সম্প্রতি, “ওশ স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়ার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. গুপ্তপ্রসাদ রেড্ডি (বি ভি) বলেছেন, ক্যান্সার কোনো মরণব্যাধি নয়, কিন্তু মানুষ এই রোগে মারা যায় শুধুমাত্র উদাসীনতার কারণে। তার মতে, মাত্র দুটি উপায় অনুসরণ করলেই উধাও হবে ক্যান্সার।” শীর্ষক শিরোনামে একজন ব্যক্তির ছবি সম্বলিত একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভাইরাল কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
উক্ত পোস্টগুলোতে দুটি উপায় অনুসরণ এর কথা বলা হলেও সেখানে মোট তিনটি দাবির উল্লেখ ছিলো।
দাবিগুলো যথাক্রমেঃ
- প্রথমেই সব ধরনের সুগার বা চিনি খাওয়া ছেড়ে দিন। কেননা, শরীরে চিনি না পেলে ক্যান্সার সেলগুলো এমনিতেই বা প্রাকৃতিকভাবেই বিনাশ হয়ে যাবে।
- এরপর এক গ্লাস গরম জলে একটি লেবু চিপে মিশিয়ে নিন। টানা তিন মাস সকালে খাবারের আগে খালি পেটে এই লেবু মিশ্রিত গরম জল পান করুন। উধাও হয়ে যাবে ক্যান্সার। মেরিল্যান্ড কলেজ অব মেডিসিন- এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, কেমোথেরাপির চেয়ে এটি হাজার গুণ ভাল।
- প্রতিদিন সকালে ও রাতে তিন চা চামচ অর্গানিক নারিকেল তেল খান, ক্যান্সার সেরে যাবে। চিনি পরিহারের পর নিচের দুটি থেরাপির যেকোনো একটি গ্রহণ করুন। ক্যান্সার আপনাকে ঘায়েল করতে পারবে না। তবে অবহেলা বা উদাসীনতার কোনো অজুহাত নেই।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে ক্যান্সার নিরাময়ের এই পদ্ধতিগুলো নিয়ে ২০১৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাক, সময় টিভি, মানবজমিন, বাংলাদেশ প্রতিদিন সহ বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম তাদের অনলাইন সংস্করণে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায় চিনি-মুক্ত খাদ্য, লেবু মিশ্রিত গরম পানি এবং প্রতিদিন সকালে ও রাতে তিন চা চামচ অর্গানিক নারিকেল তেল খেয়ে ক্যান্সার নিরাময়ের দাবিটির বৈজ্ঞানিক কোনো প্রমাণ নেই এবং বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, কিভাবে ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি, বিস্তার ও মারা যায় এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সাথে পোস্টগুলোতে প্রচারিত দাবিগুলো অসঙ্গতিপূর্ণ।
শুরুতেই, ওশ স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং ডা. গুপ্তপ্রসাদ রেড্ডি (বি ভি) নামে ইন্টারনেটে সন্ধান করা হলে দেখা যায় ওশ স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি রাশিয়ায় নয় বরং কিরগিজস্তানে অবস্থিত এবং ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে ডা. গুপ্তপ্রসাদ রেড্ডি (বি ভি ) কারো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ইন্টারনেটেও এই নামে কোন ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও, আলোচিত পোস্টগুলোতে একজন ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করে হলেও, রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতিতে ছবির ব্যক্তিটির সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।পোস্টগুলোতে দাবি করা হয়, “ডা. গুপ্তপ্রসাদ গত পাঁচ বছর যাবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এই তথ্যটি প্রচার করছেন”। কিন্তু, ডা. গুপ্তপ্রসাদ এর নামে কোন সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়না।
চিনি-মুক্ত খাবার না খেলে ক্যান্সার সেল বিনাশ হয়ে যাবে?
কি-ওয়ার্ড সার্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে‘ এর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে “There’s no evidence that following a “sugar-free” diet lowers the risk of getting cancer, or boosts the chances of surviving if you are diagnosed.” অর্থাৎ কোন প্রমাণ নেই যে একটি “চিনি-মুক্ত” ডায়েট অনুসরণ করলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কম হয়।
ক্যান্সার কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়ার সিইও, অধ্যাপক সানচিয়া আরন্দা এবিসি নিউজকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “Stopping sugar getting to cancer cells would also mean that your body’s healthy cells get starved of necessary sugars. I think that would make you lose weight, [and]would make your immune system less efficient and more likely that a cancer would progress.” সুতরাং, চিনি সম্পূর্ণরূপে এড়ানো কখনও কখনও নেতিবাচকভাবেও প্রভাবিত করতে পারে।
এছাড়া, ২০১৬ সালে ‘আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর ক্যান্সার রিসার্চ’ এর প্রকাশিত অনুরূপ প্রতিবেদন পড়ুন এখানে।
সিঙ্গাপুর এবং অস্ট্রিয়ার কয়েকজন বিজ্ঞানীদের করা কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, উন্নত ক্যালসিয়ামের শর্তে চিনির অনাহারে শুধুমাত্র কিছু ক্যান্সার কোষ মারা যেতে পারে।
কিন্তু, এশিয়ান সায়েন্টিস্টের ২০১৮ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ‘ভবিষ্যতে একটি নতুন ক্যান্সারের চিকিৎসা বিকাশের জন্য তাদের গবেষণাকে আরও এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে’।
লেবু মিশ্রিত গরম পানি খেলে ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব?
