পতঙ্গভূক প্রাণিকে মৃত মানুষের মাংস খায় দাবিতে প্রচার

সম্প্রতি, “কবরে আজাব দেওয়া মুর্দা খোর বিজ্জু” শীর্ষক শিরোনামে বেশ কিছু ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। 

Screenshot from Facebook

যা দাবি করা হচ্ছে

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, “এটা সেই প্রাণী যে কবরে আজাব দেয়। এর নাম মুর্দা খোর বিজ্জু। এটা গুনাহগার মানুষের কবরে ছিদ্র করে ঢুকে যায় আর তার সারা শরীরের মাংস খেয়ে ফেলে। এটা যখন কোনো কবরের কাছে যায় তখন যদি কোনো কবর থেকে ঘ্রাণ আসে তাহলে সে ঐ কবরে ছিদ্র করেনা। কারণ সে ঐ ঘ্রাণ পেয়ে বুঝে যায় এটা কোনো ইমানদার ব্যাক্তির কবর আর যে কবর থেকে ঘ্রাণ আসে সে ওই কবরে ঢুকে যায়, তার সারা শরীর খেয়ে ফেলে। আর এই ঘ্রাণ শুধু এই প্রাণীটাই পায়, যাতে সে গুনাহগার এবং নেক লোকদের চিনতে পারে।”

দাবি পর্যালোচনা

ভিডিওটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উক্ত ভিডিওটিতে মুর্দাখোর বিজ্জু নামে একটি প্রাণির কথা বলা হলেও সেখানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দুটি আলাদা প্রাণিকে দেখানো হয়েছে। প্রথমে ভিডিওর ১-৫ সেকেডে পর্যন্ত একটি প্রাণিকে দেখা গেলেও ৫-৭ সেকেন্ডের মাথায় সারা শরীরে মোটা আঁশযুক্ত ভিন্ন আরেকটি প্রাণিকে কিছু একটা খুড়ঁতে দেখা যায় এবং সম্পূর্ণ ভিডিওর বাকি অংশে আবার প্রথম প্রাণিটিকেই দেখানো হয়।  

Screenshot Collage by Rumor Scanner 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

একই দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতে যে দুই প্রাণিকে মুর্দা খোর বিজ্জু দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে তারা কখনোই মানুষ বা অন্য কোন প্রাণির মৃতদেহ ভক্ষণ করে না বরং এরা পিঁপড়া এবং উইঁপোকার মতো ছোট ছোট পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে। 

ভিডিওতে প্রচার হওয়া প্রথম প্রাণিটির বিষয়ে যা জানা গেল

ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতে প্রথম যে প্রাণিটিকে ‘মুর্দা খোর বিজ্জু’ দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে সেটির প্রকৃত পরিচয় অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে The Dodo নামক একটি ওয়েবসাইট কর্তৃক প্রকাশিত আর্টিকেল থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, উক্ত প্রাণীটির প্রকৃত নাম হচ্ছে Armadillo (আর্মাডিলো)। তবে ছবিতে যে Armadillo টি দেখানো হচ্ছে সেটি সবচাইতে বড় প্রজাতির আর্মাডিলো, যারা Giant armadillos নামে পরিচিত। 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

প্রাণি বিষয়ক ওয়েবসাইট Animalia কর্তৃক প্রকাশিত একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায়, জায়ান্ট আর্মাডিলোরা Chlamyphoridae পরিবারভূক্ত প্রাণি এবং এদের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Priodontes maximus.

Screenshot source: Animalia

জায়ান্ট আর্মাডিলোরা তাদের নখর ব্যবহার করে বিশ্রামের জন্য বড় বড় গর্ত খনন করে এবং এক্ষেত্রে তাদের নখগুলো কোদালের মতো কাজ করে।  

ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতে জায়ান্ট আর্মাডিলোরা মৃত মানুষের মাংস খায় দাবি করা হলেও প্রাণিবিষয়ক ওয়েবসাইট Animalia কর্তৃক প্রকাশিত আর্টিকেলে বলা হয়, জায়ান্ট আর্মাডিলো মূলত পতঙ্গভূক এবং এরা সাধারণত পিঁপড়া, উইপোকা, মাকড়সা এবং বিভিন্ন প্রাণির লার্ভা খেয়ে বেঁচে থাকে। 

