গুজরাটের গরু ও চিতাবাঘের ঘটনাকে আসামের দাবিতে বানোয়াট গল্প প্রচার

দীর্ঘদিন ধরে ‘ঘটনাটি আসামের। এক লোক গরুটি কিনে এনে তার উঠুনে বেঁধে রাখে। কিন্তু প্রত্যেক গভীর রাতে কুকুরের খুব ঘেউ ঘেউ ডাকাডাকি শুনতে পায়। তারা ভাবল এই লকডাউনের সময়ে হয়তো চোরের উৎপাত বেড়েছে। তাই তারা সেখানে সিসিটিভি সেট করে। পরের দিন সিসিটিভি ফুটেজ দেখেতো সবাই হতবাক, গরুটির পাশে একটা চিতা ঘুর ঘুর করছে।’ শীর্ষক শিরোনামে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।

দীর্ঘদিন ধরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানেএখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানেএখানে

বাংলাদেশে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে

যা দাবি করা হচ্ছে

‘ঘটনাটি আসামের। এক লোক গরুটি কিনে এনে তার উঠুনে বেঁধে রাখে। কিন্তু প্রত্যেক গভীর রাতে কুকুরের খুব ঘেউ ঘেউ ডাকাডাকি শুনতে পায়। তারা ভাবল এই লকডাউনের সময়ে হয়তো চোরের উৎপাত বেড়েছে। তাই তারা সেখানে সিসিটিভি সেট করে। পরের দিন সিসিটিভি ফুটেজ দেখেতো সবাই হতবাক, গরুটির পাশে একটা চিতা ঘুর ঘুর করছে।

পরে তারা যার কাছ থেকে গরুটি কিনেছিল তার কাছে যায় ব্যাপারটা জানতে। আর জানতে পারে যে এই চিতাবাঘটির জন্মের ২০ দিন বয়সে তার মা চিতাবাঘিনী মারা যায়। তারপরে এই গরুটির দুগ্ধপান করে সে বাঁচে। তাই সে তার ত্রাণকর্ত্রী দুধমাকে ভুলে যায়নি, প্রত্যেক রাত্রে দেখা করতে আসে। মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। মাও আদর করে।’

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গরু ও চিতাবাঘের মাতৃত্ব ও দুগ্ধপানের দাবিতে প্রচারিত ছবিটি ভারতের আসামের নয় বরং এটি ভারতের গুজরাটের ঘটনা। এছাড়া ছবিটির সঙ্গে যুক্ত তথ্যটিও ভিত্তিহীন।

রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে On Forest নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল ‘Stranger than Fiction-A Leopard and motherly Cow‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

screenshot from on forest 

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, চিতা ও গরুর অপ্রত্যাশিত সম্পর্কের এই ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০২ সালে, ভারতের গুজরাটের ভদোদরা জেলার আনতলি গ্রামে। 

screenshot from on forest

তবে এই প্রতিবেদনটির কোথাও চিতাবাঘটির জন্মের পর তার মা চিতাবাঘ মারা যাওয়ায় গরু কর্তৃক তাকে দুধ পান করানোর ব্যাপারে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

পরবর্তীতে ভারতীয় গণমাধ্যম The Times of India তে ২০০২ সালের ২৫ অক্টোবর ‘The love story of a leopard and a cow‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

screenshot from Times of India

এই প্রতিবেদনটি থেকেও জানা যায়, গরু ও চিতাবাঘের এই সম্পর্কের ঘটনাটি ভারতের গুজরাটের ভদোদরা জেলার আনতলি গ্রামের।

পাশাপাশি প্রতিবেদনটিতে এই ঘটনা প্রসঙ্গে ভদোদরা জেলার তৎকালীন বনরক্ষক এইচএস সিং বলেন, কখনো কখনো পশুদের আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়। সম্ভবত এই কারণেই যে মধ্যবয়সী চিতাবাঘটি বন্য পরিবেশে না থেকে গ্রামীণ এলাকায় চলে আসছে।

screenshot from Times of India

এই প্রতিবেদন থেকেও চিতাবাঘটির জন্মের পর তার মা চিতাবাঘটি মারা যাওয়ার এবং গরু কর্তৃক তাকে দুধ পান করানোর ব্যাপারে কোনো তথ্য জানা যায়নি।

এছাড়া ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ALT News এর ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ১২ জুন ‘Photos from 2002 of cow and leopard in Gujarat revived as recent incident in Assam‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রতিবেদনে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে প্রকশিত ২০০২ সালের এই ঘটনাটির প্রতিবেদক শ্যাম পারেখের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে।

২০২০ সালে দেওয়া ঐ সাক্ষাৎকারে শ্যাম পারেখ বলেন, এই ঘটনাটি ছিল গুজরাটে, ১৮ বছর আগে। ঐ সময়ে অনেকেই ঘটনাটিকে অবিশ্বাস করেছে৷ তবে আমরা একজন ওয়াইল্ডলাইফ চিত্রগ্রাহক এনেছিলাম এই চিতাবাঘ ও গরুর ছবি তোলার জন্য৷

ALT News এর প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, প্রায় দুই যুগ আগের এই ঘটনাটিই নতুন করে মিথ্যা ও বানোয়াট গল্প দিয়ে আসামের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল।

মূলত, ২০০২ সালে ভারতের গুজরাটের ভদোদরা জেলার আনতলি গ্রামে গরু ও চিতাবাঘের মধ্যে একটি অপ্রত্যাশিত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যা নিয়ে সে সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং এই ঘটনাটিকে ভদোদরা জেলার বনরক্ষক এইচএস সিং প্রাণীর আচরণের পরিবর্তনের কারণে হতে পারে বলে মতামত দিয়েছিলেন। ২০০২ সালের গুজরাটের এই ঘটনাটিকেই পরবর্তীতে ২০২০ সালে আসামের ঘটনার দাবিতে প্রচার করা হয় এবং একইসাথে দাবি করা হয় যে, ঐ চিতাবাঘটির মা মারা যাওয়ার পর গরুটি চিতাবাঘটি দুধ পান করিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। এরপর থেকে প্রতিবছরই এভাবেই ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঘটনাটি গুজরাটের এবং এর সাথে যুক্ত গল্পটি বানোয়াট ও মিথ্যা।

সুতরাং, ভারতের আসামের গরু ও চিতাবাঘের মাতৃত্ব ও দুগ্ধপানের দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img