এ বিষয়ে কি-ওয়ার্ড সার্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ রিসার্চ এর “Do Lemons Prevent Cancer?” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে “the claims that “lemons are a proven remedy against cancer of all types” and “lemons are 10,000 times stronger than chemotherapy” are certainly false.” অর্থাৎ লেবু সব ধরণের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে একটি প্রমাণিত প্রতিকার’ এবং ‘কেমোথেরাপির চেয়ে লেবু 10,000 গুণ বেশি শক্তিশালী’ এই দাবিগুলি মিথ্যা।
এছাড়াও, 2011 সালে Snopes-এর একটি ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদনে অনুসন্ধানের ফলাফলের ভিত্তিতে দাবিটিকে মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
‘ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে’ এর ২০১৩ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, “লেবুর রস ক্যান্সার নিরাময় করতে পারে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।”
এছাড়াও, University of Arkansas for Medical Sciences এর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী “The myth significantly exaggerates the potential of lemons and lemon juice as a cancer remedy। The beneficial compounds in lemon juice have shown promise in recent studies, but the levels found in foods may only enhance the body’s ability to fight off cancer. In the end, there is no proven scientific replacement for radiation therapy or chemotherapy.” অর্থাৎ লেবুর রসের উপকারী যৌগগুলি সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে, তবে খাবারে পাওয়া মাত্রাগুলো শুধুমাত্র ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করায় শরীরের ক্ষমতা বাড়াতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত, রেডিয়েশন থেরাপি বা কেমোথেরাপির জন্য কোন প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক প্রতিস্থাপন নেই।
প্রতিদিন সকালে ও রাতে তিন চা চামচ অর্গানিক নারিকেল তেল খেলে ক্যান্সার ভালো হয়ে যাবে?
কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধান করে এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো সঠিক গবেষণা পাওয়া যায়নি। তবে কিছু স্টাডিজে দেখা যায় যে যে, কুমারী নারকেল তেল কেমোথেরাপি এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কমাতে পারে এবং নারকেল তেলের একটি উপাদান লাউরিক এসিড যা কোলন ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি দমন করতে পারে। কিন্তু নারকেল তেল ক্যান্সার নিরাময় করে এমন কোনো প্রমাণ নেই।
এ বিষয়ে আমেরিকান সোসাইটি ফর নিউট্রিশন সতর্ক করেছে যে নারকেল তেল কোনো জাদুকরী নিরাময়-সমস্ত বৈশিষ্ট্যসহ অলৌকিক খাবার নয়।
সুতরাং, ডা. গুপ্তপ্রসাদের বরাতে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত চিনি-মুক্ত খাদ্য, গরম লেবু পানি এবং নারকেল তেল খেয়ে ক্যান্সার নিরাময়ের দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই, এটি একটি গুজব।
[su_box title=”True or False” box_color=”#f30404″ radius=”0″]
- Claim Review: #ক্যান্সার_সচেতনতাঃ ওশ স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়ার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. গুপ্তপ্রসাদ রেড্ডি (বি ভি) বলেছেন, ক্যান্সার কোনো মরণব্যাধি নয়, কিন্তু মানুষ এই রোগে মারা যায় শুধুমাত্র উদাসীনতার কারণে।
- Claimed By: Facebook Posts
- Fact Check: False
[/su_box]
তথ্যসূত্র
- Cancer Research UK: https://scienceblog.cancerresearchuk.org/2017/05/15/sugar-and-cancer-what-you-need-to-know/
- ABC Australia: https://www.abc.net.au/news/health/2017-07-26/cancer-and-sugar-what-you-need-to-know/8701870
- American Institute for Cancer Research: https://www.aicr.org/news/the-sugar-cancer-connection/
- Science.org: https://www.science.org/doi/10.1126/scisignal.aam7893
- Asian Scientist: https://www.asianscientist.com/2018/02/in-the-lab/glucose-cancer-cells-dependency
- National Center for Health Research: http://www.center4research.org/lemons-prevent-cancer/
- Snopes: https://www.snopes.com/fact-check/lemon-cancer-cure/
- Cancer Research UK: https://news.cancerresearchuk.org/2013/09/13/miracle-cancer-cures-ask-for-evidence/
- University of Arkansas for Medical Sciences: https://uamshealth.com/medical-myths/do-lemons-and-lemon-juice-cure-cancer/
- US National Library of Medicine / National Institutes of Health: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4176590/
- American Society for Nutrition: https://nutrition.org/coconut-oil-medical-miracle-marketing-miracle/