Image Source: Animalia 

তাছাড়া, আর্মাডিলো সম্পর্কে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর একটি আর্টিকেলে বলা হয়, আর্মাডিলোরা মূলত নাতিশীতোষ্ণ এবং উষ্ণ আবাসস্থলে বাস করে, যার মধ্যে রয়েছে রেইন ফরেস্ট, তৃণভূমি এবং আধা-মরুভূমি। এদের দৈহিক বিপাকীয় হার কম হওয়াতে এবং চর্বি সঞ্চয়ের সক্ষম অভাবের কারণে, ঠান্ডা আবহাওয়া এদের জন্য অনুকূল নয় এবং এই ধরণের আবহাওয়া এদের পুরো জনসংখ্যাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে।

এই প্রাণিদের বেশিরভাগ প্রজাতিই গর্ত খনন করে এবং প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত ঘুমায়। ভোরবেলা এবং সন্ধ্যায় পোকা, পিঁপড়া, উইপোকা এবং অন্যান্য পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে। এদের দৃষ্টিশক্তি খুব কম হওয়ার কারণে এরা শিকারের জন্য তাদের তীব্র ঘ্রাণশক্তি ব্যবহার করে। এদের শক্ত পা এবং সামনের বিশাল নখগুলো মূলত খননের জন্য এবং লম্বা, আঠালো জিহ্বাগুলো তাদের টানেল থেকে পিঁপড়া এবং উইপোকা বের করার জন্য ব্যবহৃত হয়। বাগ (এক ধরনের পতঙ্গ) ছাড়াও, আর্মাডিলোরা ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণী, গাছপালা এবং কিছু ফল খায়। সেইসাথে মাঝে মাঝে ক্যারিয়ন খাবারও খায়।

Screenshot Source: National Geographic

সুতরাং সমস্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে সমস্ত আর্মাডিলোরা মূলত পতঙ্গভূক। অর্থাৎ এরা মৃত প্রাণিদেহ ভক্ষণ করেনা। 

ভিডিওতে প্রচার হওয়া দ্বিতীয় প্রাণিটির বিষয়ে যা জানা গেল

ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতে দ্বিতীয় যে প্রাণিটিকে ‘মুর্দা খোর বিজ্জু’ দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে, সেটির প্রকৃত পরিচয় অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ১৯ জুন, ২০২১ তারিখে প্রকাশিত ‘BBC News বাংলা’ ফেসবুক পেইজের একটি ভিডিও খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। উক্ত ভিডিওর ক্যাপশন এবং ছবির প্রাণিটির ছবি দেখে বোঝা যায়, মুর্দাখোর বিজ্জু দাবিতে প্রচার করা দ্বিতীয় প্রাণিটির প্রকৃত নাম বনরুই (Pangolin) এবং এটি সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী।

Screenshot collage: Rumor Scanner

পরবর্তীতে, কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে  “Pangolin Animal Facts – AZ Animals” শিরোনামে প্রাণী বিষয়ক ওয়েবসাইট A-Z Animals একটি আর্টিকেল খুঁজে পাওয়া যায়। 

উক্ত আর্টিকেলে প্যাঙ্গোলিন সম্পর্কে সুবিন্যস্ত কিছু তথ্য-উপাত্ত এবং এদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে তৈরিকৃত একটি তালিকা থেকে জানা যায়, দেহে মাছের আঁশের মতো আবরণযুক্ত বাদামী বর্ণের এই স্তন্যপায়ী প্রাণিটি লম্বায় প্রায় ১-৩ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং প্রজাতিভেদে এদের ওজন প্রায় ১.৬ থেকে ৩৩ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। 

প্যাঙ্গোলিনেরা সাধারণত আঁশযুক্ত Anteaters হিসেবেও পরিচিত। তবে শ্রেণিবিন্যাস এবং জিনগত দিক থকে Anteaters এর সাথে এদের বিস্তর তফাত রয়েছে। সাধারনত প্যাঙ্গোলিন এর মোট ৮ টা প্রজাতি রয়েছে যারা আবার ৩টি ভিন্ন ভিন্ন গণের অন্তর্ভুক্ত। এই তিনটি গণ হচ্ছে Manis, Phataginus, and Smutsia.

Screenshot Source: ITIS

তবে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে প্যাঙ্গোলিনের যে প্রজাতিটিকে খুঁজে পাওয়া যায় সেটির বৈজ্ঞানিক নাম Manis crassicaudata.

