তার তানিয়া সুলতানা” নিজে বলেছেন বা পরামর্শ দিয়েছেন ভেবে পোস্ট করেছেন। অর্থাৎ, তারা প্রায় সবাই ভেবেছেন এই উপদেশ বা পরামর্শটি তানিয়া সুলতানা নামক কোনো এক ডাক্তার দিয়েছেন। সেই বিভ্রান্তির উদাহরণ দেখুন নিচেঃ

এজাতীয় সবগুলো পোস্ট দেখতে ক্লিক করুন এই লিংকে। এছাড়াও এই তথ্যটি (দাবিটি) প্রদান করার জন্য সেসময় ডাক্তার তানিয়া সুলতানাকে ধন্যবাদ-ও জানিয়েছেন এক ব্যবহারকারী।

(এই পোস্টটি ফ্রেন্ডস অনলি প্রাইভেসিতে থাকার কারণে পোস্ট লিংক দেওয়া সম্ভব হলোনা।)
এছাড়াও সমজাতীয় আরো কিছু পোস্ট দেখুন কোলাজ ছবিতে।

যদি এই পেজটি ভুয়া হয়ে থাকে তাহলে বলা যাচ্ছে যে ভুয়া ডাক্তার নামের পেজের পোস্টকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা আসল ডাক্তারের মন্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর যদি হ্যান্ডেলটি সত্যিকারের ডাক্তার তানিয়া সুলতানা এর হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও আলোচিত দাবিটি তার মন্তব্য নয়। কেননা তিনি পোস্ট করার তিনদিন আগে থেকেই দাবিটির অস্বিত্ব ইন্টারনেটে রয়েছে। তাই বলা যায় যে আলোচিত দাবিটি ডাক্তার আরিফা জাহান এর উপদেশ বা পরামর্শ হিসেবে যারা গ্রহণ করেছে তারা সবাই-ই তথ্যের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়েছে।
পাশাপাশি, ডাক্তার সুমাইয়া কবির এর পরামর্শ হিসেবেও দাবিটি কয়েকজন পোস্ট করেছে। পোস্টগুলো দেখুন এই লিংকে।

এছাড়াও, অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আলোচিত দাবিটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হওয়া পোস্টটিতে অনেকে নেতিবাচক (মিথ্যা) মন্তব্য করায় পোস্টকারী একজন ডাক্তারের নাম ও তার পোস্টের বরাত দিয়ে সবাইকে বিষয়টি সত্য হিসেবে যুক্তি দিচ্ছেন।

পোস্টটির পিন’ড কমেন্টে তিনি বিষয়টিকে যাচাই করতে বলেছেন (যারা দাবিটিকে মিথ্যা বলছেন তাদেরকে)। সাথে “ডাক্তার ফারহানা কবির” নামক একটি ফেসবুক হ্যান্ডেল এর পোস্টের (একই দাবির) স্ক্রিনশট যুক্ত করে দিয়েছেন।


তবে এক্ষেত্রেও ডাক্তার ফারহানা কবির নামক এই ফেসবুক হ্যান্ডেল ও পোস্ট এর অস্তিত্ব এখন আর পাওয়া যায়নি। কিন্তু ডাক্তার ফারহানা কবিরের পরামর্শ হিসেবে এই দাবিটি অনেকেই পোস্ট করেছিলেন। পোস্টগুলো দেখুন এখানে।

এ সম্পর্কিত আরো একটি উদাহরণ পাওয়া যায়
অনুসন্ধানে ২০১৭ সালের ১০ই মে “Rubel Hasan” নামক একটি ফেসবুক প্রোফাইলে একটি স্ক্রিনশট পাওয়া যায়। স্ক্রিনশটটিতে দেখা যায়ঃ “ডাক্তার আরিফা জাহান” নামক একটি ফেসবুক হ্যান্ডেল থেকে আলোচিত পোস্টটি করা হয়েছে ৩০শে মার্চ ২০১৭। যদিও পোস্টটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও হ্যান্ডেলটিও এখন আর পাওয়া যায়না।

তবে এই পোস্টের পরে ১০ এপ্রিল “Md Ashrafur Rahman” নামক একটি প্রোফাইল থেকে আলোচিত দাবিটি ডাক্তার আরিফা জাহান এর নাম সহ প্রচার করা হয় (এই পোস্টের ক্ষেত্রে কপি করার কারণে নাম ও পোস্টের তারিখসহ উল্লেখ হয়েছে)।

