সমবায় ভবনের সামনে উত্তোলিত ৭ রং সম্বলিত পতাকাটি এলজিবিটিকিউ নির্দেশক পতাকা নয়

সম্প্রতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমবায় ভবনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সাথে বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল রং সম্বলিত একটি পতাকার ছবি প্রচার করে।

দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশ সমবায় অধিদপ্তর প্রকাশ্যে সমকামিতা বা পুরো এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির প্রতীক সম্বলিত পতাকা উত্তোলন করেছে।

৭ রং

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত  এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

উক্ত দাবিতে ইন্সটাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সমবায় ভবনের সামনে বাংলাদেশের পতাকার সাথে উত্তোলন করা পতাকাটি এলজিবিটিকিউ নির্দেশক পতাকা নয়। সমবায় ও এলজিবিটিকিউ নির্দেশক  পতাকা দেখতে অনেকটা একই রকমের হলেও এই দুইটি পতাকার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।  সমবায়ের পতাকায় বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল এই ৭ টি রং রয়েছে।  অপরদিকে এলজিবিটিকিউ নির্দেশক পতাকায় রঙের সংখ্যা ৬ টি। এই ৬ টি রং সমবায় পতাকায় থাকলেও এই পতাকায়  সমবায়ের পতাকার আসমানী বা আকাশী রঙ অনুপস্থিত।

আলোচিত দাবির সত্যতা যাচাইয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে এলজিবিটিকিউ নির্দেশক পতাকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭৮ সালে সান ফ্রান্সিসকোর চিত্রশিল্পী গিলবার্ট বেকার রামধনু পতাকা তথা এলজিবিটিকিউ এর সমর্থক বা প্রাইড পতাকার নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। তখন পতাকার রঙ ছিলো গোলাপী, লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, ফিরোজা, নীল এবং বেগুনী। তবে বুনন কাপড়ের সহজলভ্যতার ভিত্তিতে পরবর্তীতে পতাকার রঙ এ পরিবর্তন আনা হয়। সেই অনুসারেই এই পতাকা থেকে প্রথমে গোলাপী রঙ (১৯৭৮-১৯৭৯) বাদ দিয়ে সাত ডোরার পতাকা বানানো হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে আবারও ফিরোজা ও নীল রং এর মধ্যে শুধু নীল রঙকে পতাকায় রাখা হয়। এই নকশা অনুসারে, রামধনু পতাকার সবচেয়ে বেশি পরিচিত নকশাটিতে লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল ও বেগুনি রঙের ছ’টি ডোরা-কাটা দাগ আছে। পতাকাটিকে সাধারণত আনুভূমিক অবস্থায় ওড়ানো হয়। লাল দাগটি উপরে থাকে, যাতে এটিকে প্রাকৃতিক রামধনুর মতো দেখায়।

সমবায় পতাকার ইতিহাস বিষয়ে অনুসন্ধানে (,) জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ অ্যালায়েন্স (ICA) কর্তৃপক্ষ ১৯২২ সালে জার্মানির এসেন-এ, আন্তর্জাতিক কো-অপারেটিভ চিহ্ন এবং পতাকার ডিজাইন করে। ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে প্রথম “কো-অপারেটরস ডে” অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন ডিজাইন নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিখ্যাত ফরাসি কো-অপারেটর, প্রফেসর চার্লস গাইড এর পরামর্শ মোতাবেক পতাকার জন্য রংধনুর সাতটি রং ব্যবহার করা হয়। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে রংধনু বৈচিত্র্যতার মাঝে ঐক্য, আলো এবং অগ্রগতির শক্তির প্রতীক। প্রথম কো-অপারেটিভ রেইনবো পতাকাটি ১৯২৪ সালে সম্পন্ন হয়েছিল এবং ১৯২৫ সালে আন্তর্জাতিক সমবায় আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক প্রতীক হিসাবে গৃহীত হয়েছিল।

Screenshot: website

প্রফেসর গাইড সমবায়ের জন্য এ’ সাতরঙ্গা পতাকা সুপারিশ করেন, কারণ এ’ পৃথিবীতে যত প্রকার রং আছে, সেগুলোর মধ্যে বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল- ৭টি রং প্রধান। এরা পৃথকভাবে নিজ বৈশিষ্টের অধিকারী এবং স্বতন্ত্র। কিন্তু সেগুলো একত্রিত করলে তাদের নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয়তা থাকেনা। এই সাতটি রং একত্রিত হয়ে সবমিলে সাদা রঙ্গে পরিণত হয়। আর সাদার অর্থ শান্তি। প্রকৃতপক্ষে সাতরঙ্গের পতাকা বৈচিত্রের মধ্যে একতার প্রতীক। অর্থাৎ সমবায় পতাকাতলে ধনী-গরিব সমান। চার্লস গাইডের উপহার সমবায় পতাকার মধ্যেও গণতন্ত্রের শিক্ষা রয়েছে।

Image Comparison: Rumor Scanner

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রতিটি সমবায় ভবনের সামনেই বাংলাদেশের পতাকার সাথে সাতরঙা সমবায় পতাকা র‍য়েছে। ১৯২৫ সালে আন্তর্জাতিক কো-অপারেটিভ অ্যালায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল পতাকা, তার অগ্রগতি এবং শান্তির পতাকা হিসাবে রংধনু অনুভূমিক স্ট্রিপ সুন্দর সাতটি রঙের প্যাটার্ন গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশও ICA এর মেম্বার হওয়ার সুবাদে সেই রীতি অনুসরণ করে আসছে।

মূলত, সমবায় ভবনের সামনে বাংলাদেশের পতাকার সাথে উত্তোলন করা বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল রং সম্বলিত পতাকাকে সমকামিতা বা পুরো এলজিবিটিকিউ নির্দেশক প্রতীক বলে প্রচার করা হচ্ছে। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি সমকামিতা বা পুরো এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি নির্দেশক পতাকা নয়। সমবায় পতাকা দেখতে এলজিবিটিকিউ নির্দেশক পতাকার মতো মনে হলেও দুইটি পতাকার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এলজিবিটিকিউ নির্দেশক পতাকায় ৬ টি রংয়ের সমন্বয়ের তৈরি। অন্যদিকে সমবায় পতাকা ৭ টি রংয়ের সমন্বয়ে তৈরি। সমবায় পতাকায় থাকা আসমানী বা আকাশী রঙ এলজিবিটিকিউ নির্দেশক পতাকায় অনুপস্থিত। এছাড়া এলজিবিটিকিউ নির্দেশক পতাকার উৎপত্তি ১৯৭৮ সালে হলেও এর অনেক আগেই ১৯২৫ সালে সমবায় পতাকা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়।

সুতরাং, সমবায় ভবনের সামনে বাংলাদেশের পতাকার সাথে সমকামিতা বা পুরো এলজিবিটিকিউ কমিউনিটি নির্দেশক পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে মর্মে প্রচারিত দাবিটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img