জাতীয় পার্টির নির্বাচন বর্জন এবং হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচন বাতিল দাবিতে ভুয়া তথ্য প্রচার

সম্প্রতি, “এইমাত্র নির্বাচন বর্জন করলো জাতীয় পার্টি হাইকোর্ট থেকে নির্বাচন বাতিল ঘোষণা” শীর্ষক শিরোনাম এবং “নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াল জাতীয় পার্টি হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে নির্বাচন বাতিল ঘোষণা” শীর্ষক তথ্য সম্বলিত থাম্বনেইলে ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম ইউটিউবে একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে।

জাতীয় পার্টির

ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিওটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া অবধি ভিডিওটি প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বার দেখা হয়েছে। এছাড়া ভিডিওটিতে প্রায় ৩ হাজার ৬ শত পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতীয় পার্টি (জাপা) নির্বাচন  বর্জন করেনি এবং হাইকোর্টও নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেনি  বরং অধিক ভিউ পাবার আশায় চটকদার শিরোনাম ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় ৮ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের এই ভিডিওটি ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি ঘটনার ভিডিও ক্লিপ এবং ছবি নিয়ে তৈরি একটি ভিডিও প্রতিবেদন। 

আলোচিত ভিডিওটির শুরুতেই কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা এবং সংবাদ প্রতিবেদনের খণ্ডাংশ দেখানো হয়। পরবর্তীতে আলোচিত দাবিটি প্রসঙ্গে কয়েকটি ভিডিও দেখানো হয় এবং দাবিটি প্রসঙ্গে চ্যানেলটির উপস্থাপক বলেন, “দর্শক নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালো জাতীয় পার্টি,জাকের পার্টি সহ সব দল। এখন নির্বাচন কমিশনার কি করবে। এই নির্বাচন কি করতে পারবে?মোটেও না। চলুন আমরা ভিডিওতে দেখি যে, জাতীয় পার্টি সহ সমস্ত দলগুলো এই মুহূর্তে নির্বাচন প্রত্যাহার করার হিড়িক পড়েছে। চলুন আমরা ভিডিওতে দেখি…।”

ভিডিও যাচাই 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচিত ভিডিওতে যুক্ত প্রথম দুইটি ভিডিও ক্লিপই গত ১৭ ডিসেম্বর জাকের পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাহারের ঘটনায় বায়ান্ন টেলিভিশন এবং চ্যানেল ২৪ (,) এ প্রকাশিত ভিডিও প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।

Video Comparison : Rumor Scanner 
Video Comparison : Rumor Scanner 

আলোচিত ভিডিওটির পরবর্তী অংশে থাকা ভিডিওটির অনুসন্ধানে Voice Bangla নামক ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৬ ডিসেম্বর “প্রত্যাশিত ৪০ থেকে ২৬ টি আসন পেয়ে মুখ ভার জাতীয় পার্টির!। Mostofa Feroz । Voice Bangla” শীর্ষক শিরোনামে একটি ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

Video Comparison : Rumor Scanner 

উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত ভিডিওর হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

উক্ত ভিডিওটিতে ভয়েস বাংলার প্রতিষ্ঠান মোস্তফা ফিরোজ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসন বিন্যাস নিয়ে নিজস্ব মতামত ব্যাক্ত করেন। 

আলোচিত দাবিটির সর্বশেষ ভিডিওটির অনুসন্ধানে কালবেলার ইউটিউব চ্যানেলে গত ১৭ ডিসেম্বর “হঠাৎ জাতীয় পার্টির অফিসে পুলিশ মোতায়েন।Jatiya Part। BD Police। Kalbela” শীর্ষক শিরোনামে একই ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

Video Comparison : Rumor Scanner 

ভিডিও প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতীয় পার্টির কিছু নেতাকর্মীরা বনানী কার্যালয়ের সামনে নির্বাচন বর্জনের জন্য বিক্ষোভ করে। উক্ত বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। 

অর্থাৎ, উপরোক্ত ভিডিওগুলোর কোনোটিতেই জাতীয় পার্টির নির্বাচন বর্জন এবং হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচন বাতিল শীর্ষক কোনো তথ্য প্রদান করা হয়নি।

এছাড়া, গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্রে আলোচিত দাবিগুলোর বিষয়ে কেনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে মূলধারার গণমাধ্যম যুগান্তরের ওয়েবসাইটে গত ১৮ ডিসেম্বর “ভোটে থাকার সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টির” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে  সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৮৩টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে দলটি। উক্ত প্রতিবেদনে দলটির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে উদ্ধৃত করে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয় নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জন করছে না। 

উল্লেখ্য, গত ২৯ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণা ও আগামী ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ। তবে গত ১১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট সরাসরি খারিজ করে দেন।

মূলত, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে উত্তপ্ত দেশের রাজনীতির মাঠ। এই নির্বাচনের অংশগ্রহণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অনেক আগ থেকেই বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে আসলেও এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল নানা কৌতূহল। নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে দলটির অভ্যন্তরেও পক্ষে বিপক্ষে নানা মত ছিল। এসবের প্রেক্ষিতে নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন গত ১৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বনানীতে অবস্থিত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে দলটির সিনিয়র নেতাদের বৈঠক চলাকালে নির্বাচন থেকে সরে দেওয়ার দাবিতে কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন জাতীয় পার্টির একদল নেতা-কর্মী। এসময় বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী গণমাধ্যমেও কথা বলেন। পরবর্তীতে উক্ত ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রচারিত একাধিক ভিডিও সংগ্রহ করে তার সাথে পুরোনো ভিন্ন ঘটনায় পুলিশের বাঁধা দানের ভিডিওসহ বেশকয়েকটি ভিডিও যুক্ত করে জাতীয় পার্টির নির্বাচন বর্জন এবং হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচন বাতিল হয়েছে   দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচিত দাবিগুলো সঠিক নয়। গত ১৭ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু দলটির নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। এছাড়া হাইকোর্ট কর্তৃক নির্বাচন বাতিলের কোনো ঘোষণাও আসেনি। প্রকৃতপক্ষে, কোনোপ্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই আলোচিত দাবিগুলো প্রচার করা হয়েছে। 

প্রসঙ্গত, আগামী ৭ জানুয়ারি রোববার ভোটগ্রহণের দিন রেখে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষনে এই ঘোষণা দেন তিনি। ইতোমধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের প্রতীকও বরাদ্দ দেওয়া  হয়েছে।

সুতরাং, জাতীয় পার্টির নির্বাচন বর্জন এবং হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

spot_img