সম্প্রতি, লাইভ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে মাগুরা- ১ আসনের সংসদ সদস্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হবিগঞ্জ- ৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন মুখোমুখি হয়েছেন এবং এসময় ব্যারিস্টার সুমন কেঁদেছেন দাবিতে ‘মুখোমুখি দুই শত্রু সাকিব-ব্যারিস্টার সুমন সাকিবের কড়া হুশিয়ারি ভয় পেলেন ব্যারিস্টার’ শীর্ষক থাম্বনেইলে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।
ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
টিকটকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, লাইভ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাকিব আল হাসান ও ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের অংশগ্রহণ করার দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় প্রকাশিত তিনজনের পৃথক তিনটি ভিডিওকে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় যুক্ত করে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যালোচনা করে রিউমর স্ক্যানার টিম। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি এজন্যে সত্যি খুব দুঃখ পাচ্ছি।…আক্রমণ এটার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই এবং আমরা এটা বলবো যে এইসব কাজ থেকে ওদের বিরত থাকা উচিত।’
পাশাপাশি সাকিব আল হাসানকে ‘একটু হাতাহাতিও হয়… আসলে পুরা ঘটনাটা ছিল এরকম… অবশ্যই আমি এজন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত, ক্ষমাপ্রার্থী এবং আমি মনে করি আপনারা এটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেটিও চেষ্টা করবো। এমন কিছু যেন আমরা না করি যাতে মানুষ আমাদেরকে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ফেলে দেয় যে আমরা আসলে এক নাকি আলাদা। কারণ আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত এক থাকবো ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা শক্তিশালী।’ শীর্ষক মন্তব্য করতে শোনা যায়।
এছাড়াও ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনকে ‘যেসব জায়গায় আমার সমালোচনা করার, যেসব জায়গায় আমার প্রতিবাদ করার ওইসব জায়গায় তো আমি বন্ধ হই নাই। আমি কখনো আটকে থাকি নাই। আমি চেষ্টা করছি। যতটুকু পারছি আমি চেষ্টা করছি। সাকি ভাইয়ের ব্যাপারে আমার একটা উন্নত ধারণা। আমি কিচ্ছু বলতে চাইনা। শুধু সাকি ভাইকে বলতে চাই চলেন বাড়ি ফিরে যাই। বাড়ি গিয়ে কাজ করি।’ শীর্ষক কথা বলতে শোনা যায়।
ভিডিওটি পর্যালোচনার মাধ্যমে তিনজনের বক্তব্যের মধ্যেই অসামঞ্জ্যতা লক্ষ্য করা যায়। যা থেকে এটি ধারণা করা যায় যে ভিডিওগুলো কাট করে করে বক্তব্যগুলো তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের বক্তব্য লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তিনি ‘সাকি ভাই’ বলে কয়েকবার সম্বোধন করেছেন। এ থেকেও এটি পরিষ্কার হওয়া যায় যে, ভিডিওটি ভিন্ন একটি ঘটনার।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে সাকিব আল হাসানের ক্লিপটির কিছু কী-ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে Shakib Al Hasan নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর প্রচারিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত ভিডিওটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর সাকিব আল হাসানের অংশের বেশকিছু অংশের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
এছাড়াও ভিডিওটি থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে বেনাপোল বন্দর ইমিগ্রেশনে একজন ভক্ত সাকিব আল হাসানের সাথে সেলফি তুলতে আসলে সাকিব তার ফোনটি ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার আলোচিত ঘটনাকে ভিত্তি করে তিনি(সাকিব) সেসময় উক্ত ভিডিও বার্তাটা প্রচার করেন। যেখানে তিনি তার ভক্তদের কাছে উক্ত ঘটনার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যার সাথে আলোচিত দাবিটির কোনো সম্পর্ক নেই।
পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুটেজটি অনুসন্ধানে কিছু কী-ফ্রেম রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে মাছরাঙা টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেল Maasranga News এ ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর সাম্প্রতিক বেলজিয়াম সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনপ্রধানমন্ত্রীর শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি লাইভ ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওটি পর্যালোচনা করে আলোচিত ভিডিওতে দেখানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুটেজের সাথে হুবহু মিল পাওয়া যায়। উভয় ভিডিওতেই তার পড়নের শাড়ি এবং গহণা একই। এছাড়াও ব্যাকগ্রাউন্ডের মিল রয়েছে। তাছাড়া ভিডিওটির ভিন্ন অংশে তার দেওয়া বক্তব্যের সাথেও আলোচিত ভিডিওর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
পাশাপাশি এটিও জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেলজিয়াম সফর শেষ করে দেশে ফিরে গতবছরের ৩১ অক্টোবর গণভবনে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। উক্ত ভিডিওটি সেসময়ই মাছরাঙা টেলিভিশনে ইউটিউব চ্যানেলে লাইভ প্রচার করা হয়।
সর্বশেষ ব্যারিস্টার সুমনের ভিডিওটি অনুসন্ধানে আলোচিত ভিডিওর সুমনের অংশের ফুটেজ থেকে কিছু কী-ফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ‘DW খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ নামের ইউটিউব চ্যানেলে গত ১২ জানুয়ারি কে সরকারি কে বিরোধী? শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি সরাসরি সম্প্রচারকৃত ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত ভিডিওটির সাথে আলোচিত ভিডিওতে থাকা ব্যারিস্টার সুমনের ফুটেজের কিছু অংশের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
উক্ত ভিডিও থেকে আরও জানা যায়, জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম DW এর বাংলা বিভাগের প্রধান সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের জনপ্রিয় টক শো ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ এ সম্প্রতি গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। উক্ত প্রোগ্রামে খালেদ মুহিউদ্দীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা সময়ে চলা আন্দোলন ও সংসদের বিরোধীদল নিয়ে অতিথিদের সাথে নানা আলোচনা করেন। যার সাথে আলোচিত দাবির কোনো সম্পর্ক নেই।
মূলত, ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান ২০২৩ সালে ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে দেখে মারতে উদ্ধত হন বলে অভিযোগ তুলে সেসময় নিজের ফেসবুক পেজে একটি লাইভ ভিডিও প্রচার করেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। ভিডিওটিতে তিনি জানান, ভারত-বাংলাদেশ সিরিজ চলাকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে উক্ত ঘটনাটি ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে উভয় ব্যক্তি-ই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের পূর্বের দ্বন্দ্বের বিষয়টি পুনরায় ইন্টারনেটে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে একই লাইভ অনুষ্ঠান তারা দুজন মুখোমুখি হয়েছেন দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, তারা তিনজন একত্রে কোনো লাইভ অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। প্রকৃতপক্ষে, ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় প্রকাশিত তাদের পৃথক কয়েকটি ভিডিওর ফুটেজ ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় যুক্ত করে আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে।
সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে লাইভ অনুষ্ঠানে সাকিব আল হাসান ও সায়েদুল হক সুমনের মুখোমুখি হওয়ার দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত ভিডিওটি এডিটেড বা সম্পাদিত।
তথ্যসূত্র
- Shakib Al Hasan Youtube Channel: November 16, 2020
- Maasranga News Youtube Channel: সাম্প্রতিক বেলজিয়াম সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রীর
- DW খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায় Youtube Channel: কে সরকারি কে বিরোধী?
- Rumor Scanner’s Own Analysis