সম্প্রতি “নুরকে বিশ্বাস করে ভিপি বানিয়েছিলাম, দলের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু মোসাদের কাছ থেকে গোপনে ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে” শীর্ষক শিরোনামে গণ অধিকার পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হাসান আল মামুনের মন্তব্য দাবিতে একটি তথ্য একটি ফটোকার্ডের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর মোসাদের কাছ থেকে গোপনে ৪০০ কোটি টাকা নিয়েছেন শীর্ষক কোনো মন্তব্য গণঅধিকার পরিষদ নেতা হাসান আল মামুন করেননি বরং কোনোপ্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই গণমাধ্যমের আদলে একটি ফটোকার্ড তৈরি করে উক্ত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে ছাত্র অধিকার পরিষদের একাংশের সদস্য সচিবকে নিয়ে সংগঠনটির অপর অংশের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হাসান আল মামুনের এমন মন্তব্যের বিপরীতে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে কোনো প্রকাশিত সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে মূলধারার দেশীয় গণমাধ্যম ‘দৈনিক কালবেলা’ এর ওয়েবসাইটে গত ২০ জুন “নুর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে : হাসান আল মামুন” শীর্ষক শিরোনামেপ্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে থেকে সাম্প্রতিক সময়ে নুরুল হক নুরকে নিয়ে হাসান আল মামুনের মন্তব্য জানা যায়।
কালবেলাকে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমরা নুরুল হক নুরকে বিশ্বাস করেছিলাম। তাকে ভিপি বানিয়েছি। দলের দায়িত্ব দিয়েছি। কিন্তু সেই আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইসরায়েলি এজেন্টের সঙ্গে নুর বৈঠক করেছে। সে এখন সেটা স্বীকার করেছে। অথচ শুরুতে এটা নিয়ে আমরা অন্য দলগুলোর সঙ্গে তর্ক করেছি। আমাদের তখন বলা হয়েছিল, এমন কোনো বৈঠক হয়নি। অথচ এখন বৈঠকের কথা বলছেন। এভাবে দ্বিমুখী চরিত্রের মানুষ নেতৃত্বে থাকতে পারে না। তার বিরুদ্ধে অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগও রয়েছে। এসব কাজ করে নুর দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।’ হাসান আল মামুন বলেন, ‘রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ এনেছেন অনেকে। আমরা চাই এসবের তদন্ত হোক। তদন্ত করা হবে। এরপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এছাড়া একই দিনে মূলধারার আরেক সংবাদমাধ্যম এনটিভি এর ওয়েবসাইটে “রেজা-নুরের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হবে : হাসান আল মামুন” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
এনটিভিকে দেওয়া বক্তব্যে হাসান আল মামুন জানান, ‘কোটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছি। তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম। আমাদের রাশেদ ছিলেন। আমরা পরবর্তীতে তারুণ্য নির্ভর দল (গণ অধিকার পরিষদ) গড়ে তুলি। আজকে আহ্বায়ক সদস্য সচিবকে বহিষ্কার করে, সদস্য সচিব আহ্বায়ককে বহিষ্কার করে। আসলে যা হচ্ছে এভাবে চলতে পারে না।’
তিনি আরও জানান, ‘আমাদের ১২১ সদস্যের কমিটি আছে। আমরা খুব শিগগিরই একটা তদন্ত কমিটি গঠন করব। একটি নিরপেক্ষ তদন্তে মাধ্যমে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব আমরা।’
এছাড়া মূলধারার গণমাধ্যম একাত্তর টিভির ফেসবুক পেজে গত ২১ জুন “অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগেই কি শেষ হবে গণ অধিকারের রাজনীতি?” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত ভিডিওতে গণঅধিকার পরিষদের সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে একাত্তর জার্নালের লাইভ অনুষ্ঠানে দেওয়া হাসান আল মামুনের বক্তব্য দেখা যায়, লাইভে হাসান আল মামুন জানান, এখানে আমাকে ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব করা হয়েছে বা রাশেদ খানকে ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক করা হয়েছে এটি মূল বিষয় নয়। মূল বিষয়টি হচ্ছে সদস্য সচিব নুরুল হন নুর রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে ইন্সাফ পার্টিতে যোগদান করার অভিযোগ এনেছেন। রেজা কিবরিয়া বলছেন সরকার বিরোধী যেকোনো আন্দোলনে আমি থাকবো। রেজা কিবরিয়া নুরুল হকের বিরুদ্ধে মেন্দি সাফাদির সাথে বৈঠক, ওর সাথে যোগাযোগ, ইন্ডিয়ান এম্বাসির সাথে যোগাযোগ করেন এই বিষয়ে তারা একে অপরের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বক্তব্য দিচ্ছেন, পরস্পরকে বহিষ্কার করছেন। তাহলে আমরা কারা?
