গত ০৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের টর্চার সেল কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী। মুক্তি পরবর্তী গত ০৩ সেপ্টেম্বর বন্দী জীবনের অভিজ্ঞতা ও তার নানা ইচ্ছার কথা তুলে ধরেন। এসময় বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি’ উল্লেখ করে তা পরিবর্তনের দাবি জানান তিনি। এরই প্রেক্ষিতে, বিশিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করার জন্য ইংরেজদের নিকট ১৭বার স্বারক লিপি দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর” শীর্ষক মন্তব্য করেছেন দাবিতে সম্প্রতি একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত হচ্ছে।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জড়িয়ে অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান এমন কোনো মন্তব্য করেননি, বরং কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই উক্ত মন্তব্য সলিমুল্লাহ খানের মন্তব্য দাবিতে প্রচারিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত দাবিটির সূত্রপাত খুঁজে বের করার চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার টিম। ফেসবুক মনিটরিং টুল ব্যবহার করে গত ৫ সেপ্টেম্বর রাত ৮ টা ৪৪ মিনিটে “MH Sujon Mahmud” নামক একটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারিত সম্ভাব্য প্রথম পোস্টটি (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়। তবে উক্ত পোস্টে এই তথ্যের বিষয়ে কোন তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি।
সলিমুল্লাহ খান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বিরোধিতা করেছেন কিনা এমন তথ্যের অনুসন্ধানে MSI KHAN নামক ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ২০২২ সালের ১২ নভেম্বর প্রকাশিত ড. সলিমুল্লাহ খানের একটি ভিডিও (আর্কাইভ) বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওটির ২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে ড. সলিমুল্লাহ খান সৈয়দ মোকশেদ’র একটি বইয়ের তথ্যসূত্র দিয়ে বলেন, “সবাই যে আলোচনা করেন যে রবীন্দ্রনাথ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, ১৯২৬ এ এসেছিলেন, রমেশচন্দ্রের বাসায় ছিলেন, বুড়িগঙ্গার নৌকায় ছিলেন, সবই সত্য কথা, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সবই ঠিক আছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ কোন বিরোধিতা করেননি। কিন্তু তার উৎসাহ একটু কম ছিল।”
এ বিষয়ে অধিকতর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য রিউমর স্ক্যানারের পক্ষ থেকে ড. সলিমুল্লাহ খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “একেবারেই ভুয়া এই প্রচারণা। আমি এমন কোন কথা বলিনি। আমি যা বলেছিলাম তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন উল্লেখ নেই। এ কথা সত্য যে কলকাতার এবং ঢাকার প্রসিদ্ধ বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বহুদিন যাবত এই অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন।
আমার কথার অন্যতম উৎস পরলোকগত ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বই “জীবনের স্মৃতিদীপে” (১৯৭৮ সালে কলিকাতায় জেনারেল প্রিন্টার্স কর্তৃক প্রকাশিত)। রমেশচন্দ্র মজুমদার মহোদয় জানিয়েছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং তৎকালীন আরো অনেক হিন্দু নেতা ঢাকায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। এইরকম একজন বড় বিরোধিতাকারীর নাম সেকালের প্রখ্যাত আইনজীবী রাসবিহারী ঘোষ। ঢাকার আইনজীবী ও জননেতা আনন্দচন্দ্র রায় এই বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিতেন। মজার বিষয় এই বিরোধিতা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জারি ছিল।
তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে লিখেছিলেন এমন কোন অভিযোগ অন্তত রমেশচন্দ্র মজুমদারের বইতে পাওয়া যায় না। তিনি ১৯২৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে পরিদর্শন সফরে গিয়েছিলেন।”
এছাড়া, আলোচিত দাবির প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড অনুসন্ধান করে গণমাধ্যম ও বিশ্বস্ত সূত্রে এসংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করার জন্য ইংরেজদের নিকট ১৭বার স্বারক লিপি দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর” শীর্ষক মন্তব্য করেছেন দাবিতে ইন্টারনেটে একটি তথ্য প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- MSI KHAN – Facebook Post
- Statement from Salimullah Khan