সম্প্রতি, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন ২০০৬ সাল থেকে চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত থাকা অধ্যাপক ড. অনুপম সেন। ড. অনুপম সেনের পদত্যাগের বিষয়টিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ঘটনা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে, ইসকন সমর্থক ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় কট্টরপন্থী ইসলামিস্ট গ্রুপ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন।
ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা, টিভি৯ বাংলা, জি২৪ ঘণ্টা (ইউটিউব) এবং রিপাবলিক বাংলা (ইউটিউব)।
একই দাবিতে ভারতীয় কিছু ফেসবুক আইডিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এক্স (সাবেক টুইটার)-এ প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, হিন্দু হওয়ায় চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেনকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হওয়া এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ তুলে অনুপম সেন এবং আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের হুমকি দেয়ার অভিযোগ তুলে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেন। আন্দোলনের মুখে অনুপম সেনসহ মোট ৫ জন পদত্যাগ করেন, যাদের মধ্যে অনুপম সেন ব্যতীত বাকি ৪ জনই মুসলিম।
আলোচিত দাবির বিষয়ে অনুসন্ধানে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে Private University Students Alliance of Bangladesh – PUSAB নামের একটি পেজে গত ৩ নভেম্বর করা একটি পোস্টের সন্ধান পাওয়া যায়।
পোস্টটিতে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং ট্রেজারের পদত্যাগের ১ দফা দাবিতে হওয়া আন্দোলনের একটি ব্যানার দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও পোস্টটির ক্যাপশনে বলা হয়, জুলাই গনঅভ্যুত্থানে ছাত্রহত্যার পক্ষে বিবৃতি দেওয়া ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হওয়ায় তাদের পদত্যাগের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিইসি ক্যাম্পাস প্রাঙ্গনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ৪ ডিসেম্বর আন্দোলনের ডাক দেয় সাধারন শিক্ষার্থীরা। যেখানে চট্টগ্রামের অন্যান্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্র-জনতাকে অংশগ্রহণের আহ্বানও জানানো হয়।
পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে গত ৪ ডিসেম্বর উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ক্যাম্পাস ‘শাটডাউন’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ০৪ ডিসেম্বর ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি’ -এর ব্যানারে নগরের জিইসি মোড় ক্যাম্পাসে উপাচার্য অনুপম সেন, সহ-উপাচার্য কাজী শামীম সুলতানা ও কোষাধ্যক্ষ তৌফিক সাঈদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। এসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির তিনটি ক্যাম্পাসের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন তারা। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রাসেল আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
প্রান্ত বড়ুয়া নামের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। তিনি জুলাই বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন। সহ-উপাচার্য আর কোষাধ্যক্ষর বিরুদ্ধেও ছাত্র-ছাত্রীদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলনে যাওয়ায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ দিয়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হয়েছিল। তাঁরা স্বৈরচারের কোনো দোসরকে এসব পদে থাকতে দেবেন না। যতক্ষণ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় স্বৈরচারমুক্ত না হচ্ছে, ততক্ষণ তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এছাড়াও কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উপাচার্য ড. অনুপম সেনসহ উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. কাজী শামীম সুলতানা, ট্রেজারার অধ্যাপক ড. তৌফিক সাঈদ, ছাত্রকল্যাণ ও এইচআর পরিচালক খুরশিদুর রহমান ও প্রক্টর আহমদ রাজিব পদত্যাগ করেন।
প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে উপাচার্য অনুপম সেন এর গণমাধ্যমে পাঠানো একটি বিবৃতি পাওয়া যায়। বিবৃতিতে তিনি বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করলেও তার বিরুদ্ধে ধর্মের কারণে আন্দোলন করা হচ্ছে এমন কোন বিষয় উল্লেখ করেননি।
আন্দোলনকারীদের দাবি কিংবা উপাচার্যের বিবৃতিতে কোথাও হিন্দু হওয়ায় পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করা হয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়াও হিন্দু হওয়ায় তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে এমন কোনো দাবি তিনি নিজেও করেননি। অপরদিকে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে উপাচার্য অনুপম সেন, সহ-উপাচার্য কাজী শামীম সুলতানা ও কোষাধ্যক্ষ তৌফিক সাঈদের পদত্যাগের দাবি করেছিলেন, এবং তাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাঁচজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন, যাদের মধ্যে ৪ জন মুসলিম।
অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ধর্মীয় কারণে কিংবা সাম্প্রদায়িক কারণে ছিল না বরং কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা ধর্ম নির্বিশেষে কয়েকজনের পদত্যাগ দাবি করে আন্দোলন করে। যে আন্দোলনের মুখে ভিসিসহ পাঁচ জন শীর্ষ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য, ০৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে দেশের অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। যার মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম ধর্মাবলম্বী।
সুতরাং, হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Private University Students Alliance of Bangladesh – PUSAB Facebook Page Post
- Prothom Alo Website: উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ক্যাম্পাস ‘শাটডাউন’
- Banglanews24 Website: আ.লীগের উপদেষ্টা পরিষদে জায়গা পেলেন যে ৪৬ জন
- Prothom Alo Website: শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে উপাচার্যসহ তিন শিক্ষকের পদত্যাগ
- RTV Website: ঢাবিসহ ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ
- Rumor Scanner’s Analysis