পরবর্তীতে, “Md Ashrafur Rahman“ এর পোস্টটির হুবহু কপি করে আরও বিভিন্ন প্রোফাইলে পোস্ট করা হয়। ধারণা করা যায়, এক্ষেত্রে “Aminul Islam” নামক প্রোফাইল বা এজাতীয় যারা ডাক্তার আরিফা জাহান এর নামসহ যারা পোস্ট করেছেন তারা প্রায় সকলেই দাবিটি “ডাক্তার আরিফা জাহান” নিজে বলেছেন বা পরামর্শ দিয়েছেন ভেবে পোস্ট করেছেন। অর্থাৎ, তারা প্রায় সবাই ভেবেছেন এই উপদেশ বা পরামর্শটি আরিফা জাহান নামক কোনো এক ডাক্তার দিয়েছেন।

পূর্বের ন্যায়, যদি এই পেজটি ভুয়া হয়ে থাকে তাহলে বলা যাচ্ছে যে ভুয়া ডাক্তার নামের পেজের পোস্টকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা আসল ডাক্তারের মন্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর যদি হ্যান্ডেলটি সত্যিকারের ডাক্তার আরিফা জাহান এর হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও আলোচিত দাবিটি তার মন্তব্য নয়। কেননা তিনি পোস্ট করার দুই মাস আগে থেকেই দাবিটির অস্বিত্ব ইন্টারনেটে রয়েছে। তাই বলা যায় যে আলোচিত দাবিটি ডাক্তার আরিফা জাহান এর উপদেশ বা পরামর্শ হিসেবে যারা গ্রহণ করেছে তারা সবাই-ই তথ্যের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়েছে। এমনকি দুইমাস আগে ২৪ জানুয়ারি “ডাক্তার তানিয়া সুলতানা” নামক একটি পেজ থেকে-ও পোস্টটি প্রচার করা হয়েছে।
এর প্রমাণও অবশ্য পাওয়া যায় কিছু পোস্টের মাধ্যমে। ফেসবুকে “ড.মাও.আলী আকবর চৌধুরী” নামক একটি প্রোফাইল থেকে আলোচিত দাবিটি পোস্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে “লিখেছেন: ডাক্তার আরিফা জাহান)”

ফেসবুকে “Nayem Chy Bakul” নামক একটি প্রোফাইল থেকে আলোচিত দাবিটি পোস্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে “লিখেছেন: ডাক্তার আরিফা জাহান)”।

অনিশ্চিত একটি ফেসবুক পেজ এর পোস্টকে সত্যিকারের একজন ডাক্তারের সত্য বক্তব্য/ পরামর্শ হিসেবে প্রচারের এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে হতো। কিন্তু বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পেরিয়ে প্রচার করা হয়েছে মূলধারার গণমাধ্যমে-ও।
আলোচিত ভুল তথ্যটি ভুয়া পেজের বরাতে মূলধারার গণমাধ্যমে
দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যম “বাংলাদেশ প্রতিদিন”-এ ২০১৮ সালের ৮ই এপ্রিল “আইসিইউতে লাশ নিয়ে ব্যবসা” শীর্ষক শীরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “মৃত্যুর পর বাড়তি সময় আইসিইউতে কৃত্রিমভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় রোগীকে রাখার ভয়ানক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। এমনি একটি তথ্য দিয়েছেন ডা. আরিফ জাহান। তিনি তার ফেসবুকে লিখেছেন, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে গরুকে যে ইনজেকশন দেওয়া হয়, সেই ইনজেকশনের সিরিঞ্জ যেভাবে প্রয়োগ করা হয়, ঠিক প্রাইভেট হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত রোগীকে সেভাবে সেই সিরিঞ্জ পুশ করে ২৮ থেকে ৩২ দিন কৃত্তিমভাবে জীবিত রাখা যায়।” [যদিও ভুলক্রমে আরিফা এর স্থলে আরিফ লিখেছে]

