জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গত ২৫ নভেম্বর বিকেলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র এবং পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন ২৬ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হলে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত। এরই প্রেক্ষিতে আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিক্ষোভকারীদের হটাতে পুলিশের সাথে যোগ দেন একদল আইনজীবীও। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। তখন সাইফুল ইসলাম নামের এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে অন্তত বুধবার ২৭ (নভেম্বর) থেকে এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট করা একটি পোস্টের স্ক্রিনশট সংযুক্ত করে দাবি প্রচার করা হচ্ছে, সাইফুল হত্যায় কোন সনাতনী জড়িত নয় বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সাইফুল হত্যায় কোন সনাতনী জড়িত নয় শীর্ষক কোনো মন্তব্য ড. ইউনূস করেননি বরং কোনোরকম নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। সাইফুল হত্যার ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে ইতোমধ্যে সাতজনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের নাম দেখে সনাতনী হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করলে তাতে এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট করা একটি পোস্টের স্ক্রিনশটের সংযুক্তি পাওয়া যায়। গত ২৭ নভেম্বর পোস্ট করা উক্ত পোস্টটিতে বলা হয়, “আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন অন্তত ছয়জনকে আটক করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে এই ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার সংঘর্ষ চলাকালে ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে ২১ জনকে আটক করেছে সিএমপি। বন্দরনগরীতে দেশীয় ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ (ককটেল) সহ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
তবে, উক্ত পোস্টে কোথাও দাবি করা হয়নি যে, সাইফুল হত্যায় কোন সনাতনী জড়িত নয়৷ পাশাপাশি উক্ত পোস্টে গ্রেফতারকৃতদের নাম কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ও উল্লেখ করা হয়নি। পরবর্তীতে উক্ত ছয়জনের বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম যোগাযোগ করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র উপ-কমিশনার মো. রইছ উদ্দিনের সাথে৷ তিনি জানান, গত ২৬ নভেম্বর (মঙ্গলবার) রাতে পাহাড়তলী থেকে পুলিশ এই ছয় ব্যক্তিকে আটক করে। তারা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে মিছিল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল এবং তাদের কাছে ককটেলও পাওয়া গিয়েছে। তারা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সদস্য। তবে, এদেরকে ভিডিও ফুটেজ দেখে আটক করা হয়নি। সাইফুল হত্যার ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে ভিন্ন আরো সাতজনকে আটক করা হয়েছে।
চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবিতে মিছিল দেওয়ার চেষ্টা করায় আটককৃত এই ছয়জনের পরিচয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। আটক ব্যক্তিরা হলেন মো. আবু হেনা (৪২), মো. মোমিনুল ইসলাম (৩৪), মো. ইয়াছিন উল্লাহ (৪৪), মো. মামুনুর রশিদ (৪৮), শহীদ উদ্দিন খান (৪৮) ও আবদুর রহিম (৩২)।
তাছাড়া, আইনজীবী সাইফুল হত্যায় জড়িত সন্দেহে আটক সাতজনের পরিচয়ও গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। এ বিষয়ে বুধবার (২৭ নভেম্বর) “পুলিশের তিন মামলা, ফুটেজ দেখে হত্যায় জড়িত সাতজন শনাক্ত” শিরোনামে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সংঘর্ষের সময় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। এতে ৭৭ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১ হাজার ৩০০ জনকে আসামি করা হয়। আজ বুধবার বিকেলে পুলিশ বাদী হয়ে নগরের কোতোয়ালি থানায় মামলাগুলো করেন। পুলিশ জানায়, এসব মামলায় ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বেশির ভাগই নগরের কোতোয়ালি এলাকার বান্ডিল সেবক কলোনির বাসিন্দা। এর মধ্যে সাতজন আইনজীবী হত্যায় জড়িত। তাঁরা হলেন রুমিত দাশ, সুমিত দাশ, গগন দাশ, নয়ন দাশ, বিশাল দাশ, আমান দাশ ও মনু মেথর।” অর্থাৎ, পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী অভিযুক্তদের নাম দেখে প্রতীয়মান হয় যে হত্যায় সনাতনী ধর্মাবলম্বী একাধিক ব্যক্তি জড়িত আছেন।
এছাড়া, চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজনদের মধ্যে ৩ জনকে শনাক্ত করাসহ “চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যায় কারা জড়িত?” শীর্ষক শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, “আইনজীবী সাইফুলকে যে গলিতে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে সে সময় অন্যান্যদের মধ্যে এই ৩ জনকে দেখা যাচ্ছে— এমন একটি ছবি গতকাল (২৭ নভেম্বর) প্রকাশ করে টিবিএস। তাদের মধ্যে একজন হলেন, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শুভ কান্তি দাশ। আরেকজনের নাম জিয়া উদ্দিন ফাহিম। তিনি বাকলিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ ও স্থানীয়রা। এছাড়া, রাজীব ভট্টাচার্য ওরফে সুমন দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের এক নেতার অনুসারী এবং একটি শিপিং কোম্পানির কর্মচারী বলে জানা গেছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে কোতোয়ালী পুলিশ গ্রেপ্তারকৃত ৮ জনের মধ্যে তিনিও রয়েছেন। অন্য ৭ জন হলেন— রুমিত দাশ, সুমিত দাশ, গগন দাশ, নয়ন দাশ, বিশাল দাশ, আমান দাশ ও সনু মেতর।”
তার আগে গত ২৬ নভেম্বর এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট করে জানানো হয়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে জনগণকে শান্ত থাকার এবং অপ্রীতিকর কার্যকলাপে অংশ নেওয়া থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। পাশাপাশি, এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করেও সাইফুল হত্যায় কোনো সনাতনী জড়িত নয় শীর্ষক মন্তব্য ড. ইউনূসের করার সপক্ষে নির্ভরযোগ্য বা গণমাধ্যম সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, আইনজীবী সাইফুল হত্যায় কোন সনাতনী জড়িত নয় বলে জানিয়েছেন ড. ইউনূস শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
তথ্যসূত্র
- Chief Adviser GOB – Facebook Post
- Chief Adviser GOB – Facebook Post
- Prothom Alo – পুলিশের তিন মামলা, ফুটেজ দেখে হত্যায় জড়িত সাতজন শনাক্ত
- The Business Standard – চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যায় কারা জড়িত?
- Rumor Scanner’s own analysis