উপরে আলোচ্য কোনো প্রতিবেদনেই নুরুল হক নুর মোসাদের কাছ থেকে গোপনে ৪০০ কোটি টাকা নিয়েছেন শীর্ষক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানের মাধ্যমে ‘দৈনিক প্রথম আলো’তে “এবার নুরুল হক ও রাশেদকে গণ অধিকার পরিষদ থেকে অব্যাহতির ঘোষণা রেজা কিবরিয়ার” শীর্ষক শিরোনামে গত ২০ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় রেজা কিবরিয়ার সঙ্গে নুরুল হক নুরের বিরোধ প্রকাশ্য হলে একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বিবৃতি সহ নিজ নিজ ফেসবুক পাতায়ও পোস্ট দিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেন। এর মধ্যে ১৯ জুন রাতে নুরুল হকের নেতৃত্বে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলের ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন অভিযোগ এনে ২০ জুন গণ অধিকার পরিষদের প্যাডে রেজা কিবরিয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নুরুল হককে গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব এবং রাশেদ খানকে যুগ্ম আহ্বায়কের পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতির ঘোষণা দেওয়া হয়।
এছাড়া, বিষয়টি অধিকতর নিশ্চিতের জন্য রিউমর স্ক্যানারের পক্ষ থেকে গণ অধিকার পরিষদের একাংশের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হাসান আল মামুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “এখানে লেনদেনের ব্যাপারে কিংবা ৪ শত কোটি টাকার ব্যপারে কোনো মন্তব্য আমি করিনি। আমার নামে এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অনলাইনে বা অফলাইনে আমি এমন কোনো মন্তব্য করিনি।”
অর্থাৎ, উপরোক্ত তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর মোসাদের কাছ থেকে গোপনে ৪০০ কোটি টাকা নিয়েছে শীর্ষক কোনো মন্তব্য সংগঠনটির অন্য অংশ ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হাসান আল মামুন করেননি।
মূলত, গত ২১ জুন ‘নুরকে বিশ্বাস করে ভিপি বানিয়েছিলাম, দলের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু মোসাদের কাছ থেকে গোপনে ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’ শীর্ষক একটি বক্তব্য গণঅধিকার পরিষদের একাংশের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব হাসান আল মামুনের দাবিতে গণমাধ্যমের আদলে তৈরি একটি ফটোকার্ডের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, গণঅধিকার পরিষদ নেতা হাসান আল মামুন সংগঠনটির আরেক নেতা নুরুল হক নুর সম্পর্কে ‘আমরা নুরুল হক নুরকে বিশ্বাস করেছিলাম। তাকে ভিপি বানিয়েছি। দলের দায়িত্ব দিয়েছি। কিন্তু সেই আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’ শীর্ষক মন্তব্য করলেও নুর মোসাদের কাছ থেকে ৪০০ কোটি টাকা নিয়েছে এমন কোনো মন্তব্য করেননি। এছাড়া, সম্প্রতি গণঅধিকার পরিষদের শীর্ষ নেতা রেজা কিবরিয়া সংগঠনের আরেক শীর্ষ নেতা নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ মোসাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলেন।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া ও সদস্যসচিব নুরুল হক নুরের একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংগঠনটিতে পাল্টাপাল্টি অব্যাহতির ঘটনা ঘটেছে। গত ১৯ জুন নুরুল হক নুর ও তাঁর অনুসারীরা দলে আহ্বায়ক থাকার পরও তার পদের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত না জানিয়ে যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রাশেদ খানকে দলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ঘোষণা করেন। এর প্লাটা প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরদিন ২০ জুন নুরুল হক নুর ও রাশেদ খাঁনকে দলের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দেন রেজা কিবরিয়া। একই সঙ্গে আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে দলের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব ঘোষণা করেন তিনি। এর আগে সংগঠনের অভ্যন্তরে শীর্ষ দুই নেতার বিরোধী নিয়ে গত ১৮ জুন ঢাকায় রেজা কিবরিয়ার বাসভবনে বেঠকে বসেন গণ অধিকার পরিষদের নেতৃবৃন্দ। বৈঠকে নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে সংগঠনের তহবিল নিয়ে নয়ছয়সহ সংগঠনে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলেন৷ এছাড়া নুরের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বৈঠক এবং একটি দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ তুলেন রেজা কিবরিয়া। অপরদিকে নুরুল হক নুরও রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে সংগঠনের অনুমতি না নিয়ে অনেক দিন ধরে ফরহাদ মজহার ও শওকত মাহমুদের নেতৃত্বাধীন ইনসাফ কায়েম কমিটির কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নেওয়া এবং তাদের থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ করেন। এছাড়া রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে দলের সাংগঠনিক কর্মসূচিতে সময় না দেওয়ার অভিযোগ করেন নুরুল হক নুর।
উল্লেখ্য, পূর্বেও ডিজিটাল ফটোকার্ডে ভুয়া দাবি প্রচার করা হলে সেগুলোকে মিথ্যা হিসেবে শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
সুতরাং, নুরুল হক নুর মোসাদের কাছ থেকে গোপনে ৪০০ কোটি নিয়েছেন শীর্ষক মন্তব্যকে হাসান আল মামুনের মন্তব্য দাবি করে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Statement from Hasan Al Mamun
- NTV – “রেজা-নুরের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হবে : হাসান আল মামুন”
- Kalbela – “নুর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে : হাসান আল মামুন”
- Prothom Alo – গণ অধিকার পরিষদে পাল্টাপাল্টি অব্যাহতি
- Ekattor TV – “অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগেই কি শেষ হবে গণ অধিকারের রাজনীতি?”
- Rumor Scanner’s Own Analysis