এছাড়াও, কারেন্ট নিউজ নামক একটি পোর্টালেও বিষয়টি প্রচার করা হয়েছিল। যদিও পরে তা ডিলেট করে দেওয়া হয় এবং সংরক্ষিত কোনো কপি পাওয়া যায়নি।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেডিকেলের আইসিইউ-তে মৃত রোগীকে গরুর ইনজেকশন দেওয়ার সিরিঞ্জ পুশ করে জীবিত দেখানোর দাবিটি ভিত্তিহীন। এছাড়া গরুর ইনজেকশন পুশ করে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাও সম্ভব নয়।
কি-ওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে,“Dr. Md. Sirajul Islam” নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারিতে “মেডিকেলের গোপন তথ্য, জনস্বার্থে শেয়ার করুন, ICU তে লাশের বাম বগলে কেন ইনজেকশন দেয়?!!!! দেয় কি???” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওতে তিনি উল্লেখ করেন, “এই নিউজটি (দাবিটি) সম্পূর্ণ অসত্য, ভূয়া এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত”।
ঢাকায় অবস্থিত একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সিরাজুল ইসলাম আরো উল্লেখ করেন “একজন মৃত রোগীকে দিনের পর দিন আইসিইউ বা কোথাও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়, এবং রোগীকে কোনো কারণেই বগলে ইনজেকশন দেওয়ার সুযোগ নেই বা দেওয়া হয় না।”
এরপরে ডাঃ সিরাজুল ইসলাম এর সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। রিউমর স্ক্যানার’কে তিনি এক ভিডিও বার্তায় জানান, “এই নিউজটি (দাবিটি) উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন”।
ভিডিওটি দেখুন এখানে।
[ তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতাল-এ এসিসট্যান্ট প্রফেসর এবং ডিপার্টমেন্ট অব ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন-এ হেড হিসেবেও কর্মরত আছেন। ]
একইভাবে দাবিটিকে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ-ঢাকা এর শিশু সার্জারি বিভাগের ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ। রিউমর স্ক্যানার টিম তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ বার্তাটি পাঠান।
বার্তায় তিনি আরো জানান, “গরুকে যে ইনজেকশন দেওয়া হয় হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত রোগীকে সেই সিরিঞ্জ পুশ করে ২৮ থেকে ৩২ দিন কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার দাবিটি … মিথ্যা ও বানোয়াট একটি তথ্য।
আইসিইউতে মৃত রুগির বগলে সুক্ষ ছিদ্র থাকলেই ধরে নিতে হবে যে মৃত রুগিকে গরুর ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে এমন দাবিরও কোনো যৌক্তিকতা নেই।
বস্তুতঃ আইসিইউতে যেসব রুগি থাকে তাদের চিকিৎসা ও ফিজিক্যাল নিউট্রিশনের প্রয়োজনে অনেকসময়ই তাদের শরীরের উপরিভাগে কলারবোন (Clavicle)’র নিচে (বগলের কিছুটা কাছাকাছি তবে বগলে নয়) বিশেষায়িত একধরনের সিরিঞ্জ (সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার) দ্বারা একটি চ্যানেল তৈরি করা হয় যার মাধ্যমে রুগিকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও নিউট্রিশনাল সাপোর্ট দেওয়া হয়। এটা করা হয় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও নিউট্রিশনাল সাপোর্ট দিয়ে রুগিকে সুস্থ্য করে বাঁচিয়ে তোলার জন্য, মৃত রুগিকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নয়।
[ এই বার্তাটি পরবর্তীতে তিনি তার নিজের ফেসবুক প্রোফাইলেও পোস্ট করে গুজবটি সম্পর্কে সচেতনতার আহবান করেছেন ]
সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার। ছবিঃ ইন্টারনেট
মূলত, “মেডিকেলের গোপন তথ্য!!!” শীর্ষক শিরোনামে ২০১৭ সালে প্রথম এই দাবিটি সামাজিক যোগাযগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত হয়। এরপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে (প্রায় প্রতিবছর) এই দাবিটি কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ফেসবুকে প্রচার করে হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে একইভাবে এই তথ্যটি পুনরায় প্রচার করা হচ্ছে। তবে, ঢাকায় অবস্থিত একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সিরাজুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ-ঢাকা এর শিশু সার্জারি বিভাগের ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ দাবিটিকে মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কি কেউ-ই বিষয়টিকে মিথ্যা হিসেবে পোস্ট করেনি?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই তথ্যটি সত্য হিসেবে প্রচুর পরিমাণে শেয়ার করা হয়েছে। তবে কয়েকজন ব্যবহারকারী বিষয়টিকে মিথ্যা হিসেবে পোস্ট করেছেন, যা তুলনামূলক অল্প হলেও কিছু ব্যবহারকারী শেয়ার করেছে। এমন পোস্টগুলো দেখুন এখানে।
উল্লেখ্য, বিগত কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে আর্থিক লোভে আইসিইউতে প্রয়োজন ব্যতীত অসুস্থ রোগীকে অতিরিক্ত সময় ভর্তি রাখার (মৃত রোগীকে জীবিত দাবিতে নয়) অভিযোগ রয়েছে এবং এটি নিয়ে জনসাধারণের মাঝে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে প্রচারিত ভুল তথ্য নিয়ে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকটি ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং একটি মূলধারার গণমাধ্যমে আইসিইউতে মৃত রোগীকে গরুর ইনজেকশন দিয়ে জীবিত দেখানো হয় শীর্ষক দাবি প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Dr. Md. Sirajul Islam Youtube: মেডিকেলের গোপন তথ্য, জনস্বার্থে শেয়ার করুন,ICU তে লাশের বাম বগলে কেন ইনজেকশন দেয়?!!!! দেয় কি???
- আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সিরাজুল ইসলাম এর রিউমর স্ক্যানারকে দেওয়া ভিডিও স্টেটমেন্ট।
- ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ। শিশু সার্জারি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা এর স্টেটমেন্ট।