গাজীপুরে গণধর্ষণ দাবিতে রংপুরের ভিন্ন ঘটনার ভিডিও প্রচার

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “গাজীপুরে বাবা-মেয়ে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসে রাস্তায় গণধ’র্ষণের শিকার হোন মেয়ে”। 

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে ইন্সটাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে থ্রেডসে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এছাড়াও, ভিডিওটি ভারত থেকে পরিচালিত এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচার করে দাবি করা হয়, ‘(গাজীপুরে) ইসলামপন্থীরা এক হিন্দু মেয়েকে তার বাবার সামনে গণধর্ষণ করেছে। মেয়েটি এবং তার বাবা এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে ইসলামপন্থীরা তাদের অপহরণ করে। এরপর ইসলামপন্থীরা বাবাকে বেঁধে মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে।’ (অনূদিত)

এরূপ দাবিতে প্রচারিত পোস্টটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি আলোচিত দাবিতে প্রচারিত উপরোল্লিখিত এক্স পোস্টটি ৪ লক্ষ ৩১ হাজারেরও অধিক বার দেখা হয়েছে এবং সাড়ে ৪ হাজারেরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্টটিতে লাইক দেওয়া হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি গাজীপুরের নয় এবং ভিডিওটির সাথে কোনো মেয়ের গণধর্ষণের ঘটনার সংশ্লিষ্টতা নেই। প্রকৃতপক্ষে, প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত মেয়ের নাম নূপূর দাস। গত ৯ আগস্টে রংপুরের তারাগঞ্জে ভ্যানচোর সন্দেহে নূপুর দাসের পিতা রূপলাল দাস ও রূপলালের নিকটাত্মীয় প্রদীপ দাসকে গণপিটুনিতে মারা হলে নূপুর দাস কান্না করেন যার ভিডিও আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম ‘এটিএন নিউজ’ এর ইউটিউব চ্যানেলে ‘যাচ্ছিলেন বিয়ের দিন ঠিক করতে, চোর সন্দেহে জামাই-শ্বশুরকে পিটিয়ে হ*ত্যা’ শিরোনামে গত ১১ আগস্টে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির তুলনা করলে মিল পাওয়া যায়। তবে ভিডিওটিতে ধর্ষণের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

Comparison : Rumor Scanner

ভিডিওটিতে প্রদর্শিত মেয়েকে বলতে শোনা যায় তার নাম নূপুর এবং পিতার নাম রূপলাল। এছাড়া আরেকজন ব্যক্তিকে দেখিয়ে নূপুর তাকে চিনেন কি না জিজ্ঞেস করলে নূপুর বলেন সেই ব্যক্তির নাম প্রদীপ। এছাড়া ভিডিওটিতে আরেকটি দৃশ্যে আরেকজন ব্যক্তিকে নিহত ব্যক্তির বিষয়ে বলতে শোনা যায়, নিহত ব্যক্তি জুতার কাজ করা মুচি। তার মেয়ের আশীর্বাদ উপলক্ষে আত্মীয় আসার কথা ছিল। যার মধ্যে ভাস্তি জামাই রাস্তা চেনেন না। এই ভাস্তি জামাই ভ্যান চালান এবং তাকে নিয়ে আসার পথে রাস্তায় মানুষজন চোর সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে এ তথ্যের সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে মূলধারার গণমাধ্যম ‘দ্য ডেইলি স্টার’ এর ওয়েবসাইটে ‘রংপুরে ভ্যানচোর সন্দেহে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা’ শিরোনামে গত ১০ আগস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘রংপুরের তারাগঞ্জে ভ্যানচোর সন্দেহে গণপিটুনিতে দুইজন নিহত হয়েছেন। শনিবার (৯ আগস্ট) রাত ৯টার দিকে উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত দুজন হলেন তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের রূপলাল দাস (৪০) এবং মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস (৩৫)। সম্পর্কে তারা ছিলেন নিকটাত্মীয়। প্রদীপ দাস পেশায় ভ্যানচালক এবং রূপলাল জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন।.. 

পরিবার ও পুলিশ জানায়, রূপলাল দাসের মেয়ের সঙ্গে মিঠাপুকুরের কমল দাসের বিয়ের কথা চলছিল। এই বিয়ের ঘটক ছিলেন প্রদীপ। পরদিন রোববারই (১০ আগস্ট) বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত করার কথা ছিল। এ উপলক্ষে কথা বলতে শনিবার (৯ আগস্ট) রাতে প্রদীপ নিজের ভ্যান নিয়ে রূপলালের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হন। পথেই রূপলালের সঙ্গে দেখা হলে তাকে ভ্যানে তুলে নেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বুড়িরহাট বটতলায় পৌঁছালে স্থানীয় কয়েকজন তাদের ভ্যানটি থামান। ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। একপর্যায়ে কথাবার্তায় ‘অসংগতি’ পাওয়ার কথা বলে কয়েকজন মিলে দুজনকে পেটাতে শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে আরও মানুষ জড়ো হয় এবং গণপিটুনি শুরু করে। এতে রূপলাল ও প্রদীপ রক্তাক্ত ও অচেতন হয়ে পড়লে হামলাকারীরা তাদের বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে ফেলে রেখে যায়।

খবর পেয়ে রাত ১১টার দিকে পুলিশ তাদেরকে উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক রূপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত প্রদীপ দাসকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার (১০ আগস্ট) ভোরে তিনিও মারা যান।’

একইরকম তথ্য আরো একাধিক গণমাধ্যম সূত্রেও জানা যায় এবং প্রচারিত ঘটনার ভিডিওতে নূপুর দাসকেও একইরকম তথ্য উল্লেখ করতে শোনা যায়।

পরবর্তীতে নূপুর দাসের বিষয়ে অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম ‘সমকাল’ এর ওয়েবসাইটে গত ১০ আগস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সূত্রে জানা যায়, “..রূপলালের বড় মেয়ে নূপুর দাস (১৮)।… নূপুর বলে, রোববার (১০ আগস্ট) আমার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য প্রদীপদা মিঠাপুকুর থেকে শনিবার (৯ আগস্ট) রাতে আমাদের বাড়ি আসছিলেন। রাস্তা না চেনায় কাজীরহাট থেকে তিনি বাবাকে ডেকে নেন। সেখান থেকে প্রদীপদার ভ্যানে বাড়ি ফেরার পথে বটতলায় লোকজন তাদের আটক করে মারধর শেষে ফেলে যায়। খবর পেয়ে রাতে বুড়িরহাট গিয়ে বাবা ও দাদার রক্তাক্ত দেহ শনাক্ত করি।”

অনুসন্ধানে কোথাও নূূপুর দাসকে ধর্ষণ করার বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সুতরাং, রংপুরে গণপিটুনিতে নিহত ব্যক্তির মেয়ের কান্নার ভিডিওকে গাজীপুরে গণধর্ষণের শিকার মেয়ের ভিডিও দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img