প্যাঙ্গোলিনের তুলনামূলকভাবে ছোট, সূক্ষ্ম মাথা রয়েছে যা পোকামাকড়ের গর্ত এবং বাসায় অনুপ্রবেশের জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত। এই স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মুখে পরিপূর্ণ দাঁতের অভাব সহ বেশ কিছু অনন্য অভিযোজন ক্ষমতা এবং বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন: তাদের একটি দীর্ঘ জিহ্বা রয়েছে যা পোকামাকড় শিকার করার জন্য পুরোপুরি বিশেষভাবে অভিযোজিত। তাছাড়া, তাদের পায়ে রয়েছে ধারালো নখ যা তাদের গাছ কিংবা অন্য কোনোকিছু আঁকড়ে ধরতে এবং শিকারের বাসা ভাঙতে সাহায্য করে। তাদের পেছনে রয়েছে একটি লেজ যা দেহের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। 

প্যাঙ্গোলিনরা সাধারণত লাজুক এবং একাকী, একা বা জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। এরা প্রাথমিকভাবে নিশাচর (একটি প্রজাতি বাদে) এবং গাছে বা মাটির ধারে খাবার খুঁজে থাকে। যখন এরা শিকারীদের মুখোমুখি হয় তখন তাদের সাঁজোয়া আঁশগুলো একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। অনেকটা আর্মাডিলোর মতো, যখন শিকারীদের মুখোমুখি হয়। তাছাড়া এদের ঘ্রাণ-নিঃসরণকারী গ্রন্থিও রয়েছে যা তাদের হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। 

প্যাঙ্গোলিনদের এশিয়া ও আফ্রিকা উভয় দেশেই পাওয়া যায়। এদের কিছু প্রজাতি বৃক্ষচারী, তাই তারা তাদের বেশিরভাগ সময় ঘুমাতে, শিকারে এবং গাছে বসবাস করে। তাদের নমনীয় লেজটি গাছে উলম্ব বরাবর তাদের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে যাতে করে তাদের সামনের নখগুলো ব্যাবহার ব্যবহার করে কীটপতঙ্গের বাসা ভাঙতে পারে। প্যাঙ্গোলিনের বাকি প্রজাতিগূলো মূলত,  মাটিতে থাকে এবং সাধারণত গর্তে বাস করে। 

ফেসবুক এবং ইউটিউবের বেশ কিছু ভিডিওতে প্যাঙ্গোলিনেরা মৃত মানুষের মাংস খায় দাবি করা হলেও একাধিক প্রাণিবিষক ওয়েবসাইটে এই দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম। বরং সকল স্থানে এটিকে কীটপতঙ্গভূক হিসেবেই উল্লেখিত করা হয়। 

A-Z Animal এর আর্টকেলটিতে বলা হয়, অনেকটা অ্যান্টেটারের মতোই, প্যাঙ্গোলিনেরাও একচেটিয়া কীটপতঙ্গভূক বড় বাসাগুলোতে বসবাসকারী দূর্বল শিকারের সন্ধান করে। তাদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলেও, তারা তাদের অত্যন্ত শক্তিশালী গন্ধের অনুভূতি দিয়ে এই অভাব পূরণ করে। তাদের প্রখর নাক মাটির নিচে কিংবা গাছের ছালের নিচে বসবাসকারী কীট-পতঙ্গদের খুব সহজেই খুঁজে বের করতে পারে। এরা মূলত পিঁপড়া এবং উঁইপোকা এবং বিভিন্ন প্রাণির লার্ভা খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে।

Screenshot Source: A-Z Animal

তাছাড়া ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ওয়েবসাইটে “Pangolin facts and information” শিরোনামের একটি আর্টিকেলেও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া “মুর্দা খোর বিজ্জু” নামে প্রচারিত প্রাণিটিকে পতঙ্গভূক হিসেবেই উল্লেখিত করা হয়েছে।

Screenshot Source: National Geographic

সুতরাং সমস্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্যাঙ্গোলিনেরা (Pangolin) মূলত পতঙ্গভূক এবং এরা মৃত প্রাণিদেহ ভক্ষণ করেনা।

মূলত, Armadillo এবং Pangolin নামের দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রাণির ভিডিও ক্লিপ একত্রিত করে এদেরকে ‘মুর্দা খোর বিজ্জু’ নামে ডাকা হচ্ছে এবং একই সাথে দাবি করা হচ্ছে যে এই প্রাণিগুলো মৃত মানুষের মাংস খায়। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই প্রাণিগুলো মোটেও মানুষের মাংস ভক্ষণ করেনা, বরং এরা উভয়েই পতঙ্গভূক।   

সুতরাং ফেসবুক এবং ইউটিউবে প্রচারিত বেশকিছু ভিডিওতে দুটি পতঙ্গভূক প্রাণিকে ‘মৃত মানুষের মাংস খায়’ দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img