সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একাধিক উপদেষ্টা,প্রেস সচিব এবং জুলাই-আগস্ট এর আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেতাদের নামে থাকা বাইনান্স (Binance) নামক আন্তর্জাতিক ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন প্ল্যাটফর্মের কিছু অ্যাকাউন্টের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ভাইরাল স্ক্রিনশটের বরাতে দাবি করা হচ্ছে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে থাকা অ্যাকাউন্টগুলোতে বিপুল পরিমাণ বিটকয়েন জমা রয়েছে, যার বাজারমূল্য শত শত কোটি টাকা।
স্ক্রিনশটের তথ্যমতে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের নামে থাকা অ্যাকাউন্টে ৯৩.০৬ বিটকয়েন রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার (১০০ কোটি টাকা)। একইভাবে, সদ্য পদত্যাগ করা উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের নামে থাকা অ্যাকাউন্টে ২০৪.৬৪ বিটকয়েন থাকার দাবি করা হয়েছে, যার মূল্য ১৯ মিলিয়ন ডলার (২২০ কোটি টাকা)। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সাজিব ভূঁইয়ার নামে থাকা অ্যাকাউন্টে ১১৩ বিটকয়েন রয়েছে, যা আনুমানিক ১২ মিলিয়ন ডলার (১৩০ কোটি টাকা) সমমূল্যের। তালিকায় আরও রয়েছে সরজিস আলমের নামে থাকা একটি অ্যাকাউন্ট, যেখানে ৭৭.৬৯ বিটকয়েন থাকার কথা বলা হচ্ছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭.৭৬ মিলিয়ন ডলার (৯০ কোটি টাকা)। অন্যদিকে, খান তালাত মাহমুদ রাফির নামে থাকা অ্যাকাউন্টে ১১.০৯ বিটকয়েন থাকার দাবিও উঠে এসেছে, যার আনুমানিক মূল্য ১.১ মিলিয়ন ডলার (১৩ কোটি টাকা)।

এই দাবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এই দাবিতে একটি পোস্ট করেছেন। এছাড়া, ভারতের একাধিক গণমাধ্যমেও এই দাবির ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে।
এই দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন: আজতক বাংলা, রিপাবলিক বাংলা, কলকাতা টিভি।
একই দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা, প্রেস সচিব ও জুলাই-আগস্ট এর আন্দোলনের নেতাদের নামে ছড়িয়ে পড়া বাইনান্স অ্যাকাউন্টের স্ক্রিনশটগুলো ভুয়া। প্রযুক্তির কারসাজিতে এসব স্ক্রিনশট তৈরি করা হয়েছে এবং একটি অনির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে প্রচারিত হচ্ছে।
ভাইরাল এই দাবির সূত্র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এটি ‘দ্য এশিয়াপোস্ট নিউজ’ নামের একটি কথিত অনলাইন পোর্টালের বরাতে প্রচারিত হচ্ছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পোর্টালটিতে “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ: ঘুষ ও অবৈধ অর্থ বিটকয়েনে সংরক্ষিত” (ইংরেজি থেকে অনূদিত) শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উক্ত দাবি করা হয়।
উক্ত পোর্টালটি নিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এটি প্রথমবারের মতো প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০২৪ সালের ২০ নভেম্বর। এর নামের সঙ্গে ‘এশিয়া’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও পোর্টালটি বাংলাদেশ ছাড়া এশিয়ার অন্য কোনো দেশ নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি। এছাড়া, এর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কার্যক্রমও অত্যন্ত সীমিত। ফেসবুক পেজে মাত্র ৩৩ জন ফলোয়ার, আর এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে রয়েছে মাত্র ৮ জন ফলোয়ার। ওয়েবসাইটটিও একটি ওয়ার্ডপ্রেস ব্লগের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে কোনো সম্পাদক, প্রকাশক বা পরিচালকের নাম-পরিচয় নেই, এমনকি অফিসের ঠিকানাও উল্লেখ করা হয়নি।
ডোমেইন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এটি বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে, ২০২৪ সালের ২৫ অক্টোবর নিবন্ধিত হয়েছে।
‘দ্য এশিয়াপোস্ট নিউজ’ অনির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হওয়ার পর প্রতিবেদনের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া বাইনান্স অ্যাকাউন্টের স্ক্রিনশটগুলোও যাচাই করেছে রিউমর স্ক্যানার। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এগুলো সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে লগইন করা অবস্থায় তোলা হয়েছে। স্ক্রিনশটগুলোতে ‘ডিপোজিট’ ও ‘লগ-আউট’ অপশন দেখা যাচ্ছে, যা সাধারণত শুধু লগইন করার পরই দৃশ্যমান হয়। এছাড়া বাইনান্সের নিয়ম অনুযায়ী, কেবল ব্যবহারকারীর আইডি দিয়ে কারও অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স দেখা সম্ভব নয়। ব্যালেন্স দেখতে হলে অ্যাকাউন্টে লগইন করে “ওয়ালেট” অপশনে গিয়ে “ওভারভিউ” দেখতে হয়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রযুক্তি বিশ্লেষক রিউমর স্ক্যানারকে জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বাইনান্স স্ক্রিনশটগুলো সম্পূর্ণ ভুয়া। তার ভাষায়, “যারা বাইনান্স, ক্রিপ্টো বা প্রযুক্তি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখে, তারা দেখলেই বুঝতে পারবে—এটি বানানো। কারণ, শুধু ইউজার আইডি ব্যবহার করে কারও অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স জানা সম্ভব নয়।”
এই স্ক্রিনশট তৈরির পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “এই স্ক্রিনশটগুলো আসলে ব্রাউজারের ‘ইন্সপেক্ট টুল’ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। এটি এমন একটি টুল, যার মাধ্যমে ওয়েবসাইটের কোড সাময়িকভাবে বদলে ফেলা যায়। ফলে, যেকোনো ওয়েবসাইটের ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট সম্পাদনা করে ইচ্ছেমতো ভুয়া তথ্য দেখানো সম্ভব, যা স্ক্রিনশটে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও বাস্তবে সঠিক তথ্য নয়।”
ভুয়া স্ক্রিনশট তৈরির কৌশল বোঝাতে গিয়ে ওই বিশ্লেষক রিউমর স্ক্যানারের টিমকে একটি নমুনা তৈরি করে দেখান। তিনি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের নামে ছড়ানো স্ক্রিনশটের মতোই আরেকটি স্ক্রিনশট তৈরি করেন। এতে অ্যাকাউন্টের সব তথ্য অপরিবর্তিত রেখে শুধু নাম বদলে সজীব ওয়াজেদের নাম বসানো হয়।

এছাড়া, সজীব ওয়াজেদের ফেসবুক পেজে পোস্টটি প্রকাশের পর থেকেই রিউমর স্ক্যানার টিম এটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। পোস্টের পরপরই মন্তব্য ঘরে অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারী স্ক্রিনশটগুলোকে ভুয়া বলে দাবি করেন। বিভিন্ন প্রযুক্তি বিশ্লেষকও স্ক্রিনশটগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর প্রেক্ষিতে মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে জনাব সজীব ওয়াজেদ পোস্টটি মুছে ফেলেন।
সুতরাং, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা, প্রেস সচিব এবং জুলাই-আগস্ট এর আন্দোলনের নেতাদের নামে বাইনান্স অ্যাকাউন্টের স্ক্রিনশট সংক্রান্ত প্রচারিত দাবিটি সম্পূর্ণ ভুয়া ও ভিত্তিহীন।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s analysis.
- Statement from Tech Expert.
- Binance: How to Check My Binance Wallet Balances and Transfer Funds on Wallet Overview